ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাতের ময়দান

সন্ত্রাস পরিহার করে শান্তির পথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সন্ত্রাস পরিহার করে শান্তির পথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান

বাবুল হোসেন, আরাফাতের ময়দান থেকে ॥ শুধু মুসলিম নয়, সারা জাহানের সমস্ত মানবকুলের শান্তি, কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা কামনা করা হয়েছে হজের খুতবায়। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ওপর জুলুম নির্যাতনকারীদের আল্লাহর হেদায়েত কামনা করে মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি আব্দুল আজিজ আল শাইখ বলেছেন, সন্ত্রাস, হিংসা, বিদ্বেষ নয়- কেবল আল্লাহ ও রাসূল (সা)-এর নির্দেশিত পথেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সম্প্রতি মক্কায় ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন তিনি। হজের ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্টদের জন্য দোয়া করেন। খুতবার শেষ দিকে গ্র্যান্ড মুফতি বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আসুন, সবাই মিলে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রক্ষা করি। সেগুলো হলো- ধর্ম, সম্পদ, ইজ্জত, জীবন ও বিবেক-বুদ্ধি রক্ষার অধিকার। তিনি বলেন, গণবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে নিরাপত্তা টিকিয়ে রাখা যায় না। দেশ দখল ও পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত দিয়ে নিরাপত্তা অটুট রাখা সম্ভব নয়। অবরোধ, অনাহার, অধিকার হরণের ফলাফল কখনোই কল্যাণকর নয়। এগুলোর ফলে শত্রুতা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মসজিদে নামিরায় সৌদি আরবের বাদশাহ রাজপরিবারের সদস্য ও উর্ধতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বসে হজের খুতবা শোনেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ২০ লক্ষাধিক মানুষের চোখের পানিতে, আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে সব গুনাহ মাফ চাওয়ার প্রার্থনার মাধ্যমে শেষ হয় হজের খুতবা। স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার কিছু পরে শুরু হয়ে খুতবা শেষ হয় ১২টা ৪৪ মিনিটে। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে খুতবা প্রদান শুরু করেন গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল শাইখ। এরপর বলেন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য। তাই আমি তারই প্রশংসা করছি। সেই আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হজরত মোহাম্মদ (সা.) তার বান্দা ও তার পক্ষ থেকে প্রেরিত পুরুষ (রাসূল)। কামনা করছি, তার প্রতি, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবিদের প্রতি কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবারিত রহমত বর্ষিত হোক। এরপর তিনি বলেন, হে মানবম-লী! ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে সন্ত্রাসের কোন স্থান নেই। ইসলামে শুধু মানবাধিকার নয়, পশুর অধিকার সম্পর্কেও বলা হয়েছে। ইসলাম সাদা-কালো, ধনী-গরিবের মধ্যে কোন পার্থক্য করেনি। ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় সভ্যতাই উৎকৃষ্ট। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করার কথাও বলা হয়েছে ইসলামে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল হজের খুতবা ও হাজিদের আরাফায় অবস্থান সরাসরি সম্প্রচার করে। হযরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফার ময়দানে উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ইসলামের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করাসহ জীবন পরিচালনায় ইসলামের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। বিদায় হজের ভাষণের অনুকরণে সমবেত হাজিদের উদ্দেশে প্রতি বছর হজের দিন খুতবা দেয়া হয়। খুতবার শুরুতে গ্র্যান্ড মুফতি আরাফার দিবস সম্পর্কে বলেন- আরাফা এমন এক দিবস, যেদিন বান্দারা হাশরের ময়দানে নিজেদের সম্মিলনের কথা স্মরণ করে। এদিন তারা সবাই পার্থিব জৌলুস ও চাকচিক্য থেকে মুক্ত হয়। তারা দুই টুকরা সফেদ কাপড় গায়ে জড়ায়। এ যেন তাদের কাফনের কাপড়। যেন তারা হাশরের মাঠে তাদের রবের সামনে দাঁড়ানোর জন্য পুনরুত্থিত হয়েছে। সবার কাঁধ আকাশ অভিমুখী। সবার স্বর দোয়া ও কান্নায় গুঞ্জরিত। পার্থক্য শুধু এতটুকু, এদিন দোয়া কবুল করা হবে। আর হাশরের দিন খাতাগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। সুতরাং হিসাবের খাতা বন্ধ করার আগেই দিনটিকে কাজে লাগাতে হবে। খুতবায় গ্র্যান্ড মুফতি আরও বলেন, শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে নৈরাজ্য ও সন্দেহ ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এ জন্য সবাইকে নিজ নিজ দেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানান তিনি। বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিষয়ে কঠিন ভাষায় ঘৃণা প্রকাশ করে তিনি সবাইকে শান্তির পথে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। গ্র্যান্ড মুফতি বলেন, যারা সন্ত্রাস করে জমিনের অধিবাসীদের কষ্ট দেয়, তারা ইসলাম থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তাদের মুখে ইসলামের কথা পরোক্ষভাবে ইসলাম অবমাননার শামিল। খুতবায় তিনি কোরান-হাদিসের মূলনীতির ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন-পরস্পরের ভেদাভেদ ভুলে শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এ সময় লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক-ধ্বনিতে পাপ মুক্তি ও আল্লাহর খাস রহমতের আশায় লাখ লাখ মুসল্লির চোখের জলে সিক্ত হয়েছে আরাফাতের ময়দান। দুই হাত তুলে এক সঙ্গে বিশ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। মোনাজাতে বার বার উঠে এসেছে- সন্ত্রাসমুক্ত শান্তিময় পৃথিবী গড়ার। বুধবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে খুতবা শুরু হয়। শেষ হয় ১২টা ৪৪ মিনিটে। বিশ্বের ১৬৩টি দেশ থেকে আগত বিশ লক্ষাধিক মুসলমান আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হয়ে এ খুতবা শোনেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দু’চোখের দৃষ্টি হারানো সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির এটি ৩৪তম হজের খুতবা। দৃষ্টিশক্তিহীন এই ইমাম তুলে ধরেন বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি ও কোরান-হাদিসের আলোকে করণীয় দিকনির্দেশনা। খুতবায় মুসলিম উম্মাহর শান্তি কল্যাণ ও সমৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করেন তিনি। গ্র্যান্ড মুফতি হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরবের গৃহীত যাবতীয় পদক্ষেপের প্রশংসা করেন এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। সন্ধ্যায় (সূর্যাস্তের পর) তারা মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করেন। দুপুরে খুতবার পর যোহর ও আছরের নামাজ আদায় করেন হাজিরা। তাঁরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় গিয়ে এক আজানে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। রাতে সেখানে অবস্থান করবেন খোলা মাঠে। শয়তানকে নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন এখানেই। আজ বৃহস্পতিবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজিদের কেউ ট্রেনে, কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানের উদ্দেশ্যে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (মাথা ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদল করবেন। এর পর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরীফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবা শরীফের সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় আরও এক বা দুইদিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করবেন। এর পর আবার মক্কায় ফিরে বিদায়ী তাওয়াফ করবেন। আগে যাঁরা মদীনায় যাননি, তাঁরা বিদায়ী তাওয়াফের পর মদিনায় যাবেন। যাঁরা আগে মদিনায় গেছেন, তাঁরা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন। এবারও কটি স্যাটেলাইট চ্যানেল সৌদিয়া টেলিভিশনের কল্যাণে আরাফাতের ময়দান থেকে খুতবা ও দোয়া সরাসরি সম্প্রচার করে। এতে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষ আরাফাতের হজের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। জানা যায়, এবার আরাফাতের ময়দানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় হজের সামগ্রিক কর্মকা- তদারকি করা হয়েছে। বাংলাদেশের হাজিদের সবাইকে একটি নির্দিষ্ট চিহ্নিত স্থানের খিমায় রাখার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে অনেকেই আখেরি মোনাজাত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিজ নিজ স্বজনদের কাছে সরাসরি সম্প্রচার করেছেন। এতে বাংলাদেশে অবস্থান করেও অনেকে মোনাজাতে অংশ নেন বলে জানা যায়। সৌদি হজ মন্ত্রণালয় ও মোয়াচ্ছাসা কার্যালয় সূত্র জানায়, মক্কা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজিকে বিনামূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজিদের নানা উপহার দিচ্ছে। জানা যায়, পবিত্র হজ পালন করতে এসে এ পর্যত ৪৫ বাংলাদেশীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের সব হাজি সুস্থ আছেন। হজ মিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে হজযাত্রীদের সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করা হয়। হজের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হিজরী ১০ সালে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজের সময় আরাফাতে অবস্থিত জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের উদ্দেশে হযরত মুহম্মদ (সা) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ ভাষণ। তাই সচরাচর এটিকেই বিদায় খুতবা বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ অনুযায়ী মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে এ ভাষণেই চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। পবিত্র হজকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রায় ২০ লক্ষাধিক মুসলমানের নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পবিত্র শহর মক্কা এবং এর আশপাশের ৩০০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী। মোতায়েন করা হয়েছে এক লাখ নিরাপত্তাকর্মী। বিমানের ফিরতি ফ্লাইট শুরু ২৮ সেপ্টেম্বর ॥ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফিরতি হজ ফ্লাইট শুরু হবে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর। চলবে আগামী ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। এ বছর বাংলাদেশ থেকে হজ করতে সৌদি আরব গেছেন মোট ১ লাখ ৭ হাজার ২৯০ জন। এর মধ্যে নির্ধারিত ৫১ হাজার ও অতিরিক্ত প্রায় চার হাজারসহ মোট ৫৪ হাজার ৮৪৫ জনকে বহন করেছে বিমান। অবশিষ্ট ৫২ হাজার ৪৪৫ জন গেছেন সৌদি এ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সে। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে ১৬টি ও সিলেট থেকে ৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে বিমান। -বিজ্ঞপ্তি
×