ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ আজ ৯ জিলহজ। সৌদি আরবে ১০ জিলহজ। হাজী সাহেবদের মহান পবিত্র আরাফা মুযদালিফার ইবাদত সম্পন্ন করে কোরবানিদানের ব্যস্ততার দিন আজ। আজ শয়তানকে কঙ্করও মারতে হবে। হিম্মতওয়ালারা অনেকে ছুটে চলেছেন ফরজ তাওয়াফ সম্পন্ন করার জন্য। কোরবানির পর মাথা মু-িয়ে পরিধান করতে হবে সাধারণ পোশাক। আর আমাদের দেশে নিশ্চয়ই এ সময় চলছে হাট-বাজারে পশু কেনার ধুম। যেহেতু কাল পবিত্র ঈদ-উল-আযহা বা পশু কোরবানির দিবস। একই সঙ্গে ঈদ জামাত সুসম্পন্ন করার নানা চিন্তা ও ব্যস্ততা। বলাবাহুল্য, পবিত্র ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানি আমাদের একটি প্রধান উৎসব। ‘কোরবানি দান’ কেন উৎসবের মর্যাদা পেয়েছে তা আমাদের অনুধাবনের প্রয়োজন রয়েছে। কোরবানি অর্থ যে কোন ধরনের ত্যাগ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় ত্যাগে আবার উৎসব বা আনন্দের কী আছে? এ তো বেদনার এবং হারানোর। আসলে আমরা যদি একটু গভীরে চিন্তা করি তাহলে দেখব কোরবানি বা ত্যাগ, যে উৎসর্গ, যে আত্মদান মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়, তা তো অন্তর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরিত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ (ত্যাগের) উৎসব। ‘ঈদ-উল-আযহার’ শব্দগত ও পারিবভাষিক মর্মের স্বার্থকতা এখানেই। বলা হয়েছে : পা সোয়াল্লি লি রাব্বিকা ওয়ান হার, ‘তোমার পালনকর্তার নামে নামাজ আদায় কর এবং কোরবানি দাও’ (১০৮/২)। কোরানের চতুর্থ পারার শুরুতে রয়েছে : ‘কস্মিনকালেও কল্যাণলাভ করতে পারবে না, যদি তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে তোমরা ব্যয় না কর। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় (বা দান) করবে আল্লাহ তা জানেন।’ হুজুরে পুর নূর (সা) ইরশাদ করেছেন : আল ইয়াদুল ওলিয়া খাইরুম মিন ইয়াদিস সুফলা- ‘উপরের হাত নিচের হাত হতে উত্তম।’ অর্থাৎ দান গ্রহণকারী থেকে দান-সাদকাকারী ব্যক্তি উত্তম। এ হাদীসে ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দলাভের জন্য উৎসাহিত করা হলো। ইতিহাসে একটা বিষয় লক্ষণীয়। প্রভুকে খুশি করার জন্য কিংবা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দুনিয়ার সবকটি প্রাচীন ধর্ম ও মতবাদে কোরবানি প্রথা দেখা যায়। যদিও তখনকার বিশ্বাস ও ধারণার পদ্ধতিগত বিষয়ে কিছুটা গলতি পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে পশু কিংবা মানুষ বলিদানের দৃষ্টান্ত বহু। ইসলাম ধর্ম এ প্রথাকে পরিমার্জিত, সহজতর ও সহজসাধ্য করে জগতবাসীর সামনে ধরে রেখেছে। প্রাচীনকালে আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের মধ্যে মানব বলি দেয়ার কথা জানা যায়। বিশেষত মেক্সিকোর আদিম সম্প্রদায় বিভিন্ন দেবতার নামে মানুষ উৎসর্গ করত। আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরাও অবিবাহিতা যুবতীদের উৎসর্গ করত। প্রাচীন মিসরীয় এবং গ্রীক রোমানদের মধ্যে নরবলির ব্যাপক প্রচলন ছিল। মিসরীয়রা নীল নদের নামে প্রতি বছর একটি করে মেয়ে উৎসর্গ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল তাতে নদী সন্তুষ্ট হয়ে পুরো দেশ পানিতে স্বয়ম্ভর করে দেবে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) এ ঘৃণ্য রেওয়াজ কঠোরহস্তে বন্ধ করেন। আদিযুগের কোন কোন কোরবানি প্রথার বর্ণনা স্বয়ং পবিত্র কোরানেও দেখা যায়। কোরান থেকে প্রাপ্ত ধারণামতে, কোরবানি উৎসর্গের রেওয়াজ আদি পিতা হযরত আদম (আ)-এর দু’সন্তান হাবিল ও কাবিলের সময় থেকে প্রচলিত হয়েছিল। হাবিল ও কাবিলের কোরবানিকেই আদি কোরবানি বলে ধরে নেয়া হয়। তাদের দু’জনের বিয়েকে কেন্দ্র করে পশু কোরবানির ঘটনা আল্লাহতায়ালা সূরা মায়েদায় সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বের বুকে এটি সর্বপ্রথম কোরবানির ঘটনা এবং কাবিল কর্তৃক হাবিলকে হত্যা করার ঘটনাটি ছিল প্রথম মানব হত্যা। নূহ নবী (আ)-এর আমলে এ প্রথা বিদ্যমান ছিল। মিসরের প্রখ্যাত আলিম মুহাম্মদ ফরিদ ওয়াজদী দায়েরাতুল মা’ আরিফ গ্রন্থে প্রমাণ সহকারে বলেন : হযরত নূহ জন্তু জবেহ করার উদ্দেশ্যে একটি কোরবানিগাহ নির্মাণ করেছিলেন। তাফসীরে হাক্কানীর ভাষ্যনুযায়ী, মহান নবী ইব্রাহীম-উত্তর সমস্ত নবী-রাসূলের জামানায় পশু কোরবানি শরীয়তের বিধানে রূপলাভ করে। বিখ্যাত নবী ইব্রাহীম (আ)-এর কাছে আল্লাহ তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুর কোরবানি প্রত্যাশা করেছিলেন। ইব্রাহীমের অন্তর সাধারণ মানুষের অন্তর ছিল না। তিনি মনে করলেন দুনিয়ায় তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর বৃদ্ধ বয়সের কলিজার টুকরা সন্তান ইসমাঈল। তিনি তাঁকে নিয়ে মিনার প্রান্তরে খোদা তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেন। এ সময় পিতা-পুত্র দু’জনেরই চোখ ছিল বাঁধা। ইব্রাহীম সন্তানকে কোরবানি দেয়ার পর হঠাৎ আওয়াজ এলো মজনু চোখ খোল, তোমার কোরবানি হয়েছে। তিনি চোখ খুললেন। দেখলেন সন্তান তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আর ছোরার নিচে কোরবানি হয়ে ছটফট করছে এক বেহেশতি দুম্বা। রহমানুর রাহীম আল্লাহ প্রমাণ করলেন একজন নবী ও তাঁর পরিবারের ত্যাগ একই সঙ্গে তাঁর পক্ষ থেকে ত্যাগী মুমিনদের জন্য বেহেশতি পুরস্কার ও নাজরানা। আজ আমরা প্রভুর সন্তুষ্টির জন্য সে কোরবানি পরবের দিকে আগুয়ান। আল্লাহ আমাদের অন্তরের অভিব্যক্তি কবুল করুন আর সহীহ সালামতে ক্রমাগত ফিরিয়ে নিয়ে যান মক্কা-মদীনায় সন্নিবেশিত তোমার মজনু দলকে।
×