ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

শেখ হাসিনার জন্মদিনে

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

শেখ হাসিনার জন্মদিনে

বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে দেখিলাম আপনারে বিচিত্র রূপের সমাবেশে -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ শেখ হাসিনার জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। শেখ হাসিনা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা। জননেত্রী, দেশরতœ, ভাষাকন্যা ইত্যাদি নানা বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করা হয়। পুরনো দিনের মানুষেরা একান্ত নিজের মতো করে বলেন, ‘শেখের বেটি’। বাংলাদেশের বিদগ্ধজনেরা যারা তাঁর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন তাঁরাও ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেন। শেখ হাসিনা, সততা ও দেশপ্রেমের জন্য স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মাত্র কয়েকদিন আগে হাফিংটন পোস্টের ব্লগে শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘জনগণকে রক্ষায় কারও দিকে তাকিয়ে নেই বাংলাদেশ’। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই কেবল বাংলাদেশ আজ বিশ^ সভায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নিজের ৬৮তম জন্মদিনে লিখেছিলেন, ‘বহু জন্মদিনে গাঁথা আমার জীবনে/দেখিলাম আপনারে বিচিত্র রূপের সমাবেশে।’ আজ শেখ হাসিনার ৬৮তম জন্মদিন। ২০১৫ সালে ইউনেস্কোর মহাসচিব ইরিনা বোকাভো শেখ হাসিনার হাতে ‘ পিস্ ট্রি’ পদক তুলে দিয়েছেন। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁর বক্তব্যের সারার্থÑ ‘এই সাহসী নারী আলোকবর্তিকা হিসেবে সারা পৃথিবীতে পথ দেখাচ্ছেন।’ সত্যিই তো শেখ হাসিনার জীবন কর্মবহুল ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখন এটা শুধু একটি নামই নয়, এটা একটি প্রতিষ্ঠান। ডড়ৎশ রং ড়িৎংযরঢ় যার জীবনের মূলমন্ত্র, কর্ম-জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে গঠিত এক অসাধারণ জীবন তাঁর। শেখ হাসিনা বাঙালী জাতির ৎধষষরহম ঢ়ড়রহঃ, পবসবহঃরহম নড়হফ। জননেত্রী শেখ হাসিনা এদেশের জনগণের কাছে মুক্তিযুদ্ধের একটি রূপক। সুখে থাকার, স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করার আকর্ষণ মানুষের জন্য খুবই স্বাভাবিক। সাধারণের জন্য এটাই কাক্সিক্ষত জীবনযাপন। ত্যাগের কথা শাস্ত্রে আছে, মনীষীদের জীবন গ্রন্থে আছে, চলমান জীবনাচরণে থাকাটা অস্বাভাবিক। শেখ হাসিনার চরম শত্রুও বলবেন, শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যারা শেখ হাসিনাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখার চেষ্টা করেন, তারা খুবই ভুল করবেন। আব্দুল গাফফার চৌধুরী ১৯৯৩ সালে জন্মদিনের এক লেখায় উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘সপ্তাহ দুই ঢাকাতেই ছিলাম। দেখা হতেই শওকত ভাই (শওকত ওসমান) আমার হাত ধরে বলেছিলেন, “গাফ্্্্্্্্্্্্্্্্্্্্ফার, দোহাই তোমার, হাসিনার সমালোচনা করো না। দীর্ঘকাল ধরেই তো চারদিকে তাকিয়ে দেখছি, এত জ্ঞানী-গুণী, ডান বামের বড় বড় নেতা। মুখে হাসিনার এত নিন্দা, সমালোচনা। কিন্তু ক্রাইসিসের সময় হাসিনা ছাড়া কাউকে দেখি না।” মা কয়েকদিন আগে বিখ্যাত পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’-এর সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আই ডু পলিটিক্্্্্্্্্্্্্্্্্্্স ফর দ্য পিপল’ (আমি জনগণের জন্য রাজনীতি করি)। সারা পৃথিবীর পরিবেশ কর্মীদের কাছে একজন আলোকবর্তিকা তিনি। যে কারণে ২০১৫ সালের ৬৮তম জন্মদিনের কয়েকদিন আগে জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ অর্জন করেছেন। ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের তদন্তের জন্যে ব্রিটিশ সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল। স্যার টমাস্ উইলিয়ামস কিউসি (এমপি), শ্যেন ম্যাকব্রাইড, জেফরি থমাস্ কিউসি প্রমুখ ব্যক্তির সমন্বয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করা হয়েছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার আগেই নিরবছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। জানি না, কোন এক অজানা কারণে অনেক কিছু অনেক কিছুর সঙ্গে মিলে যায়। কোন এক জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘সত্তা আমার, জানি না সে কোথা থেকে/ হল উত্থিত নিত্যধাবিত স্রোতে।’ আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়, শেখ হাসিনা একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, সংগঠক ও সৃজনশীল লেখক। একজন বিশিষ্টজন একবার শেখ হাসিনার জন্মদিনের লেখায় বলেছিলেন, শেখ হাসিনা বোধ হয় খুব ভাল করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সিপাই এবং খোয়াবনামা উপন্যাস পড়েছেন, খুব ভাল করে শওকত ওসমানের বনী আদম এবং জননী উপন্যাস পড়েছেন এবং পড়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্ভিক্ষ বিষয়ক গল্প। পড়তে পড়তে ভেবেছেন মানুষ, গ্রাম-বাংলার হতদরিদ্র মানুষ কিভাবে ভাতের জন্যে লড়াই করে, সুযোগ পেলেই ভাতের লড়াইকে ভোটের লড়াইয়ের দিকে নিয়ে আসে। তারা লড়াকু মানুষ, অজেয় মানুষ, অমর মানুষ, এই মানুষজনের কাছে শেখ হাসিনার দায়ভাগ আছে। এই দায়ভাগই শেখ হাসিনার রাজনীতি কিংবা তাঁর নিয়তি। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মস্থান কেনিয়া সফরে গিয়ে বলেছেন, ‘কেনিয়া যেন বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে এই দুই দেশকে অনুসরণ করে।’ এটা যে কত বড় একটা স্বীকৃতি, ভাবা যায় না। এটাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অসাধারণত্ব। তাঁর সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাঁর মহান পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামমুখর জীবনের অমলিন শিক্ষা, দেশ ও জনগণের প্রতি গভীর অনুরাগ, সুদৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, অক্লান্ত পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং অসাধারণ আত্মবিশ্বাস। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ১৭ মে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে সেদিন জনসমুদ্রে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “সবকিছু হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি। বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই।” এর মাত্র পাঁচদিন আগে ১১ মে বিশ্বখ্যাত ‘নিউজউইক’ পত্রিকা বক্স আইটেম হিসেবে শেখ হাসিনার সাক্ষাতকার প্রকাশ করে। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন তখন সময়টা খুব খারাপ ছিল। বলতে গেলে যে কোন সময় একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। খুনীরা যেন সব জায়গায় ওঁৎ পেতে আছে। শেখ হাসিনা সেসময় স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘তিনি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নন; এমনকি যে সরকারের মোকাবিলা করবেন তার শক্তিকে তিনি বাধা বলে গণ্য করবেন না। জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।” নিজের মনোবল কত দৃঢ় হলে এভাবে একজন মানুষ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে। হয়ত বাংলা বিভাগের সহপাঠী কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো বলে উঠেছেন, “১৯৭৫-এ আমি হারিয়েছি আমার প্রতীক,/ শৌর্যবীর্য ধারা অন্ধকারে। তারপর থেকে ভিতরে ভিতরে একা,/ গৃহহারা।” রাজনীতির আসল সত্যটি তিনি একেবারে শুরুতেই ধরতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি বলতে পারেন, ‘আমার রাজনীতি হচ্ছে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আমরা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করতে চাই, যেখানে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগণ এক মানবেতর জীবনযাপন করে।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পিতার মতো দরিদ্র নিপীড়িত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য সব সময় চিন্তা করেন। আশ্রায়ণ প্রকল্প, আদর্শ গ্রাম, গৃহায়ন তহবিল, ঘরে ফেরা কর্মসূচী তিনিই চালু করেছিলেন। এদেশে তিনি সর্ব প্রথম বয়স্ক ভাতা, দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা ও বিধবা ভাতা চালু করলেন। শেখ হাসিনা খুব ভাল করেই জানেন, এমন করে দেশের অর্থনীতি পরিচালনা করতে হবে যাতে করে গরিব মানুষের জীবন চলার খানিকটা স্বস্তি মেলে। তাই চাল, ডাল, তেল, নুনের দাম যেন হঠাৎ করে বেড়ে না যায়, সেদিকে তিনি সদাসচেতন থাকেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ভাল অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য সততা, দক্ষতা ও সদিচ্ছার কোন বিকল্প নেই। ১৯৯৭ সালের ৪ জুলাই জাপানের বিখ্যাত ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয় শেখ হাসিনাকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রী প্রদান করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন, তাহলে দেশের অবস্থার অনেক অনেক উন্নতি হতো। বিগত শাসনামলের শেষ দিনে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ১.৫৯ ভাগ। এটার ধারাবাহিকতা থাকত এবং অবশ্যই সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতো এবং অনেক আগেই জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ স্পর্শ করত। শেখ হাসিনা ভণিতা করেন না। যা কিছু বলেন সোজা-সাপটা বলেন। যে কারণে তাঁর বন্ধুভাগ্য ঈর্ষাযোগ্য, শত্রুভাগ্য শোচনীয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না জানি ... ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়।” শেখ হাসিনার বিশ্বাস দেশকে ভালবাসবার প্রথম লক্ষণ ও প্রথম কর্তব্য দেশকে জানা। মাত্র দু’তিন দিন আগে শেখ হাসিনা কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সবার আগে বাংলাদেশকে জানতে হবে’। শেখ হাসিনা বাংলার মানুষকে ভালবাসেন পিতা শেখ মুজিবের মতো করে। শেখ হাসিনা এখন বিশ্ব নেতৃত্বের সম্মান পেয়েছেন। তিনি বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে সাহসী ও সময় উপযোগী বক্তব্য রাখছেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি ) অর্জনে বিশেষ জাতিসংঘ পুরস্কার পাওয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। শিশু মৃত্যু হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য বাংলাদেশকে এই পুরস্কার দিয়েছে জাতিসংঘ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই এই পুরস্কার অর্জন করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই আজ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মস্থান কেনিয়ায় গিয়ে বলেছেন, ‘কেনিয়ার উচিত এখন বাংলাদেশকে অনুসরণ করা’। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে জন্মেছিলেন বলেই দেশের অনুন্নত জনপদ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধ্যুষিত ৫২টি উপজেলায় ১ হাজার ১৪০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১ হাজার ৬২৩টি ‘আনন্দ স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা বাঙালীর স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের এখন শব্দব্রহ্ম। লোকায়ত বাংলার ইহজাগতিকতার বীজমন্ত্র। শেখ হাসিনার এই জন্মদিনে মনে পড়ে প্রয়াত কবি ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতার লাইন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ।’ শেখ হাসিনার শতায়ু প্রার্থনা হোক বাংলার ঘরে ঘরে। ংাঁধংংরহমযড়@মসধরষ.পড়স
×