ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাতিসংঘ সদর দফতরে গোলটেবিল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য চাই দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য চাই দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিন্ন সমৃদ্ধি, টেকসই উন্নয়ন এবং সকলের জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা জোরদার করতে বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা স্থায়ীভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে। বিস্ফোরণোন্মুখ বৈশ্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সহিংস সন্ত্রাসবাদ দক্ষিণে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজ করছে। খবর বাসসর। শেখ হাসিনা বলেন, নতুন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) বিশেষ করে দক্ষিণের দেশগুলোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও, বিশ্বের দক্ষিণের দেশগুলো এখনও বৈষম্য, নিরক্ষরতা এবং অনুন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন গোলটেবিল আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন। এতে বাংলাদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, নেপাল, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ১৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ যোগ দেন এবং আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের দক্ষিণাংশের দেশগুলোর আকার, শক্তি ও উন্নয়নের পর্যায় ভিন্ন হলেও তাদের একটি অভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়টি মনে রেখে বাংলাদেশ চলতি বছরের শুরুতে ঢাকায় দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এতে দক্ষিণ-দক্ষিণ উদ্যোগে অর্থায়ন এবং দক্ষিণের মধ্যে প্রযুক্তি স্থানান্তরের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণে আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আন্তঃসীমান্ত ভৌত যোগাযোগ জোরদার এবং নতুন ধরনের বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা- জোরদার করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, এ লক্ষ্যে ব্রিকস ব্যাংক এবং এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক সুরক্ষা, দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই মৎস্য উৎপাদন এবং আইসিটি সুবিধা সম্প্রসারণে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে এসব অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে প্রস্তুত। আইপিআর পুনর্বিবেচনার আহ্বান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক টেকসই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (আইপিআর) ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ সদর দফতরে আয়োজিত টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত সংলাপ অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বলেছেন, বিদ্যমান বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি অধিকার (আইপিআর) ব্যবস্থা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন যাতে জনগণ কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রধান প্রযুক্তিগুলোর সুবিধা লাভ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিশেল সংলাপ অনুষ্ঠানে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের পাশাপাশি ‘ফস্টারিং সাস্টেইনেবল ইকোনমিক গ্রোথ এ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন এ্যান্ড প্রোমোটিং সাস্টেইনেবল কনসামপশন এ্যান্ড প্রডাকশন’ শীর্ষক এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ আলোচনাকালে আগামী ১৫ বছরে টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা (এসডিজি) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি গণমুখী ও ধরিত্রীবান্ধব এজেন্ডা এবং সকলের জন্য বিশেষ উন্নয়নের অঙ্গীকার গ্রহণ করায় তিনি উৎসাহিত হয়েছেন। তিনি বলেন, এখন আমাদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাগুলো আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের অনেক দেশের সম্পদের প্রয়োজন। একই সময়ে আমাদের অবশ্যই বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোর সমাধান করতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর সীমিত সম্পদ নিয়ে টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের কার্যকর ব্যবহার উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির সঙ্গে জীবনযাত্রার সমন্বয় ঘটানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভোগ হতে হবে ব্যক্তির ‘পছন্দ’ অনুযায়ী, যাতে বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অঙ্গীকারের প্রতিফলন থাকতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে, তৃণমূল পর্যায়ের লোকজনও উন্নয়নের সুফল পাবে। উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রযুক্তি জনজীবনে পণ্যের ও উৎপাদনে পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারী খাতে ও সুশীল সমাজের দায়িত্বশীল কর্মসূচী এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও দেশের মধ্যেকার ব্যবধান কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আফ্রিকা ইকোনমিক মিশনের নির্বাহী পরিচালক, কিরগিজস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্লোভাকিয়ার পরিবেশমন্ত্রী, আইএলও মহাপরিচালক, যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী, নোবেল বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী অন্যান্যের মধ্যে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বক্তারা এসডিজি বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের সামনে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরেন এবং অভিন্ন সমৃদ্ধির লক্ষ্যে টেকসই ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়ে তাদের সুপারিশ ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির ফলে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য পর্য়ায়ে হ্রাস পেয়েছে। তবুও বিশ্ব জনসংখ্যার ছয় ভাগের একভাগ এক শ’ কোটিরও বেশি মানুষ এখনও দারিদ্র্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে। তারা বলেন, সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান এবং মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য টেকসই ও বিশেষ উন্নয়ন জরুরী। তারা আরও বলেন, একটি উন্নতজীবনের জন্য প্রত্যেকেরই তাদের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের সুযোগ থাকা উচিত। বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসে চীনের আশ্বাস ॥ চীনের প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং বাংলাদেশের সঙ্গে তার দেশের ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শনিবার এখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মূল কর্মসূচীর ফাঁকে হোটেল ওয়ার্ল্ডফ এ্যাস্টোরিয়ায় এক গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ আশ্বাস দেন। এ সময় শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গড়ে তুলতে তার সরকারের ৭৭৪ একর জমি বরাদ্দ দেয়ার কথা জানান জিনপিংকে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফকালে বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির প্রশংসা করেন। তিনি বাংলাদেশকে চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার অংশীদার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের অন্যতম সেরা বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেন। জিনপিং দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ বছর পূর্তির কথা স্মরণ করে বলেন, ইতোমধ্যে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের অনেক সফর বিনিময় হয়েছে এবং আগামীতে আরও সফরের ব্যবস্থা হবে। তিনি বলেন, বাণিজ্য, অর্থনীতি ও শিক্ষা খাতে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ থেকে আরও পাটজাত পণ্য আমদানির আশ্বাস দেন। চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার করিডর নির্মাণে শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, এ উদ্যোগ এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে। উভয় নেতা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় দুই দেশের আরও প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে আশা প্রকাশ করেন যে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০তম বার্ষিকী দ্বিপক্ষীয় সার্বিক অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করবে। তিনি বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে কিছু প্রতিকার ও অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চীনের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী চীনের বাজারে আরও বেশি বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশের সুযোগ দেয়া ও ‘আপটা রুলস অব অরজিন’ শিথিল করতে চীনের প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও ডা. দীপু মনি এমপি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে মার্কিন কংগ্রেসের তিন সদস্যের এক প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে হোটেল ওয়ার্ল্ডফ এ্যাস্টোরিয়ায় দেখা করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেনÑ কংগ্রেসের ফরেন এ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য এলিয়ট এল এঙ্গেল, মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাশের কো-চেয়ার জোশেফ ক্রাউলি ও সদস্য কারোলিন ভি মেলোনি। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যরা দারিদ্র্য নিরসনে শেখ হাসিনার সরকার এবং তার নেতৃত্বে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তারা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতির প্রশংসা করেন এবং মিয়ানমারের উদ্বাস্তু সমস্যা সঠিকভাবে মোকাবেলার জন্য তাকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অন্যদের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
×