নিখিল মানখিন ॥ রাজধানীতে গত দশদিনে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর চলতি বছরে রাজধানীতে মারা গেছে ৪ জন ডেঙ্গু রোগী। গত জুন থেকে এ পর্যন্ত প্রতি মাসেই ক্রমান্বয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত দশ বছরে এ ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়নি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি মাসে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৩৭ জন। গত ১৯ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ৩৫৮ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টি থেমে গেলেও হঠাৎ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকোপ বেড়েই চলেছে। বৃষ্টি ও তাপমাত্রার বৃদ্ধি ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। দু’সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমেও গতি নেই। আর রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালে ডেঙ্গু জীবাণু শনাক্তের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকার অভিযোগও উঠেছে। এতে টাইফয়েড ও ডেঙ্গুর উপসর্গের পার্থক্য নির্ণয় করতে অনেকেই ভুল করছেন।
সেপ্টেম্বরেও রাজধানীতে রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৭৯৫ জন। চলতি মাসে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। আগস্টে প্রতিদিন গড়ে আক্রান্ত হয় ২১ জন করে। চলতি মাসে প্রতিদিন গড়ে আক্রান্তের সংখ্যা গত মাসের চেয়ে ৭ জন বেশি। এ বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ১৬৯০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বেসরকারী হিসেবে নগরীতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এ বছর গত চার মাস ধরে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ইতোমধ্যে বিশেষ সভা আহ্বান করে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এবং এ রোগে আক্রান্তের চিকিৎসার সুব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। তবে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় চিন্তামুক্ত থাকতে পারছে না নগরবাসী।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মুস্তাক হোসেন জানান, গত মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম চলছে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকছে। জমে থাকা পানিতেই জন্ম নিচ্ছে ডেঙ্গুর ভাইরাস। তাই বাড়ি বা বাড়ির আঙিনার কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। আগামী মাস নাগাদ ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে।
জানা গেছে, সম্প্রতি আইইডিসিআর থেকে ২৩টি টিম সরেজমিন বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল পরিদর্শন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর প্রকৃত সংখ্যা বের করেন। জ্বরে আক্রান্ত কোন রোগীর প্রকৃতপক্ষেই ডেঙ্গু হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে কী করতে হবে সে সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হয়। রাজধানীর মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি)। দুই সিটি কর্পোরেশনই বলছে, রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। নানা জায়গায় কয়েকদিন ধরে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করছে। ডিএনসিসির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বরাদ্দ রাখা হয় ১৪ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ডিএসসিসির এবারের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দ সাড়ে ১২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। মশক নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির কর্মী আছেন ২৭৯ জন এবং ডিএসসিসির কর্মীর সংখ্যা ২৮৪। মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত ওষুধ ছিটানোসহ নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকবল, সরঞ্জাম ও যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকার পরও মশা নিধন কার্যক্রমে কার্যকর ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। এই মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এটি সহজে প্রতিরোধ করা সম্ভব। আমরা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাচ্ছি। তবে বর্তমানে এ রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা উপযুক্ত চিকিৎসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর সুস্থ হয়ে উঠছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু জীবাণুর উৎস এখনও বন্ধ হয়নি। এ কারণে মৃত্যুর হার কমে গেলেও আক্রান্ত হওয়ার প্রকোপ কমছে না। ডেঙ্গুর উৎস বন্ধ না হলে ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ আরও জানান, নগরীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও হিমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা নাক ও দাঁত দিয়ে এবং কাশির সময় রক্তক্ষরণে ভুগে থাকে। আর আক্রান্তরা পিঠ, ঘাড়, মাথা ও চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা বলে থাকে। তিনি বলেন, ৪ থেকে ৫ দিনের মধ্যে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া কোন ওষুধ দেয়া ঠিক হবে না। রোগীকে বেশি মাত্রায় পানি বিশেষ করে শরবত খাওয়ানো যেতে পারে। দিনের বেলায় ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত। বাসায় খোলা পাত্রে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। বাসায় সর্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পরামর্শ দেন ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ।
আইইডিসিআর জানায়, রাজধানীতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে। মশক নিধন কার্যক্রমের স্থবিরতা, গাইডলাইনের অভাব এবং মানুষের অসচেতনতাই ডেঙ্গুর প্রকোপের জন্য দায়ী বলে মনে করছেন এ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও রোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরে গত মার্চে ২ জন, এপ্রিলে ২ জন, মে মাসে ১ জন, জুনে ১৫ জন, জুলাইয়ে ১৫৬ জন ও আগস্টে ৭২৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। আর চলতি মাসে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে মোট ৭৯৫ জন। সূত্রটি আরও জানায়, রাজধানীতে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন, মার্চে ৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মে মাসে ১২ জন, জুনে ৫০ জন, জুলাইয়ে ১৭২ জন, আগস্টে ৩৩৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৫ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ৫০১ জন। ২০১২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় ১২শ’ ৮৬ জন । আর গত ২০১১ সালে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই বছর জুনে ৬১ জন, জুলাইয়ে ২৫৫ জন, আগস্টে ৬৯১ জন, সেপ্টেম্বরে ১৯৩ জন এবং অক্টোবরে আক্রান্ত হয় ১২০ জন। আর এভাবে গত ২০১০ সালে ২৫৭ জন, ২০০৯ সালে ৪৭১ জন, ২০০৮ সালে ১১শ’ ৫১ জন এবং ২০০৭ সালে ৪৭১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। নগরীর সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে অনেক ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। সারাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা জানে না সরকার। কিন্তু হাসপাতাল-ক্লিনিক ছাড়াও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেঙ্গু রোগীর আগমন বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম চালু নেই। পানি মেশানো ওষুধ ছিটানোর মাধ্যমেই নিজেদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখছে ডিসিসি। মশক নিধন কার্যক্রমের বরাদ্দ নিয়ে লুটপাটের খেলা চলে। বাড়তি টাকা না দিলে কোন বাসা বা এলাকায় ওষুধ ছিটায় না ডিসিসির কর্মীরা। ডিসিসির এই বিভাগের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোন যোগাযোগ থাকে না। ডিসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে এ কার্যক্রম চালিত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক মশক নিধন কার্যক্রম ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রমের মধ্যে তারা কোন পার্থক্য দেখে না। ফলে এডিস মশা নিধনে তারা বিশেষ সফলতা পায় না। আর ডিসিসির অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার দায়ভার গিয়ে পড়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওপর বলে অভিযোগ করেছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা।