ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাকা ও মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করল আপীল বিভাগ

ফাঁসির শেষ ধাপে

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১ অক্টোবর ২০১৫

ফাঁসির শেষ ধাপে

বিকাশ দত্ত/আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতা-বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছে আপীল বিভাগ। এর মধ্য দিয়ে তাদের দ- কার্যকরের প্রক্রিয়া আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের আপীল বিভাগের কোন মামলায় এক সঙ্গে দুই আসামির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো। এ দু’জনই বিএনপি-জামায়াত জোটের মন্ত্রী ছিলেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ ১৬ জুন মুজাহিদ আর ২৯ জুলাই সাকার রায় ঘোষণা করে। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ১০৭ দিনের মাথায় মুজাহিদ ও ৬৪ দিনের মাথায় সাকার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলো। দুই রায়েই ট্রাইব্যুনালের দেয়া সর্বোচ্চ সাজার দণ্ড বহাল রয়েছে। বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর সুপ্রীমকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা বুধবার রায় দুটি প্রকাশ করে। এর মধ্যে মুজাহিদের রায় ১৯১ এবং সাকা চৌধুরীর রায় ২১৭ পৃষ্ঠার। মুজাহিদের মৃত্যুদন্ডের পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন আপীল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং সাকা চৌধুরীর রায়টি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই লিখেছেন। বেঞ্চে অন্য বিচারপতিরা তাদের লেখা রায়ে একমত পোষণ করেছেন। মুজাহিদের রায়ের পর্যবেক্ষণ ॥ মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর নেতা ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তার কর্মকাণ্ড ও আচরণ সংক্রান্ত সাক্ষ্য প্রমাণে একথাই প্রমাণিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের গণরায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। আর এই কারণেই মুজাহিদ ও ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য আলবদর বাহিনী গঠন করে। এর পর তারা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। এক পর্যায়ে আলবদর বাহিনী দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের অপহরণ ও হত্যা শুরু করে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ও পরে আপীলকারীর (মুজাহিদ) কর্মকা- সেই সঙ্গে মৌখিক ও দালিলিক প্রমাণাদি পর্যালোচনা করার পর এ বিষয়ে কোন দ্বিধা থাকার কারণ নেই, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজাহিদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেছে। রায়ে আদালত আরও বলে, এটা এতটাই নৃশংস যে, গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হিটলার যেভাবে হত্যাকা- চালিয়েছিল তাকেও হার মানায়। ওই সময় আলবদর বাহিনীর ওইসব নৃশংসতা সারা বিশ্বই প্রত্যক্ষ করেছে। সুপ্রীমকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনী দেশের বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করেছে। আলবদর বাহিনী যেসব কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে তা ছিল পরিকল্পিত। রায়ে আদালত বলে, আলবদর বাহিনীর এসব কর্মকান্ডের কারণে আমরা ট্রাইব্যুনালের (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) সিদ্ধান্তের বাইরে অন্য কোন সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারি না। আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে সংঘটিত অপরাধ বিবেচনা করে ন্যায়বিচার করা। আদালত বলে, মানুষ যেমন হিরোসিমা এবং নাগাসাকিকে ভুলতে পারেনি, তেমনি এই জাতি কখনোই ১৯৭১ সালকেও ভুলতে পারবে না। সাকার রায়ের পর্যবেক্ষণ ॥ অন্যদিকে সাকার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সাকা চৌধুরী ঠা-া মাথায় হত্যাকা- ঘটিয়েছেন। তিনি নিজে হত্যাকা- ঘটিয়েছেন আবার হত্যাকান্ডে সহায়তাও করেছেন। আদালতের প্রতি তার কোন সম্মান ছিল না। দেশের জ্ঞানী দার্শনিক লোকদেরকে ঠান্ডা মাথায় তিনি হত্যা করেছেন, গুম করেছেন। সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেছেন এবং ট্রাইব্যুনালের প্রতি উগ্র আচরণ প্রদর্শন করেছেন। তাকে সতর্ক করা সত্ত্বেও ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলাকালে নানা দম্ভোক্তি করেছেন। সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের প্রতি কোন সম্মান প্রদর্শন করেননি। তার এই উগ্র আচরণ এবং ’৭১ এর তার গণহত্যা, নৃশংসতা বিবেচনায় নিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তার এই মৃত্যুদ- তার অপরাধের তুলনায় যথেষ্ট। তার প্রতি কোন দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত সাকা চৌধুরী একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে দিতে অপরাধ কর্মে সরাসরি অংশ নিয়েছে। আপীল বিভাগের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, মানবসভ্যতায় যত ধরনের অপরাধ রয়েছে তার ভেতরে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যা অত্যন্ত ঘৃণ্য। এই অপরাধকে সভ্যতার সবচেয়ে নৃশংস এবং বেদনাদায়ক ভয়ঙ্কর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা ও বীভৎসতার সঙ্গে এই ধরনের অপরাধ করেছে। আদালত রায়ে আরও বলে, সে (সাকা) সাধারণ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে এবং নির্যাতন করেছে। দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তা করতে সে নিজে নিরপরাধ মানুষকে গুম করেছে এবং গুমে সহায়তা করেছে। সাকা চৌধুরী জনগণের সম্পত্তি লুটপাট নিজে করেছে এবং সহায়তা করেছে। সুপ্রীমকোর্ট রায়ে আরও বলে, সাকা চৌধুরী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নীলনক্সা অনুসরণ করে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এ সব হত্যাকা- ঘটিয়েছে। সাকা চৌধুরী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত সাধারণ মানুষকে হত্যা, নির্যাতন এবং গুম করেছে। মৃত্যুদন্ডের শাস্তি দেয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত মামলা। সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদন্ডের চেয়েও কম শাস্তি দেয়ার কোন উপায় আমরা খুঁজে পাইনি। রাষ্ট্র বসে থাকবে না ॥ এদিকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকেই ১৫ দিনের মধ্যে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে পারবেন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী। রাষ্ট্র এ রিভিউ আবেদনের জন্য বসে থাকবে না, দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে আসামিরা রিভিউ করলে দণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থগিত হয়ে যাবে। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী শিশির মনির বলেছেন, আমরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পেলেই ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করব। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বুধবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, “রায়ের কপি নেমেছে। আমরা আজই (বুধবার) তা ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর চেষ্টা করব। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক জনকণ্ঠকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বলেন, এখনও পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাইনি। আমরা ট্রাইব্যুনালেই অবস্থান করছি। রায়ের কপি পেলেই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অন্যদিকে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন রায় প্রকাশের পরেই বলেছেন, তারা রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন। তবে রায় প্রকাশের দিন থেকে নয়, পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর থেকে ১৫ দিন সময় পাবেন বলে দাবি তার। নিয়ম অনুযায়ী এই রায়ের অনুলিপি হাতে পেলে এবং মৃত্যু পরোয়ানা জারির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই সরকার সাজা কার্যকরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। আসামি পক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে। আপীল বিভাগের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হাতে পাওয়ার পর বিচারিক আদালত (ট্রাইব্যুনাল) কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠাবে। এরপর আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারবেন। তিনি স্বজনদের সঙ্গে দেখাও করতে পারবেন। ওই মৃত্যু পরোয়ানার ভিত্তিতেই সরকারের তত্ত্বাবধানে কারা কর্তৃপক্ষ সাজা কার্যকরের প্রস্তুতি নেবে। তবে রিভিউ আবেদন হলে তার নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। যে মামলা নিষ্পত্তি ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এ পর্যন্ত ৫টি মামলার আপীল নিষ্পত্তি হলো। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হলে ওই বছর ১২ ডিসেম্বর দণ্ড কার্যকর করা হয়। ঠিক এক বছর পর আপীলের দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদ- দেয় আপীল বিভাগ। তবে সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত না হওয়ায় রিভিউ নিষ্পত্তি হয়নি। ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর আপীল বিভাগ তৃতীয় রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বোচ্চ সাজা দিলে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মুজাহিদ ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্র্তৃক মৃত্যুদ-াদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলবদর কমান্ডার বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টার মাইন্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপীল খারিজ করে ১৬ জুন মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে পিনপতন নীরবতার মধ্যে সংক্ষিপ্তাকারে মাত্র দুই মিনিটে এ রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বুদ্ধিজীবী হত্যায় এটাই আপীল বিভাগের প্রথম রায়। উল্লেখ্য, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -২ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এই প্রথম বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোন ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে উচ্চ আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখল। আপীল বিভাগ রায়ে অভিযোগ-১ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে আসামি মুজাহিদকে খালাস দিয়েছে। অভিযোগ-২ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৫ বছরের সাজা বহাল রেখেছে। অভিযোগ-৫ এ বদি রুমিসহ অন্যদের হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বহাল রেখেছে। অভিযোগ -৬ ট্রাইব্যুনালের দেয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। অন্যদিকে অভিযোগ-৭ এ বকচর হত্যাকান্ডে ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ (২ ও ৪) প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগের দায় থেকে তাকে খালাস দেয়। অন্যদিকে ৫টি অভিযোগ (১, ৩, ৫, ৬, ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ৩নং অভিযোগ ৫ বছর ও ৫ নং অভিযোগ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। ৬ ও ৭ নং অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ১ নং অভিযোগটি ৬নং অভিযোগের সঙ্গে একীভূত করায় ১ নং অভিযোগে পৃথক কোন দণ্ড দেয়নি ট্রাইব্যুনাল। বুদ্ধিজীবী হত্যায় মৃত্যুদণ্ড বহাল ॥ আপীল বিভাগ মুজাহিদের আপীল খারিজ করে ৬ নম্বর অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছে। ৬ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীতে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারাও ওই স্থানে ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালায়। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আসামি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধন অভিযানসহ সারা বাংলাদেশের দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদিসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা সংঘটিত করেন। যে অভিযোগ খালাস ॥ এক নম্বর অভিযোগে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে হত্যার দায় থেকে আপীল মামলার রায়ে খালাস পেয়েছেন মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছিল। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর চামেলীবাগ থেকে ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। আসামির পরিচালনাধীন ও নিয়ন্ত্রণাধীন ৭-৮ যুবক তাকে ধরে মিনিবাসে তুলে নেয়। আজ অবধি তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ॥ সাত নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার দায়ে মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। সাত নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। শান্তি কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বকচর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হামালা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রী, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র ও উপেন সাহাকে আটক করা হয়। উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকা দিয়ে তার স্বামীর মুক্তি চান। রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। পরে আটক হিন্দু নাগরিকদের গণহত্যা করে। তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। অনিল সাহাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। আলাদা করে রায় ॥ এক নম্বর অভিযোগকে ৬-এর সঙ্গে সংযুক্ত করে এ দু’টি অভিযোগে সমন্বিতভাবে ও ৭ নম্বর অভিযোগে মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। আপীল বিভাগ ১ ও ৬ নম্বর অভিযোগকে আলাদা করেই চূড়ান্ত রায়টি দিল। যে দণ্ড বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ ॥ পাঁচ নম্বর অভিযোগে ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন এবং ৩ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক ও নির্যাতনের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয় ট্রাইব্যুনাল থেকে। প্রমাণিত না হওয়া ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে খালাস পান মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে একমত হয়ে এ চার অভিযোগের দণ্ড বহাল রেখেছে আপীল বিভাগ। প্রমাণিত না হওয়া ২ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানার বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যার অভিযোগ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার মোঃ আবু ইউসুফ পাখিকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম ॥ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় একই বছরের ২১ জুলাই। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন মোঃ আব্দুর রাজ্জাক খান। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট গ্রেফতার দেখানো হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ ২০১১ সালের ৩০ নবেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। একই বছরের ৫ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের আবেদন করা হয়। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি মুজাহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয়া হয়। ২০১২ সালের ২৫ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ২-এ স্থানান্তর করা হয়। ২০১৩ সালের ৬ মে প্রসিকিউশন পক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। পরে একই বছরের ২২ মে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৩ সালের ৫ জুন রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়। সিএভি রাখার ৪৩ দিনের মাথায় ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় প্রদান করা হয়। আপীল কার্যক্রম ॥ ১৮ মে রাষ্ট্রপক্ষে আংশিক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল এবং ৪, ৫, ৬, ১৭ ও ১৮ মে আপীলের পেপারবুক পড়া শেষ করেন মুজাহিদের আইনজীবী। গত ১৫ এপ্রিল আপীল বিভাগ আপীলের ওপর শুনানির জন্য ২৮ এপ্রিল দিন ধার্য করে। তবে ওই দিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে সাধারণ ছুটি থাকায় শুনানি হয়নি। প্রায় ২১ মাস পর ২৯ এপ্রিল আপীলের ওপর শুনানি শুুরু হয়। এরপর ৪, ৫, ৬ ও ১৭, ১৮, ২৫, ২৬ ও ২৭ মে শুনানি গ্রহণ করে আদালত। ২৭ মে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণার জন্য ১৬ জুন দিন নির্ধারণ করা হয়। সবশেষে ১৬ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রদান করে। সাকা চৌধুরী ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্র্তৃক হত্যা ও গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বিএনপির শীর্ষ নেতা সাকা বাহিনীর (নিজস্ব বাহিনী) প্রধান স্বঘোষিত ব্রিগেডিয়ার সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে ২৯ জুলাই ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃতুদ- বহাল রাখে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপীল বেঞ্চ বুধবার এই ঐতিহাসিক মামলার রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ৭ নম্বর অভিযোগ থেকে আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেয়া হলো। ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে সাজা বহাল রাখা হলো। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি প্রমাণিত হয়। ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে সাকাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। আপীল বিভাগ তা বহাল রাখে। ৭ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এই অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দিয়েছে আপীল বিভাগ। ২ ও ৪ নম্বর অভিযোগে সাকাকে ট্রাইব্যুনাল ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। সেটা আপীল বিভাগ বহাল রেখেছে। অন্যদিকে, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে সাকাকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। আপীল বিভাগ সেটাও বহাল রেখেছে। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সাকা চৌধুরীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ৯টিতে সাকা চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর যে সকল অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ১, ১০, ১১, ১২, ১৪, ১৯, ২০ ও ২৩নং অভিযোগ। এছাড়াও প্রসিকিউশন পক্ষ সাক্ষী না দেয়াতে যে অভিযোগগুলো নিয়ে আদালত কিছু বলেনি সেগুলো হলো- ৯, ১৩, ১৫, ১৬, ২১ ও ২২নং অভিযোগ। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সাকা চৌধুরী ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবার সুপ্রীমকোর্টে আপীল দায়ের করেন। মামলার ধারাবাহিকতা ॥ সাকা চৌধুরীর মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুট ও দেশান্তরে বাধ্য করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৩টি অভিযোগের মধ্যে ১৭টিতে সাক্ষ্য ও যুক্তি উপস্থাপন করেছে প্রসিকিউশন। ২০১১ সালের ১৪ নবেম্বর সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। একই বছরের ১৮ নবেম্বর আনুষ্ঠানিক এ অভিযোগ আমলে নিয়ে ২৩টি অভিযোগে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ১৪ মে প্রসিকিউশনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে গত ২৮ জুলাই শেষ হয়। প্রসিকিউশনের ৪১ জন এবং আসামিপক্ষে চারজনের জবানবন্দী নেয়া হয়। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল। ২৯ অক্টোবার ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সাকা আপীল করেন। অবশেষে ১৩ কার্যদিবস শুনানি শেষে ৭ জুলাই আপীল বিভাগ রায ঘোষণার জন্য ২৯ জুলাই দিন নির্ধারণ করে। ২০১০ সালের ২৬ জুন হরতালের আগের রাতে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক দেখানো হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকার বিরুদ্ধে মোট ৪১ জন সাক্ষী তাদের সাক্ষ্য প্রদান করেন। অন্যদিকে, সাকা চৌধুরী নিজেসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দিয়েছেন।
×