ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলজ উদ্ভিদ শাপলা

খাদ্য হিসেবে বেশ কদর, দেদার বিক্রি হাটবাজারে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১ অক্টোবর ২০১৫

খাদ্য হিসেবে বেশ কদর, দেদার বিক্রি হাটবাজারে

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ হৃদয়ছোঁয়া সৌন্দর্যের প্রতীক জলজ উদ্ভিদ ‘শাপলা’। সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদায় ভূষিত। গ্রামবাংলার মানুষের অতি পরিচিত নাম শাপলা। গ্রামাঞ্চলের হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল, পুকুর, জলাভূমি ও ডুবন্ত কৃষিজমিতে জন্মায় শাপলা ফুল। কিন্তু ব্যাপকহারে হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল, নিচু জমি, পুকুর, জলাভূমি ভরাট করে ফেলায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী শাপলা ফুল। বর্ষাকালে প্রত্যন্ত গ্রামে তারার মতো ছড়িয়ে পড়ে শাপলা। দেখতে অপরূপ, ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। শাপলা ফুলের অপার দৃশ্য দেখতে কার না ভাল লাগে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, আড়াইহাজার, রূপগঞ্জ ও বন্দর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিল-ঝিল, নিচু জমি ও পুকুরসহ বিভন্ন জলাভূমিতে বর্ষা মৌসুমে জন্মায় শাপলা ফুল। কিন্তু দিন দিন হাউজিং ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি। ফলে শাপলা জন্মনোর স্থানও দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অন্তত নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে এটি। এখানে প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে শাপলা ফুল। বর্ষাকাল থেকে শরতকাল পর্যন্ত শাপলা ফুল ফোটে। শাপলা ফুল নানা রঙের হয়। সাদা, গোলাপী, নীল, বেগুনি রঙের শাপলা ফুল বাংলাদেশে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সাদা শাপলার সংখ্যাই বেশি। শাপলা জাতীয় ফুল, এটাই শেষ নয়। মানুষের খাদ্য হিসেবেও শাপলার কদর রয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা ও শরতকালে হাট-বাজারে বিক্রি হয় শাপলা ফুল। শিশু-কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন মনের আনন্দে বিল, হাওড়-বাঁওড় ও জলাশয় থেকে নৌকা দিয়ে কিংবা পানিতে নেমে শাপলা ফুল তুলে আনছে। তা জীবিকার তাগিদে বিক্রি করছে। মৌসুমি শাপলা বিক্রেতারা ভ্যান কিংবা অন্য কোন যানবাহনে করে বিভিন্ন বাজারে নিয়ে আঁটি বেঁধে বিক্রি করছে শাপলা। শাপলা বিক্রির দৃশ্য এখন হরহামেশাই বাজারগুলোতে চোখে পড়ছে। বিশেষ করে শাপলার কা- বা ডাঁটা সবজি হিসেবে লোকজন আনন্দবোধ করে খেয়ে যাচ্ছে। শাপলা ফুল দিনের বেলা ফোটে এবং সরাসরি কা- ও মূলের সঙ্গে যুক্ত থাকে। শাপলার পাতা আর ফুলের কা- বা ডাঁটা বা পুষ্পদ- পানির নিচে মূলের সঙ্গে যুক্ত থাকে। আর এই মূল যুক্ত থাকে মাটির সঙ্গে এবং পাতা পানির উপর ভেসে থাকে। মূল থেকেই নতুন পাতা জন্ম নেয়। পাতাগুলো গোল এবং সবুজ রঙের হয় কিন্তু নিচের দিকে কালো রঙ। ভাসমান পাতাগুলোর চারদিক ধারালো হয়। পাতার সাইজ ২০ থেকে ২৩ সেন্টিমিটার এবং এদের ব্যাপ্তি প্রায় ০.৯ থেকে ১.৮ মিটার। শাপলা ফুলে ৪ থেকে ৫টি বৃত্ত থাকে ও ১৩ থেকে ১৫টি পাপড়ি থাকে। ফুলগুলো দেখতে তারার মতো মনে হয়। কাপের সমান বৃত্তগুলো ১১-১৪ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। বছরের প্রায় সব সময় শাপলা ফুটতে দেখা যায়। তবে বর্ষা ও শরত ঋতুতে এই উদ্ভিদ জন্মানোর শ্রেষ্ঠ সময়। শাপলা ফুল অনেক রঙের হলেও কেবল সাদা শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুলের মর্যাদা পেয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশের পয়সা, টাকা, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জাতীয় ফুল শাপলা বা এর জলছাপ আঁকা রয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় বিষেশজ্ঞরা দেখেছেন এই উদ্ভিদে ডায়াবেটিস রোগের জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধি গুণাগুণ রয়েছে। এই উদ্ভিদ পানি থেকে তুলে রোদে শুকিয়ে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার পাঁচানী গ্রামের বাসিন্দা আলী আকবর (৪২)। তিনি এখন শাপলা বিক্রেতা। গত দেড় মাস ধরে বিভিন্ন বাজারে শাপলা ফুল বিক্রি করছেন। তিনি সোনারগাঁওয়ের বাংলাবাজার থেকে শাপলা কিনে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করছেন। তিনি জানান, বিকেল হলেই শিশু-কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী লোকজন বিল-ঝিল ও জলাশয় থেকে নৌকা দিয়ে কিংবা পানিতে নেমে শাপলা ফুল তুলে আনছে। পাইকাররা তাদের কাছ থেকে শাপলা ফুল স্বল্প দামে কিনে বিভিন্ন হাট-বাজারে সবজি হিসেবে বিক্রি করছেন। আলী আকবর জানান, এক আঁটি শাপলা (২৫-৩০টি শাপলা) ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হয়। তিটি অকপটে স্বীকার করেন, এক আঁটি শাপলা তিনি পাঁচ টাকা করে কিনে এনেছেন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত লোকজন শাপলার প্রধান ক্রেতা। তবে উচ্চবিত্ত লোকজনও শখের বশে শাপলা নিয়ে সবজি হিসেবে রান্না করে খাচ্ছে। শাপলা ভাজি করে খাওয়া যায়। এছাড়াও তরকারিতেও শাপলার কা- বা ডাঁটা ব্যবহার করা হয়। তিনি জানান, দিন দিন যে হারে নিচু জমি ও জলাশয় ভরাট করে হাউজিং ব্যবসায়ী প্লট তৈরি করছে তাতে এ সকল গ্রাম থেকে দিন দিন শাপলা ফুল হারিয়ে যেতে বসেছে। একই থানার নোয়াপুর এলাকার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জাহিদ জানান, কাকডাকা ভোরে গিয়ে শাপলা পাইকারি কিনে আনতে হয়। তিনি প্রতিদিন ২-৩ হাজার টাকার শাপলা কিনে এনে হাট-বাজারে সবজি হিসেবে বিক্রি করছেন। এতে তার অর্ধেকের বেশি লাভ হয়। তিনি জানান, বিশেষ করে দেড় থেকে দুই মাস শাপলা বিক্রি হয় বেশি। বর্ষার শেষদিকে পূর্ণাঙ্গ শাপলা পাওয়া যায় বেশি। পানি কমে গেলে আর শাপলা তেমন পাওয়া যায় না। জাহিদ জানান, শাপলার কা- বা ডাঁটা দিয়ে সাধারণ চিংড়ি কিংবা ইলিশ মাছ দিয়ে রান্না করলে বেশি সুস্বাদু হয়। তিনি আরও জানান, জলাশয় থেকে শাপলা তুলে তা বিক্রি করছে বহু লোকজন। শাপলা বিক্রির আয় দিয়ে বহু পরিবার দেড় থেকে দু’মাস জীবনধারণ করে থাকে। তার আপেক্ষ, হাউজিং ব্যবসায়ীরা যেভাবে নিচু জমি ও জলাশয় ভরাট করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করছে তাতে এসব এলাকায় একটি জলাশয়ও থাকবে না। ফলে শাপলার জন্মনোর জায়গার অভাবে দিন দিন বিলীন হয়ে যাবে শাপলা। হয়ত একদিন এখানে আর শাপলা নামক কোন জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
×