ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পর্যটকদের অতি প্রিয় ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১ অক্টোবর ২০১৫

পর্যটকদের অতি প্রিয় ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক

শাহীন রহমান, ডুলাহাজরা, কক্সবাজার থেকে ফিরে ॥ চারদিকে স্থায়ী বেষ্টনী। মাঝখানে ৯শ’ হেক্টর এলাকা নিয়ে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। যেখানে রয়েছে দেশী বিদেশী বন্য প্রাণীর বংশবৃদ্ধি ও অবাধ বিচরণের সুযোগ। পর্যটকরাও বনাঞ্চলের ভেতরে চলমান যানবাহনে অথবা হেঁটে ভ্রমণ করে একই সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে চিত্তবিনোদন ও নানা প্রকার বন্যপ্রাণীর সাক্ষাত লাভ করতে পারেন। এটি আপাতদৃষ্টিতে চিড়িয়াখানা মনে হলেও চিড়িয়াখানার ধারণা থেকে ভিন্নতর সাফারি পার্ক। নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। যেখানে পার্কের বন্যপ্রাণীরা উন্মুক্ত অবস্থায় আপন মনে অবাধে বনজঙ্গলে বিচরণ করছে। আর মানুষ সতর্কতার সঙ্গে সেসব জীবজন্তু পরিদর্শন করছেন। সাফারি পার্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চিড়িয়াখানায় সাধারণত জীবজন্তু আবদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়। আর দর্শনার্থীরা মুক্ত অবস্থায় আবদ্ধ জীবজন্তু পরিদর্শন করেন। কিন্তু সাফারি পার্কের এই ধারণা চিড়িয়াখানা থেকে ভিন্নতর। যেখানে জীবজন্তু মুক্ত অবস্থায় চলাফেরা করে। আর মানুষকে আবদ্ধ থেকে সতর্ক অবস্থায় বন্য জীবজন্তু পরিদর্শন করতে হয়। দেশের অন্যতম পরিবেশবান্ধব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটি উঁচু নিচু টিলার চিরসবুজ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়নের জন্য শিক্ষা গবেষণা, ইকোটুরিজম ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ১৯৯৮-৯৯ সালে যাত্রা শুরু করে। কক্সবাজার জেলার ডুলাহাজরা বনাঞ্চলের ডুলাহাজরা ও হারগাজা ব্লকের ৯শ’ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে এ সাফারি পার্কটি অবস্থিত। চট্টগ্রাম জেলা শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্বপাশে চকোরিয়া উপজেলা সদর হতে মাত্র ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে সাফারি পার্কটি স্থাপন করা হয়েছে। বনবিভাগ জানায়, এক সময় এই ডুলাহাজরায় গগনচুম্বী গর্জন, বৈলাম, তেলসুর, সিভিট, চাপালিশ, চম্পা ফুল, লতাগুল্মরাজির চিরসবুজ এই বনাঞ্চলে দেখা মিলত হাতি, বাঘ, হরিণ, ভল্লুক, বানরসহ অসংখ্য প্রজাতি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এবং অবৈধ শিকারের ফলে এ বনাঞ্চলের অসংখ্য বন্যপ্রাণী প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে এসব বন্যপ্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশ, খাদ্যচক্র ও জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের অস্তিত্বের জন্য বন্যপ্রাণীর ভূমিকা অপরিসীম। এ গুরুত্ব বিবেচনা করেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে সাফারি পার্কের। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য এই সাফারি পার্কে স্থাপন করা হয়েছে প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, পর্যটকদের জন্য বিশ্রামাগার, সাফারি পার্ক ভ্রমণের জন্য রয়েছে বাস। জীবজন্তুর চিকিৎসার জন্য রয়েছে পশুহাসপাতাল, পশু খাদ্য ও বিরল প্রজাতির বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। পশুর চারণভূমির উন্নয়নের জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কুমির বেষ্টনীতে স্থাপন করা হয়েছে ওয়াচ স্টেজ। বিচরণরত পশুপাখির জন্য তৈরি করা হয়েছে এনিম্যাল ফিডিং স্পট। এছাড়া পাখিশালা নির্মাণ, বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় এশীয় ও আফ্রিকান গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণীও সংগ্রহ করা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে পর্যটন টাওয়ার, ৬০ হেক্টর বানাঞ্চল নিয়ে বাঘ, ৪০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে সিংহ, ৫০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে সাম্বার, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, গয়াল ও অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর জন্য বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বন্য প্রাণীর জন্য ৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে আটটি জলাধার, ২০ হেক্টর এলাকা নিয়ে ভল্লুকের বেষ্টনী, ১০ হেক্টর এলাকা নিয়ে কুমিরের বেষ্টনী, ৫ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে জলহস্তীর বেষ্টনী এবং ১৫০ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে হাতির বেষ্টনী। বনবিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে রক্ষিত বন্যপ্রাণীর মোট সংখ্যা ৩৬২। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে ১৪৯, সরীসৃপ ১৫২ ও পাখি প্রজাতির সংখ্যা রয়েছে ৬১। স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে বাঘ, সিংহ, হাতি, মায়া হরিণ, প্যারা হরিণ, বন্যশূকর, খরগোশ, হনুমান, বাঁশ ভালুক, বনগরু বা গয়াল, বাঘদাসা, বনবিড়াল, মার্বেল বিড়াল, চিতাবিড়াল, বনরুই, সজারু, বাদুর, লজ্জাবতী বানর, আসামি বানর, উল্লুক, কালো ভালুক, সাম্বার, শিয়াল, মেছোবাঘ, জলহস্তীসহ বিচিত্র সব পশু পাখি রয়েছে। এখানে পর্যটকদের জন্য বন্যপ্রাণী দর্শনে রয়েছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। পার্কের ভেতরে বিচরণরত বাঘ সিংহ, হাতিসহ বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণের জন্য একাধিক টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। সাফারি পার্কের অভ্যন্তরে নির্মিত জলাধারসমূহে প্রতিবছর অসংখ্য অতিথি পাখি অবস্থান করে থাকে। যা পর্যটকদের আনন্দ দেয়। বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ হাতিবেষ্টনীতে যে কোন পর্যটক হাতিতে চড়ে বা দেখে আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। বনের ভেতরে ২ কিলোমিটার পাকা রাস্তা দিয়ে প্রটেক্টেড মিনিবাসে চড়ে অতিক্রম করার সময় দেখা মিলবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ করা বাঘ ও সিংহ। সাফারি পার্কের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে দেশের সর্বপ্রথম প্রকৃতিবীক্ষণকেন্দ্র। পার্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় সব ধরনের বনাঞ্চলের গাছপালা ও বন্য প্রাণীর মডেল, ম্যুরাল ও স্টাফিং তৈরি করে আলো ও শব্দ প্রবাহের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও বনাঞ্চল সম্পর্কে দর্শকদের সম্যক ধারণা প্রদান করা হয়। প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্রে প্রায় ১শ’ ধরনের বন্যপ্রাণী ও অসংখ্য গাছপালার মডেল ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ১২ মিনিটের দীর্ঘ একটি অডিও ভিস্যুয়াল প্রোগ্রামের মাধ্যমে দর্শকরা আনন্দ লাভ করতে পারেন। এছাড়াও ন্যারাচাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে ২ হাজার প্রাণীর দেহাবশেষ, স্পেসিমেন ও স্টাফিং সংগ্রহ করে মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে। ৩শ’ প্রজাতির গাছপালার হারবেরিয়াম সিট তৈরি করে মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করা হয়েছে। এ মিউজিয়াম থেকে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা বিপদাপন্ন ও বিলুপ্ত প্রায় বন্যপ্রাণী সম্পর্কে ধারণা লাভ করতেও সক্ষম হবে।
×