ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অঞ্জন আচার্য

সংগ্রামী এক ঋদ্ধ জীবনের কথা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২ অক্টোবর ২০১৫

সংগ্রামী এক ঋদ্ধ জীবনের কথা

একাধারে তিনি শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক। ছিলেন ভাষা আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক। ১৯৩২ সালের ১ অক্টোবর রংপুর শহরের মুনশীপাড়ার অলিবাগের দাদা বাড়িতে জন্ম তাঁর। সালটা মূলত স্কুল সার্টিফিকেটের। আদতে ১৯৩১ সালেই জন্ম মোতাহার হোসেন সুফীর। স্কুলে ভর্তির সময় মা মজিদা হোসেন তাঁর বয়স এক বছর কমিয়ে রাখতে বলেন। দাদা ছিলেন আইনজীবী। বাবা মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন মোক্তার। এছাড়াও বাবা ছিলেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের গবর্নিংবডির সদস্য। তাঁর সময়ই কারমাইল কলেজ রূপান্তরিত হয় সরকারী কলেজে। প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় গঠনমূলক কাজ করতে হয়েছিল তাঁকেই। তিন ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে মোতাহারের অবস্থান চতুর্থ। শিক্ষা-জীবন বাড়ির পাশের মুনশীপাড়া পাঠশালাতে শিক্ষা গ্রহণ শুরু মোতাহারের। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর ভর্তি হন তিনি রংপুর মাইনর স্কুলে। তৃতীয় শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই পাঠগ্রহণ করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন রংপুর জিলা স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। তবে রাজনৈতিক কারণে একটানা লেখাপড়া হয়নি সেখানে। সেজন্য আসতে হয়েছে ঢাকায়। ঢাকাতে এসে ভর্তি হতে হয়েছে তাঁকে জগন্নাথ কলেজে। ওই সময় রাজনীতিবিদদের জন্য সব কলেজে ভর্তি হওয়া সহজ ছিল না। ফলে জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে বিএ পাস করেন মোতাহার। অনার্স ছিল না। তারপরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সমস্যা হয়নি কোন। কারণ বিএ-তে ছিল তাঁর দ্বিতীয় বিভাগ। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করে তিনি প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। রাজনৈতিক জীবন কারমাইকেল কলেজ সেসময় ছিল প্রাইভেট কলেজ। ১৯৬৩ সালের ১ জানুয়ারি কলেজটি সরকারীকরণ করা হয়। এর আগে ওই কলেজে পড়াকালেই ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসা হয় তাঁর। ওই আদর্শ তাঁকে খুবই প্রভাবিত করে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় পার্টির কমরেড সেক্রেটারি তাঁকে ছাত্রফ্রন্টে কাজ করার নির্দেশ দেন। শুরু হয় ভাষা আদায়ের লড়াই। আরেক সহকর্মী কাজী আবদুল হালিমের ওপর আদেশ হয় তাঁকে যুবফ্রন্টে কাজ করার। পার্টির নির্দেশে ছাত্রদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে মোতাহারকেই। মূলত ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্ররাই ছিল সংখ্যায় বেশি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশ ছিল তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে না। সেটা জেলা পর্যায়েও নির্দেশ ছিল। সেসময়ের স্মৃতিচারণ করে মোতাহার হোসেন সুফী বলেন- ‘আমরা যখন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থকরা এগিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ ছিল প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল আর কমিউনিস্ট পার্টি ছিল নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ থাকার কারণে পার্টির তরফ থেকে বলা হয়েছিল, তোমরা যার যার জেলা পর্যায়েই কাজ করো। ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। বাড়িতে পুলিশ আসে। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে সে যাত্রায় গ্রেফতার এড়াই। আশ্রয় নিই বাড়ির পেছনের এক ধোপাবাড়িতে। সেখান থেকে আশ্রয় নিই পার্টির এক কর্মীর বাড়িতে। নিজের বাড়ির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নপ্রায়। আত্মগোপনে থেকেই চলে আন্দোলন।’ এরপর ১৯৫৩ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন শুরু হয়। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষে নিরলস কাজ করেন মোতাহার। বিএ পরীক্ষা দেয়ার প্রাক্কালে আবারো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় তাঁর নামে। পরীক্ষা দেয়া হলো না। আবারও আত্মগোপনে যেতে হয়। দেড় বছর এই পলাতক-জীবন পার করতে হয় তাঁকে। সেই জীবনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন- ‘আমাদের নেতা ছিলেন নৃপেন ঘোষ। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ঠাকুরদা। অন্যদিকে কমরেড আমজাদ হোসেনের নাম ছিল কাদের। তিনি ছিলেন পার্টির তাত্ত্বিক নেতা। যখন দেড় বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকি তখন আমজাদ হোসেন আমাদের পার্টির বিভিন্ন তথ্য ও বিষয় পড়ে শোনাতেন। ১৯৫৬ সালে আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বাতিল হলো। কারমাইল কলেজে ভর্তি নিষিদ্ধ ছিল বলে ঢাকায় এসে ভর্তি হই জগন্নাথ কলেজে।’ কর্মজীবন শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৬০ সালে তিনি যোগদান করেন কারমাইকেল কলেজে। তারপর পিএসসি মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে নিযুক্ত হন সরকারী কারমাইকেল কলেজে। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে তিনি রাজশাহী কলেজে যোগ দেন। এরপর ১৯৬৫ সালে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন ঢাকা কলেজে। ওখানে ছাত্র হিসেবে তিনি পান বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখ কামাল, কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, লেখক-গবেষক মফিদুল হকসহ আরো অনেককে। ১৯৬৮ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদায়ন হয়ে যোগ দেন তিনি রাজশাহী মহিলা কলেজে। সেসময় রাজশাহী বিভাগের মাধ্যমিক এবং একই ধারে যশোর বিভাগের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রধান পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সবচেয়ে কম বয়সে এমন গুরুদায়িত্ব পাওয়া তাঁর। সাহিত্য-জীবন ‘ছোটবেলায় মুকুল ফৌজ করতাম আমি। ১৯৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। অন্যদিকে চলছে মহাদুর্ভিক্ষ। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের পরিবারের মানুষজন তখন রাতের আঁধারে এসে লঙ্গরখানা থেকে খিচুরি নিয়ে গিয়ে খেতো লুকিয়ে। এগুলো নিজের চোখে দেখা আমার। রাস্তার পাশে বহু লাশ পড়ে থাকতেও দেখেছি। এ বিষয়গুলো আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে।’ কথাগুলো বলতে বলতে নিজের মনে হারিয়ে যান মোতহার হোসেন সুফী। সেসময় মুকুল ফৌজের পরিচালক ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। তখন তিনি রংপুরে এসেছিলেন। সবাইকে তিনি ব্রতচারী শেখাতেন, করাতেন প্যারেড। এই সংগঠন করতে গিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠানো হতো। তবে একসময় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। মোতাহার হোসেন তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। মুনশীপাড়া সাধারণ পাঠাগার থেকে হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা ‘মশাল’-এ ‘গল্প নয়’ গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর সাহিত্যজগতে। সাহিত্যচর্চায় তাঁর গবেষণাকর্মের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান সম্পর্কিত পাঠকনন্দিত প্রথম গবেষণাগ্রন্থ ‘ইতিহাসের মহানায়ক জাতির জনক’ (২০০০)। গ্রন্থটি সম্পর্কে লেখক বলেন- ‘বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে এ জাতি স্বাধীন ছিল না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে। এটিই এই বইয়ের বিষয়বস্তু। পা-ুলিপিটি প্রথম দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু-কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি পা-ুলিপিটি আদ্যোপান্ত পড়েন, মন্তব্যও লিখেন। তিনিই আমার প্ররেণাদাতা। তবে বইটির প্রকাশে এগিয়ে আসেন পাক্ষিক অনন্যা পত্রিকার সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় আমার লেখা জীবনীগ্রন্থ ‘তসলিমুদ্দীন আহমদ’। তসলিমুদ্দীন ছিলেন তাসমিমা হোসেনের দাদা। বইটি পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন তাসমিমা। আমাকে খুঁজছিলেন অনেক দিন ধরে। একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাঁর সঙ্গে। তিনিই উদ্যোগী হয়ে বঙ্গবন্ধুর ওপর আমার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেন তাঁর নিজস্ব প্রকাশনী থেকে। এই বইটি প্রকাশে আমি তিনজন মানুষের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। তাঁরা হলেন : তাসমিমা হোসেন, বেবী মওদুদ ও বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা।’ ব্যক্তি জীবন ব্যক্তি জীবনে মোতাহার হোসেন সুফী একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক মানুষ। স্ত্রী রওশননেহার হোসেনকে নিয়ে নিরিবিলি জীবনযাপন করেন তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নিজস্ব বাসভবনে। তিনি এক ছেলে, তিন মেয়ের জনক। নাম-বিভ্রাট মোতাহার হোসেন সুফীকে অনেকেই মিলিয়ে ফেলেন কবি সুফী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে। সুফী মোতাহার হোসেন (১৯০৭-১৯৭৫) ছিলেন বিখ্যাত সনেট রচয়িতা। নামের এই সাদৃশ্য-রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মোতাহার হোসেন সুফী বলেন- ‘আসলে আমার নাম রাখার কথা ছিল মোহাম্মদ মোতাহার হোসেন। কিন্তু আকিকার দিন মওলানা সাহেব বলে ফেলেন ছেলের নাম রাখা হলো ‘সুফী মোতাহার হোসেন’। তারপর থেকেই আমার এ নাম। পরবর্তী সময়ে যখন একই নামে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি আছেন জেনে ‘সুফী’ শব্দটিকে আমি নামের শেষে যোগ করি।’ আর রংপুরে সুফী পরিবারের সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনবদ্য গ্রন্থ ‘ইতিহাসের মহানায়ক : জাতির জনক’ গ্রন্থটি একটি ব্যতিক্রমী রচনা। গ্রন্থের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সর্বপ্রথম উল্লেখ্য- পাঁচটি সুচিহ্নিত অধ্যায়ে এই গ্রন্থ বিভক্ত। গ্রন্থটিতে বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস, ইংরেজ শাসনামল, পাকিস্তান শাসনামল, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিবরণ যুক্তিনিষ্ঠ। বইটি রচনার পটভূমি তুলে ধরে গবেষক মোতাহার হোসেন বলেন : ‘বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ইতিহাসের মহত্তম অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা- বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অন্দোলন ও সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বদান করে বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর সুচিহ্নিত করেছেন ইতিহাসের এক এক সংগ্রামী নায়ক। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে যাঁর ভূমিকা প্রধান তিনিই স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পটভূমিকা সুবিস্তৃত ও বিশাল। ইতিহাসের এই বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিশ্বের মানচিত্রে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও অবদান জাতির কাছে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আমি এই গ্রন্থ রচনায় ব্রতী হই।’ সাহিত্যকর্ম ও সম্মাননা ব্যস্ততম জীবনেও নানা বিষয়ে গবেষণালব্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন মোতাহার হোসেন সুফী। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘আবদুল্লাহ উপন্যাস বিচার’। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হলো : বাংলাদেশে পবিত্র কোরআন শরীফের প্রথম অনুবাদক তসলিমুদ্দীন আহমদের জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ ‘তসলিমুদ্দীন আহমদ’ (বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩), বিশিষ্ট সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ওপর জীবনীগ্রন্থ ‘কাজী মোহাম্মদ ইদরিস’ (বাংলা একাডেমি, ১৯৮৯), রংপুরের হাজার বছরের সাহিত্যের ইতিহাসভিত্তিক গ্রন্থ ‘বাংলা সাহিত্যে রঙ্গপুরের অবদান’ (বাংলা একাডেমি, ২০০১), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে থেকে প্রকাশিত লেখকের সম্পাদিত গ্রন্থ ‘তসলিমুদ্দীন আহমদ রচনাবলী’, অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কিশোর উপযোগী রচনা ‘প্রিয়তম নবী’ (২০০৯) ও শিশুতোষ রচনা ‘খাদিজা জীবনী’ (২০০৫)। রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ থেকে প্রকাশিত ‘রঙ্গপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব’ (২০০৭), ‘মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়’ (২০১০), ‘মুক্তিযুদ্ধে রঙ্গপুর’ (২০১৩), ১২৫ জনের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে প্রামাণ্যগ্রন্থ ‘রঙ্গপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব’ (জুলাই, ২০০৭), বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে রঙ্গপুর (২০১৩)। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ‘সাহিত্যের ইতিহাস’ (পুঁথিঘর, ১৯৬৮), তেভাগা সংগ্রামের অন্যতম নেতা মণিকৃষ্ণ সেনের ওপর লেখা ‘কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন : জীবন ও সংগ্রাম’ (১৯৯৭), ‘রঙ্গপুরের লোকসঙ্গীত’ (২০১২), ‘রঙ্গপুরের নাট্যচর্চার ইতিহাস’ (২০১২)। এছাড়া ‘সাংবাদিক অগ্রণী মাহমুদ হোসেন’, ‘সাংবাদিক অগ্রণী মাহমুদ হোসেনের কবিতা’। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে বাংলা একাডেমি থেকে ‘রঙ্গপুরের ইতিহাস’, ‘পীরগঞ্জের ইতিহাস’ (পীরগঞ্জ সমিতি, রংপুর) গ্রন্থ দুটি। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৮ সালে তিনি রংপুর কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক স্বর্ণপদক, ১৯৯২ সালে ঢাকাস্থ রংপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ কর্তৃক ‘র.সা.প পদক, ঢাকাস্থ স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট কর্তৃক ১৯৯৬ সালে রোকেয়া পদক, ১৯৯৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কর্তৃক ভাষাসৈনিক হিসেবে সংবর্ধিত হন। ২০১২ সালে বাংলা একাডেমির আয়োজনে ঠাকুরগাঁয়ে আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলনে সম্মাননাপ্রাপ্ত এবং বাংলা একাডেমি পরিচালিত সাদত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার (২০০০) প্রাপ্ত হন মোতাহার হোসেন সুফী। সংগঠন ও সম্মাননা মোতাহার হোসেন সুফী কেবল একজন গবেষকই নন, তিনি একজন সংগঠকও বটে। তিনি অভিযাত্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদ (১৯৭৮) এবং রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদের (২০০২) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে রংপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গবেষণা-গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জীবনসদস্য। বেগম রোকেয়া : জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থের প্রেক্ষাপট ১৯৫৬ সালের কথা। বেগম রোকেয়ার জীবন কাহিনী ‘রোকেয়া জীবনী’ পড়ে এই মহীয়সী নারীর কর্মময় জীবন, শিক্ষাচিন্তা, সমাজচিন্তা ও সাহিত্য সাধনা সম্পর্কে জানার জন্য গভীরভাবে আকৃষ্ট হন গবেষক মোতাহার হোসেন সুফী। সেই সময়ের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন- ‘সেসময় শহীদ সাবের বেঁচেছিলেন। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমার লেখা ‘নারী জাগরণের অগ্রদূতী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ প্রবন্ধটি ছাপতে দেয়া হলে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। অনেক দিন পর ১৯৭০ সালে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর সম্পাদনায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড পত্রিকার প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা (শরৎ, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ) ‘পুণ্যময়ী বেগম রোকেয়ার কর্মজীবন ও সাহিত্যসাধনা’ শিরোনামে আমার একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৭১ সালে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমার শতাধিক পৃষ্ঠার একটি পা-ুলিপি প্রেসে ছাপাতে দেয়া হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দিনগুলোয় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তা আর প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তবে দুঃখজনক ঘটনা হলো, প্রেসে জমা দেয়া ওই পা-ুলিপিটি আর উদ্ধার করতে পারিনি আমি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি থেকে কবি আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘বেগম রোকেয়া রচনাবলী’ প্রকাশিত হলে রোকেয়ার জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনায় অনুপ্রাণিত হই আমি। সুদীর্ঘ কয়েক বছরে ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে ‘বেগম রোকেয়া : জীবন ও সাহিত্য’ বই লেখার কাজ শেষ হয়। ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মহিউদ্দিন আহমেদের আগ্রহে বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়।’ বেগম রোকেয়ার শিক্ষাচিন্তা, সমাজচিন্তা, স্বাদেশিকচিন্তা ও পুরো সাহিত্যকর্ম নিয়ে মোতাহার হোসেন সুফীর গ্রন্থ বেশ কয়েকটি সংস্করণ হয়েছে ইতোমধ্যে। ২০০১ সালে সুবর্ণ প্রকাশনী থেকে বইটির নতুন মুদ্রণ হয়। ২০০৯ সালে জানুয়ারি মাসে তৃতীয় মুদ্রণ প্রকাশ হয় বইটির। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে যাঁরা বেগম রোকেয়া সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁদের গ্রন্থে নতুন চিন্তার কোন প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোতাহার হোসেন সুফী বলেন- ‘পাশ্চাত্যের নারীবাদ সম্পর্কে সর্বপ্রথম আলোকপাত করেছেন হুমায়ুন আজাদ এবং এ সম্পর্কে তাঁর লেখা গ্রন্থটির নাম ‘নারী’। হুমায়ুন আজাদের মতে, বেগম রোকেয়া নারীমুক্তির দর্শন নারীবাদ এবং নারীমুক্তির আন্দোলনে তাঁর [বেগম রোকেয়ার] ভাবমূর্তি তিনি নারীবাদী। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট অপেক্ষা বেগম রোকেয়া কট্টর নারীবাদী। পুরুষতন্ত্র ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মেরি যত না বলেছেন তার চেয়ে বেশি খড়্্গহস্ত ছিলেন রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার নারীবাদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন : ‘রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলী ভরে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ঘৃণা : ‘পুরুষ’ ধারণাটিই ছিলো তাঁর কাছে আপত্তিকর। পুরুষদের তিনি যে সামান্য করুণা করেছেন তা সম্ভবত ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। রোকেয়া রচনাবলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, পশ্চিমের প্রথম নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মধ্যেও এতখানি পুরুষবিদ্বেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না। মেরি পুরুষকে সমকক্ষ বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, রোকেয়া তাও মানতে রাজি হননি।’ [হুমায়ুন আজাদ, নারী, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২, পৃষ্ঠা-২৪৫] আমার মতে, বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের এই অভিমত মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। বেগম রোকেয়া পাশ্চাত্যের নারীবাদীদের মতো ঈশ্বরদ্রোহী ও পুরুষবিদ্বেষী নন। স্বীয় ধর্ম ইসলাম ধর্ম পালনে ছিল তাঁর গভীর নিষ্ঠা। রোকেয়ার নারীমুক্তির দর্শন নারীবাদের মতো পুরুষবিদ্বিষ্ট কোন মতবাদ নয়। তাঁর হৃদয়সঞ্জাত উপলব্ধি ও আন্তরিক বিশ্বাস পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া নারীমুক্তি অসম্ভব। বেগম রোকেয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস কোন মতবাদ থেকে ধার করা নয়, অনুকরণ কিংবা অনুসরণ নয়- পাশ্চাত্যের নারীবাদ থেকে তো নয়ই। রোকেয়ার উপলব্ধিতে নারীমুক্তির অন্তরায়সমূহের মধ্যে প্রধান অন্তরায় নারীশিক্ষার অপ্রতুলতা, নারীর অনগ্রসরতা ও উদাসীনতা। এছাড়াও আছে সামাজিক কুপ্রথা অবরোধপ্রথা তথা গৃহে আবদ্ধ রাখা, সর্বোপরি ধর্মের লেবাসধারী এক শ্রেণীর মানুষের সামাজিক অনুদারতা। রোকেয়ার নারীমুক্তির সংগ্রাম সৃষ্টিকর্তা ও পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, নারীর প্রতি যুগ-যুগান্তরের বৈষম্য, নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাঁর নারীমুক্তি আন্দোলন সমাজের বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত- তাই নারীবাদী মূর্তি বেগম রোকেয়ার জন্য মোটেও সম্মানজনক নয়।’ মোতাহার হোসেন সুফীর ‘নারীবাদ ও বেগম রোকেয়া’ গ্রন্থে এসব কথাই তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর কথা, ‘মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট অপেক্ষা বেগম রোকেয়াকে কট্টর নারীবাদী হিসেবে প্রমাণের জন্য ‘নারী’ গ্রন্থের লেখক হুমায়ুন আজাদ যে সমস্ত যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেসবের যথোপযুক্ত যুক্তিনিষ্ঠ খ-ন আছে আমার এ গ্রন্থে।’ পহেলা অক্টোবর মোতাহার হোসেন সুফীর ৮৩তম জন্মদিন। এমন পৌঢ় বয়সে এখনও তিনি তারণ্যে উজ্জীবিত। দীর্ঘাঙ্গী ও সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী এ প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ মানুষটি এখনও নিজের হাতেই করেন সব কিছু। বই-পত্রিকা পড়েন, লেখালেখি করেন, বইয়ের প্রুফ দেখেন, এখানে-ওখানে ঘোরাফেরা করেন ও আড্ডা দেন। ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত আন্তরিক ও স্নেহপ্রবণ তিনি। এই গবেষক শতায়ু হবেন এমনটাই প্রত্যাশা রইল আজকের দিনে।
×