ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

ভিনদেশী এক কবির সঙ্গে দুই সন্ধ্যা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২ অক্টোবর ২০১৫

ভিনদেশী এক কবির সঙ্গে দুই সন্ধ্যা

কবিতা উৎসবে দেখা হলো উজবেকিস্তানের তরুণ কবি ও সাংবাদিক আসরর আলোয়ারভের সঙ্গে। অসম্ভব সুদর্শন, বয়স ত্রিশও পেরোয়নি, সম্প্রতি তিনি উজবেকিস্তানের সাম্পতিক ধারা তরুণ কবিদের একটি কবিতা সংকলন টএইঊঈ চঙঊঞঝ’ অঘঞঐঙখঙএণ প্রকাশ করছেন আন্তর্জাতিক কবিতা সংসদের প্রাণপুরুষ দেব ভরদ্বাজের সহযোগিতায় ভারতের চ-িগড় থেকে। মূল কবিতাগুলো উপবেক ভাষায় লেখা, কবি আমরার ইংরেজীতে রূপান্তর করেছেন। চারফর্মার চমৎকার প্রচ্ছদ ও গেটআপ আঙ্গিক আকর্ষণীয়। কবিতার সঙ্কলনে প্রতিটি কবির ন্যূনপক্ষে ৩টি কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আছে সঙ্কলনটিতে। তবে যা সবচেয়ে মূল্যবান ও তাৎপর্যময় তা’হলো সঙ্কলনে উজবেক কবিতার একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ও ইতিহাস। সঙ্কলনটিতে একমাত্র নাদেরা ছাড়া আর সবাই শুধু তরুণ নন, অতি তরুণ। উজবেক কবিতাকে এই একঝাক তরুণেরা অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে, একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। অনুষ্ঠানের পর, আসরর আমাকে সঙ্কলনটি দিতে এসেছিল ৯ নবেম্বর নেলোরে হোটেল সুরিয়ায় ১০১ নম্বর কক্ষে। ঠাণ্ডা পেপসি আর বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়ন করলাম তাকে। সে মৃদু হেসে বললো ‘বিয়ার খেতে আমি খুব পছন্দ করি।’ আমি বললাম, ২২ বছর আগে ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক কারণে তোমরা সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়েছ, এটা কম বড় কথা নয়। পৃথিবীর অন্যতম বড় শক্তি সোভিয়েত রাশিয়া। তোমরা এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামিক রাষ্ট্র। মদ্যপান কি তোমাদের দেশে উম্মুক্ত, নিষিদ্ধ নয়? সে হাসতে হাসতে বললো, রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ, কিন্তু সবাই ঠিকই পান করছে। আমার হোটেলের ঠিক বিপরীত দিকে সুরার একটি বেশ বড় দোকান। আমি রিসেপশনে টেলিফোন করে বেয়ারাকে উপরে আসতে বললাম। ভারতীয় ১১০ রুপী দিয়ে ওকে বললাম, একটা কিংফিশার প্রিমিয়াম ও সঙ্গে একটা ডিজপজেবল গ্লাস এনো। আসরর বললো, ‘একটা কেন, তুমি খাবে না?’ ‘না আমি পেপসি খাব।’ আমি বললাম। সে বেশ ক্ষুব্ধ হলো। অভিমানভরা কণ্ঠে বললো, ‘আমিও খাব না।’ আমি বললাম, ‘না, না, তা কেন, আমি তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছি।’ আমার ঠিক মাথার ওপর ৩০২ কক্ষে কেরালার তরুণ কবি ফিলিপজ মাইকেলে থাকে। টেলিফোনে তাকে ডাকলাম। আসররও তাকে চেনে। তবে, তার সমস্যা হলো সে মালায়লাম ভাষায় কবিতা চর্চা করে। ফিলিপজের বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, বিবাহিত, শরীরের রং কালো। কালোরও যে একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে তা অন্ধ্রপ্রদেশ কিংবা দক্ষিণে না এলে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। ফিলিপজের সেই সৌন্দর্য রয়েছে, শুধু ইংরেজীর শব্দভা-ার খুবই কম, তার সঙ্গে কমিউনিকেট করতে জীবন বের হয়ে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার এই কবিতা উৎসবের জন্য বেশ কিছু কবিতা কাউকে দিয়ে ইংরেজী অনুবাদ করে নিয়ে এসেছে। কোথাও অনুবাদকের নাম নেই, অনুবাদে মূল হারিয়েও যায়নি, বেশ ভাল হয়েছে। ফিলিপজ আমার টেলিফোন পেয়ে দৌড়ে চলে এলো। সেও অপার আগ্রহে পানাহারে অংশগ্রহণ করল। আমার মনে পড়ল ২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালে অরুনাভ সরকারদা’র বাসার কয়েকটি সন্ধ্যার কথা। রফিক আজাদ এলেন, ফারুক মাহমুদতো আগে থেকেই তৈরি। শুরু হয়ে গেল জম্পেশ আড্ডা, হৈ হৈ রৈ রৈ আর জমজমাট আলাপচারিতা। তর্ক-বিতর্ক, কবিতা নিয়ে আলোচনা, আর রফিক ভাই-এর রসাত্মক স্মৃতিচারণ। আমি আরও দুটো কিংফিশার আনতে নির্দেশ দিলাম বেয়ারাকে, সঙ্গে চিপস বা চানাচুর। পেপসিতে নিমগ্ন হয়ে মনে হলো আমি কোথায় যেন হারিয়ে গেছি। স্মৃতি লজ্জাহীন, যেমন স্বপ্ন লজ্জাহীন। কী ছিল সেইসব দিন। আজ আর সেইসব দিন নেই। চাইলেও আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। আমি চলে এসেছি স্বেচ্ছানির্বাসনে ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টা দূরে কার্তিকপুর (শরিয়তপুর) একটি রেসিডেন্সিয়াল ইউনিভার্সিটিতে। রফিক ভাই সম্প্রতি অবসরে গেছেন। অরুনাভদা মরে গেছেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দও চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। আর অন্যরা কে কোথায় আছে, আমি জানি না। গল্প লেখা যায়, কিন্তু এরকম পরিবেশে আমি কবিতা লিখতে পারি না। ঢাকা থেকে ৪ ঘণ্টার পথ। আমি যেখানে থাকি, সেখানে অবিশ্রান্ত শান্তি ও নির্জনতা বিরাজ করে। ঢাকা শহরের উত্তাল যানজট নেই, মিছিল-মিটিং নেই, এক প্রশান্তি বিরাজ করে সর্বব্যাপী। এর মানে এই নয় যে, এই আপামর জনসাধারণ মূর্খ, তারা রাজনীতিমুখী নয়। তারা সমাজসচেতন, তারা দু’বেলা দুমুঠো খেতে পেলে বর্তে যায়। তারা শেখ হাসিনা বোঝে না, তারা খালেদা জিয়া বোঝে না, এরশাদ বোঝে না, তারা পদ্মাসেতু বোঝে না, তারা বোঝে ভরা পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া মাঠের ফসল। বলছিলাম দুই ভিনদেশী তরুণ কবি ও তাদের সঙ্গে আলাপচারিতার কথা। মাঝখানে টুকরো টুকরো ফ্ল্যাশব্যাক হলো। উজবেকিস্তানের কবি-সম্পাদক আসরারের নির্বাচিত কবিতার এবং ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের ফিলিপজের নির্বাচিত কবিতার ইংরেজী থেকে অনুবাদ বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করলাম। এরপর ধারাবাহিকভাবে উজবেকিস্তানের তরুণদের সাম্প্রতিক ৭ জন কবির কবিতার অনুবাদ আমার মূল সৃজনশীল কাজের ফাঁকে ফাঁকে কোন অলস বিকেলে ভেতর থেকে যখন অনুভব করব, তখন অনুবাদ করে ফেলব। কোন ফরমায়েশি অনুবাদ আমি করতে পারি না, পারতপক্ষে করি না। সৃজনশীল লেখার পাশাপাশি একটু বিশ্রাম ও রিলাক্স করার মুহূর্তে এ কাজগুলো করতে আমার ভাল লাগে। আমি করি। অনেকের ধারণা আমি অনুবাদক, ঠিক তা’ নয়। এ পর্যন্ত ৪টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের ওপর অখ্যাত ও বিখ্যাত প্রকাশনালয় থেকে। কেউ রয়ালটি দিয়েছে, কেউ দেয়নি। ইংরেজী সাহিত্যের নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র হিসেবে পাঠ্যসূচীর ভেতরের কবি-কথা শিল্পী-নাট্যকার ও প্রবন্ধকারদের লেখা পরীক্ষায় পাসের জন্য একসময় পড়েছি। এখন পড়াতে গিয়ে নতুন করে পড়তে বেশ আনন্দ পাই, ভাল লাগে। এই ধারাবাহিকতায় সেই যে ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার সাহিত্যসম্পাদক কবি আহসান হাবীব আমাকে ‘ই. এম. ফস্টার: তার উপন্যাস’ ভুবন লিখতে নির্দেশ দিলেন, সেই প্ররোচনা একরকম নেশা ও সৃজনশীল কাজে নিমজ্জিত করল। ফস্টারের পাঠ্যসূচীভুক্ত একটি মাত্র উপন্যাস আ’ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া এবং তার মৃত্যুর দিনকয় পর নিউজ উইক ও দ্য টাইমস সাপ্তাহিকীতে প্রকাশিত দুটি ঋদ্ধ ও গবেষণালব্দ প্রবন্ধ পুঁজি করে লিখে ফেললাম সেই সময় (১৯৭২) সদ্য প্রয়াত ফস্টারের ওপর লেখাটি। উজবেক তরুণ কবি আসরর আলেয়ারব (অঝজঙজ অখখঊণঅজঙই)-এর নির্বাচিত কয়েকটি কবিতার বাংলায় অনুসৃতিঃ সময়, যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হলো আমার পুনর্জন্ম হলো সেদিন তোমার সঙ্গে দেখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি ছিলাম জীবনহীন সময়, যখন তোমার সঙ্গে দেখা হলো সত্যিকারভাবে আমি জেগে উঠলাম তারপর খেলাম পানাহার করলাম সবকিছুই কেমন যেন ব্যর্থ মনে হয় আমি আরও আয়ু চেয়েছিলাম সময়, যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা হলো আবার আমি তরতাজা হলাম সাহসী হলাম সময় তোমার সঙ্গে যেদিন দেখা হলো ভাবনাগুলো কেমন গোলমাল হয়ে গেল খুব কষ্টে নিঃশ্বাস নিলাম সময়, তোমার সঙ্গে যেদিন দেখা হলো মাথা নত হয়ে এলো তবুও আমার আত্মা আকাশে পাড়ি জমালো কোন বিকল্প নেই দৃষ্টি ঘষে মেজে আবার তাকালাম আধ্যাত্মিক যাদুময়তা হৃদয় ছুঁয়ে যায় মনে হয় এই পৃথিবী চিরকালের হঠাৎ দেখা হলো, কবরের সঙ্গে।
×