ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাস-মিনিবাসে ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া আদায়

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২ অক্টোবর ২০১৫

বাস-মিনিবাসে ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া আদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ)- পক্ষ থেকে কোন প্রকার তালিকা ছাড়াই বর্ধিত বাস ভাড়া কার্যকর করা হলো। সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসে প্রথম দিনে ভাড়া আদায়ে রাজধানীতে রীতিমতো অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ভাড়া নিয়ে দিনভর বাড়াবাড়ির ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ঘটেছে বাগ্্বিত-াসহ অপ্রীতিকর ঘটনাও। বিভিন্ন গন্তব্যের দূরত্ব বাড়িয়ে মনগড়া ভাড়ার তালিকা ঝোলানো হয়েছে কিছু কিছু বাসে। বেশিরভাগ বাসে তালিকা দেখা যায়নি। ৫-৭ টাকা সর্বনিম্ন ভাড়ার হিসেব নিকেশও কেউ মানছে না। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী ভাড়া আদায় হচ্ছে কিনা তা দেখভালের জন্য বিআরটিএর পক্ষ থেকে কোন তদারকিও ছিল না। তবে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য কেউ বাড়তি ভাড়া আদায় করার অভিযোগ পেলে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে প্রথম দিনে বিভিন্ন রুটে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ স্বীকার করেছেন খোদ পরিবহন মালিক সমিতির নেতারাই। তারা বলছেন, বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আগামী দু’দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কেউ বাড়তি ভাড়া যেন যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করতে না পারে সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানোর কথা জানান মালিক সমিতির নেতারা। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, যাত্রীদের কাছ থেকে যেন বাড়তি ভাড়া আদায় না হয় সে জন্য বিআরটিএ কাজ করে যাচ্ছে। মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেব। বিআরটিএর পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ভাড়ার তালিকা পরিবহন মালিকদের কাছে পাঠানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বুধবার রাতে এ তালিকা পাঠানোর কথা ছিল। সময় কম হওয়ায় সব বাসে তালিকা হয়ত টাঙানো হয়নি। তবে বিআরটিএ আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় থেকে বাস ও মিনিবাসের বর্তমান ভাড়ার তালিকা মালিক সমিতির কাছে পাঠিয়ে দায় সেরেছে বিআরটিএ। কিন্তু বিভিন্ন রুটের দূরত্ব নির্ধারণ করে ভাড়ার তালিকা বিআরটিএ থেকে মালিক সমিতির কাছে পাঠানো হয়নি। যে কারণে পরিবহন মালিকরাই মনগড়া তালিকা টাঙিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ বিআরটিএর রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি (আরটিসি) সব রুটের দূরত্ব নির্ধারণ করে ভাড়ার তালিকা চূড়ান্ত করে থাকে। গেল ১৫ দিনের মধ্যে আরটিসির কোন বৈঠক হয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে কোন কোন রুটে বাড়তি ভাড়া আদায়ের মৌখিক অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। এর মধ্যে পল্লবী-মতিঝিল, ফার্মগেট মতিঝিলসহ আরও বেশ কয়েকটি রুটে বাড়তি ভাড়া নেয়ার কথা জানান তিনি। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়ে কালাম বলেন, নতুন করে সবকিছু যাচাই-বাছাই করা হবে। ভাড়ার তালিকা সবাইকে দেয়া হলেও অনেক বাসে টাঙানো হয়নি। তবে দ্রুত তা টাঙানো হবে। সারাদিন রাজধানীর কোথাও ভাড়া নিয়ে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে জানান তিনি। মতিঝিল থেকে ফার্মগেট সাত কিলোমিটারের বেশি! আর চিড়িয়াখানার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটারের বেশি। ভাড়া ১২ টাকা ও ২৬ টাকা। এমন তালিকা ঝুলতে দেখা গেছে নিউ ভিশন পরিবহনে। এই পরিবহনের মালিকরা নিজেরাই তালিকা করে বাসে টানিয়েছে। অথচ বিআরটিএ ২০১১ বাস ভাড়ার তালিকা থেকে দেখা গেছে মতিঝিল থেকে ফার্মগেটের দূরত্ব পাঁচ দশমিক সাত কিলোমিটার মাত্র। বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে দিনভর নিউ ভিশন পরিবহনের যাত্রীদের সঙ্গে বাস সংশ্লিষ্টদের ঝগড়া হয়েছে। পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত বাসে সাত টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও বাসাবো থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মিডওয়ে ও বাহন পরিবহনে ১৫ টাকা আদায় করা হয়। আর সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত চাওয়া হয় ২০ টাকা। অর্থাত সর্বনিম্ন ভাড়ার তালিকা তো মানছেই না। বরং বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে আগে থেকেই। বিআরটিএ পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানীর ১৬৮টি রুটে বাস চলছে। আর ১২০টির বেশি রুটের ভাড়ার তালিকা অনলাইনে দেয়া আছে। তবে নতুন তালিকা বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বিআরটিএ অনলাইনে আপলোড করা হয়নি। মিরপুর থেকে গুলিস্তান রুটের সময় নিয়ন্ত্রণ পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির ঘটনা ঘটে। বাসের সুপারভাইজার আরিফ জানান, নতুন ভাড়া যাত্রীরা দিতে নারাজ। তিনি জানান, দু-এক দিনের মধ্যে ভাড়ার নতুন তালিকা বাসে লাগিয়ে সে অনুযায়ী আদায় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকপক্ষ। বিহঙ্গ পরিবহনের চালক মিজান বলেন, মিরপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত দূরত্বে দুই টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। মিরপুর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত আগের ১৩ টাকার বদলে তারা নিচ্ছেন ১৪ টাকা করে। ছয় নম্বর বাসে উঠলেই সাত টাকা চাওয়া হয় যাত্রীদের কাছে। ঢাকা ও আশপাশের পাঁচ জেলা এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের নতুন ভাড়া বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। নতুন ভাড়া অনুযায়ী বাসে প্রতি কিলেমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা ও মিনিবাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া আগের মতোই ৭ টাকা এবং মিনিবাসের ভাড়া ৫ টাকা থাকছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যয় বিশ্লেষণের নামে এ ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। আগে বাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা ও মিনিবাসে ১ টাকা ৫০ পয়সা ভাড়া নির্ধারিত ছিল। সকালে ২৭, ৮ নম্বর, ১ ও ১২ নম্বর রুটের কয়েকটি বাসের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বাসগুলোতে ভাড়ার কোন তালিকা নেই। গন্তব্য অনুসারে ১ বা ২ টাকা করে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেন যাত্রীরা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কিলোমিটারপ্রতি ১০ পয়সা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীপ্রতি ভাড়ায় তেমন প্রভাব পড়বে না। যাত্রীপ্রতি ১ থেকে ৫ টাকা ভাড়া বেড়েছে। ভাড়ার নতুন হার নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ জেলায় চলাচলকারী বাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হচ্ছে। বাস পরিচালনায় অসত্য তথ্য দেখিয়ে এবারও ভাড়া প্রস্তাব করেছিল ব্যয়-বিশ্লেষণ কমিটি। এতে প্রতি কিলোমিটার ১২ পয়সা ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ওই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতি কিলোমিটার ১০ পয়সা ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। ভাড়া নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যয়-বিশ্লেষণ কমিটিতে মালিক থাকলেও যাত্রী প্রতিনিধি কেউ ছিল না। ব্যয়- বিশ্লেষণে নতুন সিএনজি বাসের দাম দেখানো হয়েছে গড়ে ৩৬ লাখ টাকা। ব্যাংক ঋণে কেনা এসব বাসে সুদ বাবদ ১১ লাখ ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। আর নিবন্ধন ফি ২২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে দৈনিক ইঞ্জিন অয়েল (মবিল) পরিবর্তন, বছরে ১০টি টায়ার পরিবর্তন, চালক-হেলপারদের মাসিক ৪৮ হাজার টাকা মজুরিসহ ১৭ ধরনের পরিচালন ব্যয় রয়েছে। এর সঙ্গে মালিকদের শতকরা ১০ ভাগ মুনাফা ধরা হয়েছে। এ ছাড়া গাড়িতে যাত্রী গড় বোঝাই দেখানো হয়েছে ৮০ ভাগ। যানজটের কারণ দেখিয়ে প্রতিটি বাস দৈনিক ১৬০ কিলোমিটার চলাচল করে বলে ব্যয়-বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোন বাসই সাধারণত ২০০ কিলোমিটারের কম চলাচল করে না। আসনের পরও ৪০-৫০ শতাংশ যাত্রী অতিরিক্ত বহন করা হয়। এসব বাসে দাঁড়িয়ে বা দরজায় ঝুলেও যাত্রী তোলার চিত্র নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। ব্যয়-বিশ্লেষণে বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০ বছর। তবে রাজধানীতে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসের আয়ুষ্কাল ১০ বছরের অনেক বেশি। এমনকি ২০ বছরের বেশি গাড়িও চলাচল করছে। এসব গাড়ির ক্রয়মূল্য ও ব্যাংক সুদের কোন ভিত্তি নেই। অথচ এ জন্য বছরে গড়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া কোন কোন বাস কোম্পানির নিজস্ব গ্যারেজ না থাকলেও বছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ হাজার টাকা। বীমা ঠিকমতো না করলেও বার্ষিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ হাজার টাকা। পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোর মালিকরা নতুন গাড়ির ভাড়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছে। বাস সারা বছর চলাচল করলেও এক্ষেত্রে ধরা হয়েছে ৩০০ দিন। এ ছাড়া ইঞ্জিন অয়েল পরিবর্তন, রুটিন রক্ষণাবেক্ষণে মবিল পরিবর্তনসহ বিভিন্ন খাতে বাস্তবের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় দেখিয়ে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন ভাড়ার তালিকা বাসে টাঙানোর কথা ছিল গতকাল বুধবার থেকে। কিন্তু বৃহস্পতিবারও সব বাসে ভাড়ার নতুন তালিকা দেখা যায়নি। বাস-মিনিবাসে নতুন ভাড়ার তালিকা তৈরি করে রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি। ঢাকা মহানগরে পরিবহন কমিটির প্রধান পুলিশ কমিশনার। আর যাবতীয় সাচিবিক দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। সড়ক পরিবহন বিভাগের সচিব এম এ এন সিদ্দিক বলেন, নতুন ভাড়া তালিকা মালিক সমিতিগুলোতে পাঠানো হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নেয়া হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করবে।
×