ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কক্সবাজারের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষকে আগে ২ কিমি হেঁটে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে হতো

নুনিয়ারছড়াবাসীর সুপেয় পানি সঙ্কট মিটেছে সৌর প্লান্টে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২ অক্টোবর ২০১৫

নুনিয়ারছড়াবাসীর সুপেয় পানি সঙ্কট মিটেছে সৌর প্লান্টে

শাহীন রহমান, নুনিয়ারছড়া কক্সবাজার থেকে ফিরে ॥ কক্সবাজার জেলা সদরের উত্তরে অবস্থিত নুনিয়ারছড়া এলাকা। প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বসবাস। বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের। এলাকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হওয়ায় বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির সমস্যার অন্ত ছিল না। কষ্ট করে প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হতো। খাওয়ার পানি সংগ্রহে মহিলারা প্রায়ই ইভটিজিংসহ নানা হয়রানির শিকার হতো। বর্তমানে সেখানে সৌরবিদ্যুত চালিত লবণমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের প্লান্ট স্থাপন করায় এলাকাবাসী খাওয়ার পানির সমস্যা দূর হয়েছে। এখন আর তাদের কষ্ট করে দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয় না। সৌরবিদ্যুত চালিত সুপেয় পানি প্লান্ট থেকেই মিলছে প্রয়োজনীয় পানির যোগান। নুনিয়ারছড়ায় বিভিন্ন এনজিওর সহায়তায় দেশে প্রথম সোলার বেস ডিস্যালাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে পরিবেশ অধিদফতর। অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৪২ লাখ টাকা খচর করে দেশে প্রথমবারে মতো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। এর মাধ্যমে এলাকার পাঁচ হাজার লোকের পানির সমস্যার দূর হয়েছে বলে জানান অধিদফতরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সর্দার শরীফুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ কাজে ৫০টি সোলার প্যানেল ও ১২টি ব্যাটারি বসিয়ে প্রত্যেক দিন ভূগর্ভস্থ থেকে প্রায় ৫ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করে ফিল্টারের সাহায্যে লবণমুক্ত করে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রকল্পটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে নুনিয়ারছড়া ইসিএ (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের একটি সংগঠন। সরেজমিনে প্রকল্প এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে মহিলারা লাইন ধরে সোলার বেস ডিস্যালাইন প্রকল্প থেকে লবণমুক্ত পানি সরবারহ করছে। প্রায় ৮ কিলোওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন সোলার প্যানেল বসিয়ে চলছে ভূগর্ভস্থ থেকে পানি উত্তলনের কাজ। আর ভেতরে বসানো হয়েছে দুটি ফিল্টার ও পাঁচ হাজার লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পানি ট্যাঙ্ক। প্রথমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলিত লবণ পানি প্রথম ফিল্টারের মধ্যে প্রবেশ করছে। এরপর সেখান থেকে পানি পিউরিফাইড হয়ে লবণমুক্ত হয়ে দ্বিতীয় ফিল্টারের মধ্যে প্রবেশ করছে। এখান থেকে পানি সরাসরি চলে যাচ্ছে রিজার্ভ ট্যাঙ্কিতে। এরপর ট্যাপের সাহায্যে মহিলারা পানির ট্যাঙ্কি থেকে কলসি ভরে খাওয়ার পানির সংগ্রহ করছেন। নুনিয়ারছাড়া ইসিএ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আলম বলেন, সৌরশক্তি চালিত লবণমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ প্লান্ট থেকে এলাকার মহিলারা শুধুমাত্র খাওয়ার পানি সংগ্রহ করে থাকেন। গোসলসহ অন্য কোন কাজে এ পানি ব্যবহারে নিষিদ্ধ। ফলে এখান থেকে প্রত্যেক দিন যে পানি পাওয়া যায় তাতে এলাকার মানুষের চাহিদা পূরণ করেন আরও উদ্বৃত্ত থাকছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে লবণ পানির সমস্যা এখন এলাকার মানুষের মধ্যে নেই। তিনি জানান, এখান থেকে প্রত্যেক কলসি পানির জন্য ২ টাকা করে রাখা হচ্ছে। এলাকাবাসী স্বেচ্ছায় টাকা দিয়ে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এ টাকা দিয়ে প্রকল্প ব্যবস্থপনার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রকল্পের অফিসের মেইনটেন্যান্স ও ব্যাটারি পরিবর্তনের এ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। স্থানীয় অধিবাসীরা জানান এ প্রকল্প গ্রহণের আগে এলাকার মানুষের খাওয়ার পানির ব্যাপক সমস্যা ছিল। সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় আশপাশে কোথাও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পাওয়া যেত না। ফলে দূর থেকে হেঁটে কষ্ট করে মহিলাদের পানি সংগ্রহ করতো। কিন্তু দূর থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহে ছিল নানা বিপত্তি। দূর থেকে মহিলারা পানি সংগ্রহ করতে যেত বলে ওই এলাকার স্থানীয়রা প্রায়ই এসব মহিলাদের উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করতো। তাদের নানা ধরনের হয়রানি করা হতো। এসব সত্ত্বেও তারা বাধ্য হয়েই খাওয়ার পানির তাগিদেই হয়রানি উপেক্ষা করেই তাদের পানি আনতে হতো। কিন্তু সৌরচালিত লবণমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ প্লান্ট স্থাপনের ফলে এ সমস্যা দূর হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করায় স্থানীয়রাও ব্যাপক খুশি। পরিবেশ অধিদফতর এ প্রকল্প বাস্তবায়নে থাকলে বিভিন্ন এনজিওর পক্ষ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা ধরনের সহায়তা দেয়া হয়েছে। ক্রেল নামের একটি এনজিও আঞ্চলিক সন্বয়কারী শফিকুর রহমান বলেন, সরকারী-বেসরকারী সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ফলে আজ এলাকার সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছে। এলাকাবাসীকে দূর থেকে আর কষ্ট করে পানি আনতে হয় না। তিনি জানান, ৮ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন প্রায় ৫০টি সোলার প্যানেল বসিয়ে প্রত্যেকদিন পাঁচ হাজার লিটার পানি উত্তোলন করে বিশুদ্ধ লবণমুক্ত করা হচ্ছে। সৌরচালিত এ প্রকল্প থেকে পানি উত্তোলনের পরেও অতিরিক্ত বিদ্যুত ব্যাটারিতে জমা হয়ে থাকে। ফলে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে পানি সরবরাহের কোন সমস্যা হয় না। তিনি বলেন, আকাশ এক সপ্তাহ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও অতিরিক্ত উৎপাদিত বিদ্যুত দিয়েই পানি উত্তোলন ও লবণমুক্ত করে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর জানিয়েছে, শুধু নুনিয়ারছড়ায়ই নয় অনুরূপ প্রকল্প টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপের স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও সৌরচালিত সেচ সুবিধা প্রদানের জন্য কক্সবাজারে ২টি সৌরশক্তি চালিত সেচপাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তারা বলছেন, এ দুটি প্রকল্পের ফলে লবণাক্তজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রশমনে সৌরশক্তি চালিত লবণমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহ প্লান্ট স্থাপন এবং স্থানীয় কৃষকদের সেচ সুবিধায় সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
×