ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘অস্ট্রেলিয়ার আশঙ্কাকে পুঁজি করে কোন তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিয়ে থাকতে পারে’

ইতালীয় নাগরিক হত্যা এখনও রহস্যাবৃত, কেউ ধরা পড়েনি

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২ অক্টোবর ২০১৫

ইতালীয় নাগরিক হত্যা এখনও রহস্যাবৃত, কেউ ধরা পড়েনি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গুলশান কূটনৈতিক পাড়ায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা সুপরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার। এরসঙ্গে অনেকের জড়িত থাকার বিষয় স্পষ্ট। যদিও জড়িতদের মধ্যে কোন বিদেশী রয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। হত্যাকারীরা বাংলাদেশী। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অঘোষিত বাংলাদেশ সফর বাতিল ঘোষণার পরেই বিদেশী খুনের ঘটনা, তদন্তের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখতেই কোন গোষ্ঠী সিজারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে থাকতে পারে। হত্যাকা-ে উগ্র মৌলবাদী বা জঙ্গীগোষ্ঠীর জড়িত থাকাও বিচিত্র নয়। পাশাপাশি এনজিওটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সূত্র ধরেও সিজার হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে কিনা সে বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান চলছে। যদিও সিজার হত্যাকা-ের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে এখনও শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেনি তদন্তকারীরা। হত্যাকা-ে সরাসরি ৩ জনের জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। যদিও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। হত্যার পর খুনীরা মোটরসাইকেলযোগে ৮৯ নম্বর সড়ক দিয়ে পালিয়ে যায়। হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আইএসের তরফ থেকে যে বিবৃতি এসেছে তার কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, ইতালিও মনে করে, হত্যাকা-ের সঙ্গে আইএস জড়িত নয়। বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এমনটাই জানিয়েছেন মামলাটির তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে ডিবির পূর্ব বিভাগের উপ-কমিশনার মাহবুব আলম ও গুলশানের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুল আহাদ উপস্থিত ছিলেন। মনিরুল ইসলাম আরও জানান, সিজারের পেশাগত কোন ঝামেলা ছিল কি না তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়াও এনজিওটির কোন অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সেই কোন্দলের কারণে সিজারের সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব হয়েছিল কিনা সেটিও তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে। পাশাপাশি হত্যার দায় স্বীকার করে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও বুধবারও এমন কোন ওয়েবসাইটের ভিত্তি পাওয়া যায়নি বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়। এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তৃতীয় কোন পক্ষ এ ঘটনা ঘটাতে পারে। তবে সিজার হত্যার ঘটনাটি সুপরিকল্পিত। কেবল পেশাদার খুনীদের ক্ষেত্রেই এ ধরনের হত্যাকা- ঘটানো সম্ভব। খুনীরা হত্যার পর ৮৯ নম্বর সড়ক ব্যবহার করে দ্রুত পালিয়ে যায় বলে সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। হত্যার বিষয়ে আরও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব তথ্যের পর্যালোচনা চলছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে গুলশান-২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানের সরকারী বাসভবনের প্রাচীর দেয়ালের দক্ষিণ পাশে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও আইসিসিও কোঅপারেশন বাংলাদেশের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সিজার তাভেলা (৫০)। তিনি আইসিসিও কো-অপারেশনের ‘প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি’ কর্মসূচীর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন। এনজিওটি বাংলাদেশে পানি, স্যানিটেশন, রিফিওজি সমস্যা ও পুনর্বাসনসহ নানা সমাজসেবামূলক কাজ করে থাকে। তদন্ত সংস্থা বলছে, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করতেই তৃতীয় কোন গোষ্ঠী বিদেশীকে হত্যা করার টার্গেট নিতে পারে। তারই অংশ হিসেবে হত্যা করা হতে পারে সিজারকে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের আশঙ্কাকে পুঁজি করে তৃতীয় কোন গোষ্ঠী হত্যাকা-ের ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। ঘটনার পর আশপাশের প্রায় সব দূতাবাসসহ সরকারী-বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ফুটেজ পর্যালোচনা করে হত্যাকারীদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। প্রাথমিকভাবে হত্যাকা-ে একটি মোটরসাইকেলযোগে ৩ খুনী অংশ নেয় বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনার সময় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সদস্য সিজার স্কুলটির সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে ভেজা কাপড়ে গবর্নরের বাসার সামনের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। ঘটনার সময় সিজার প্রাচীর দেয়ালের মাঝামাঝি মেহগিনি গাছের নিচে পৌঁছে। সেখানে আগ থেকেই ওঁৎপেতে ছিল হত্যাকারীরা। সিজারকে ডাক দিয়ে খুব কাছ থেকে তারা গুলি চালায়। প্রাণে বাঁচতে সিজার সামনের দিকে দৌড়ে গবর্নরের বাড়ির দক্ষিণ কোণায় গিয়ে পড়ে যান। দ্রুত সিএনজিতে তুলে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যেই সিজারের মৃত্যু হয়। সিজারকে পেশাদার খুনীরা হত্যার করার বিষয়টি নিশ্চিত। হত্যাকা-টি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। তদন্তকারীরা বলছেন, এনজিওটির অফিস গুলশান-১ এর ৩০ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায়। আর সিজার গুলশান-২ নম্বরের ৫৪ নম্বর সড়কের ১১/বি নম্বর বাড়ির ৫/২ ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন। সিজার ২৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেন। অন্তত দশটি দেশে সিজারের কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশে ২০১২ সাল থেকে কার্যক্রম চালালেও ২০১৩ সালে এনজিওটি বাংলাদেশের এনজিও ব্যুরোর তালিকাভুক্ত হয়। চলতি বছরের ১৫ মে সিজার মাসিক প্রায় ৯ লাখ টাকা বেতনে এনজিওটির বাংলাদেশ শাখায় যোগদান করেন। যোগদানের পর প্রায় ২৫ দিন সিজার বাংলাদেশেই ছিলেন না। নানা কারণেই সিজারের হত্যাকা- গভীর রহস্যের জন্ম দিয়েছে। ঘটনাস্থলটি বাসা থেকে কাছেই। সার্বিক দিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিজারের গতিবিধি আগ থেকেই নজরদারির মধ্যে রেখেছিল খুনীরা। এরপর সুযোগ বুঝে হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। এদিকে এনজিওটির যেসব কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তাতে এ ধরনের হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটার মতো কোন আলামত বা আর্থিক লেনদেনের ফিরিস্তি মেলেনি। ইতোমধ্যেই এনজিওটির ৬৬ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করেও সিজারকে হত্যার মতো কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। গুলশানের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবদুল আহাদ জানান, সিজারের লাশ এখনও ঢাকা মেডিক্যালের হিমঘরেই রয়েছে। লাশ হস্তান্তরের বিষয়টি বাংলাদেশস্থ ইতালীয় দূতাবাসের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। ইতালির মিলান শহরে বসবাসরত ১৬ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ের কাছেই সিজারের লাশ হস্তান্তরের কথা রয়েছে।
×