ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এক মাসে গ্রাহক কমেছে পাঁচ লাখ;###;লেনদেন কমেছে ৩২ কোটি টাকা;###;অনিয়মের কারণে গত মাসে সাড়ে ৬ হাজার এজেন্টের কার্যক্রম বন্ধ

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মন্দা ॥ জঙ্গী অর্থায়ন ঠেকাতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৩ অক্টোবর ২০১৫

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মন্দা ॥ জঙ্গী অর্থায়ন ঠেকাতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি

রহিম শেখ ॥ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হিসাব খোলা ও হিসাব সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের ফলে গ্রাহকসংখ্যা কমছে। সেই সঙ্গে কমছে সক্রিয় গ্রাহক ও লেনদেনের পরিমাণ। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ গ্রাহক কমে গেছে। শুরু থেকেই মোবাইলে লেনদেন বাড়লেও আগস্টে লেনদেন কমেছে প্রায় ৭ শতাংশ। টাকার লেনদেন কমেছে ৩২ কোটি টাকা। লেনদেনে সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যাও কমেছে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ। কমে গেছে বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার, জঙ্গী অর্থায়নসহ নানা অপকর্ম বেড়ে যাওয়ায় এ সেবার ওপর নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে এখন সঠিক গ্রাহক ও লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ফলে এক দিকে নতুন হিসাব খোলা যেমন কিছুটা কমেছে, তেমনি পুরনো কিছু হিসাবও বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮৭ লাখ ৩২ হাজার। আর আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজারে। সেই সঙ্গে লেনদেনে সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যাও কমেছে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ। গত জুলাই মাসে সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ২৩ হাজার। আর আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৬ লাখে। সেই হিসাবে মাসিক গ্রাহক সংখ্যা ১৯ শতাংশ কমে গেছে। সাধারণত যেসব হিসাবে একটানা তিন মাসের বেশি লেনদেন হয় না, সেসব হিসাবকে নিষ্ক্রিয় হিসাব বলে ধরা হয়। আর অন্তত তিন মাসের মধ্যে একবার লেনদেন করেছে এমন হিসাবকে সক্রিয় হিসাব বলে ধরা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত আগস্টে গ্রাহক কমার পাশাপাশি লেনদেনের পরিমাণও কমেছে। ওই মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ১২ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার লেনদেন হয়, জুলাই মাসে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। জুলাইয়ে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। আর আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪২৮ কোটি টাকায়। সেই হিসাবে মাসিক ও দৈনিক লেনদেন ৭ শতাংশ কমে গেছে। এদিকে গ্রাহক ও লেনদেন কমলেও বেড়েছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিনিধি বা এজেন্ট। জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে এজেন্টের সংখ্যা ২ হাজার ১৬৭ জন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৮৯৮ জনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে আড়াই কোটি টাকা প্রবাসী-আয় লেনদেন হয় এই সেবার মাধ্যমে। জুলাই মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসে ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে উত্তোলন করেছেন ৪ হাজার ৬৮৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। জুলাই মাসে উত্তোলন করেছেন ৫ হাজার ৪৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে অন্যের হিসাবে পাঠিয়েছেন ২ হাজার ২৪৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। আগের মাসে অন্যের হিসাবে পাঠিয়েছেন ২ হাজার ৪২৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে বেতন পরিশোধ হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা। জুলাই মাসে বেতন পরিশোধ হয়েছে ১৪৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে সেবা-বিল পরিশোধ হয়েছে ১১৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আগের মাসে সেবা-বিল পরিশোধ হয়েছে ১৪৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আগস্ট মাসে অন্যান্য খাতে পরিশোধ হয়েছে ২৬৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আগের মাসে অন্যান্য খাতে পরিশোধ হয়েছে ২৬৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, জুলাই মাসে ঈদ-উল-ফিতরের কারণেও সক্রিয় ও নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছিল। ওই সময় অনেকে প্রিয়জনকে টাকা পাঠাতে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছিলেন। কিন্তু আগস্টে ওই ধরনের ধর্মীয় উৎসব না থাকায় গ্রাহকসংখ্যা এবং লেনদেন কমেছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, এজেন্টদের ব্যক্তিগত হিসাব থেকে ব্যবসায়িক লেনদেন নিরুৎসাহিত করতে নানা ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক এজেন্টের হিসাব বাতিল করা হয়েছে। গ্রাহকসংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে এখন সঠিক গ্রাহক ও লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা জানান। জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচারসহ নানা অপকর্ম বেড়ে যাচ্ছে। মানবপাচারসহ চোরাচালানির লেনদেনও হচ্ছে এ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। আর এ কাজের সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরের পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছে সীমান্তের বাইরেও। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি টিম ভারতের ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাংলাদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। আর ওই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশী টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বেশির ভাগ লেনদেন হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ অপারেটর এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে। এ নিয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এর ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সীমান্তের ওপারে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত সব মোবাইল অপারেটরের সিমই পাওয়া যাচ্ছে। এসব সিমের মাধ্যমে অবৈধভাবে লেনদেন হচ্ছে বাংলাদেশী টাকা। যেমন, বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্তের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল, হরিদাসপুর, বাংলাদেশের বুড়িমারী সীমান্তের ওপারে চেংরাবান্ধা, বাংলাদেশের দিনাজপুরের ওপারে গেদে সীমান্তে, টেকনাফের ওপারে মংডু সীমান্তে বাংলাদেশের টাকা অবাধে লেনদেন হচ্ছে। ফলে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ওপর নিয়মিত নজরদারি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদিকে সম্প্রতি জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন প্রতিরোধে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঠিক পরিচয়সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিশ্চিত হওয়ার কঠোর নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনার পর মোবাইল ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে ব্যাংকিং প্রতিনিধি বা এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়, যাতে গ্রাহক সম্পর্কে সঠিক তথ্য নিশ্চিত না হয়ে কোন হিসাব খোলা না হয়। পাশাপাশি পুরনো গ্রাহকদের সঠিক পরিচয়সহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ওপর কঠোর নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে হিসাব খোলার ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঠিক পরিচয়সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিশ্চিত হওয়ার কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এর ফলে এক দিকে নতুন হিসাব খোলা যেমন কিছুটা কমেছে, তেমনি পুরনো কিছু হিসাবও বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেছে, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনেক এজেন্টের বিরুদ্ধে নিজ নামে একাধিক এ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধনহীন গ্রাহকের পক্ষে লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ উপায়ে ঘুষ, জঙ্গী অর্থায়নসহ নানা অবৈধ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করে। এর পর গত বছরের নবেম্বরে একই ব্যাংকে একজন গ্রাহকের একাধিক এ্যাকাউন্ট না খোলা ও বিদ্যমান এ্যাকাউন্ট বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সার্কুলার জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া নিবন্ধনহীন গ্রাহকের পক্ষে কোন ধরনের লেনদেন করলে এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকগুলো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত এজেন্টের এজেন্টশিপ বাতিল ও একই নামে থাকা একাধিক এ্যাকাউন্ট বন্ধের উদ্যোগ নেয়। নিয়ম মেনে লেনদেন না করায় গত মাসে ছয় হাজার ৪৩৯ এজেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক। গরমিল তথ্যে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খোলা যাবে না ॥ গরমিল তথ্য দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা যাবে না মর্মে চলতি বছরের ২ আগস্ট একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিপত্রে বলা হয়, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সব কার্যক্রম নিরাপদ ও কার্যকর করতে এখানে ব্যবহূত সব গ্রাহকের সিম এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তথ্য গ্রাহকের কেওয়াইসিতে প্রদত্ত তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে হলে আবেদনকারীর সিম এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর একই ব্যক্তির কিনা, তা নিশ্চিত হতে হবে। পরিপত্রে আরও বলা হয়েছে, অপরাধমূলক লেনদেনের ঝুঁকি কমাতে পাঁচ হাজার টাকা বা তদুর্ধ অঙ্কের প্রতিটি লেনদেনের সময় সেবাদানকারী এজেন্ট গ্রাহকের ছবি নিয়ে তা সংশ্লিষ্ট লেনদেনের তথ্য হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখবেন। এছাড়া প্রতিমাসের অগ্রগতি প্রতিবেদনপরবর্তী মাসে ১৫ তারিখের মধ্যে পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া পরিপত্রে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত ২৮ ব্যাংককে অনুমোদন দিলেও এ সেবা দিচ্ছে ২০ ব্যাংক। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান বিকাশের গ্রাহক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং এরপরই আছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং।
×