ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রগতিশীলতা, মুক্তচিন্তা, ধর্মবিদ্বেষ এবং একটি বিশ্লেষণ

ইমরান এইচ সরকার

প্রকাশিত: ০৫:২১, ৩ অক্টোবর ২০১৫

ইমরান এইচ সরকার

প্রগতিশীলতা কি? ‘প্রগতি’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞানে বা কর্মে এগিয়ে চলা’। যারা এই কাজটা যথাযথভাবে করতে সক্ষম, তাদেরই ‘প্রগতিশীল’ বলা হয়। আর প্রগতিশীলতা হলো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রগতিশীল মানুষ সমাজের ঘুণে ধরা জরা দূর করতে জীবন উৎসর্গ করে। প্রগতিশীল মানুষ নিজে সৃষ্টিশীল কাজ করে, অন্যদের উৎসাহিত করে। চেতনায় বিপ্লব ঘটানোই হচ্ছে প্রগতিশীল হওয়া। সমাজ বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কহীন করে প্রগতিশীলতাকে বুঝলে আমরা বার বার ভুল জায়গাতে প্রগতিশীলতাকে খুঁজতে পারি। সমাজ বিপ্লবকে ঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারলে আমরা প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলের পার্থক্য হয়ত ঠিকঠাক বুঝতে পারব। সমাজ বিপ্লব হলো, পুরনো সমাজ ব্যবস্থা থেকে প্রগতিশীল শক্তিগুলোর মাধ্যমে সাধিত বিকাশের একটি গুণগত, নতুন ও উচ্চতর পর্যায়ের দিকে সমাজের অগ্রগতি, একটি নতুন ও প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণ। ইংরেজী চৎড়মৎবংংরাব শব্দের বাংলা অর্থ প্রগতিশীল। প্রগতিশীল শব্দের দ্বারা আমরা এমন একটি শ্রেণীকে বুঝি যে শ্রেণী অর্থনৈতিক লড়াইয়ে অতীতের সমাজকে ভেঙ্গে নতুন সমাজ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। প্রগতিশীলতা হচ্ছে একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমানকে ভবিষ্যতের যৌক্তিকতায় ধারণ করা এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে এবং সমাজকে নির্দেশনা দেয়াই হচ্ছে প্রগতিশীলতা। মুক্তচিন্তা কি? মুক্তচিন্তা এক প্রকার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা মনে করে, জীবন-জগতের সামনে আসা সমস্ত প্রশ্নকে বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা ও যুক্তির আলোকে বিচার করা উচিত; মতামত গঠনের ক্ষেত্রে প্রথা, অন্ধবিশ্বাস এবং পূর্ব নির্ধারিত সত্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মুক্তচিন্তা বলে যে জ্ঞান ও যুক্তির অনুপস্থিতিতে দাবিকৃত কোন মতকেই সত্য হিসেবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা উচিত না। সুতরাং, মুক্তমনারা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, বাস্তব সত্য এবং যুক্তির আলোকে মত গড়ে তোলে এবং কর্তৃপক্ষ, পক্ষপাতদুষ্টতা, লোকজ্ঞান, জনপ্রিয় সংস্কৃতি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, প্রথা, গুজব এবং অন্য সব গোঁড়া, বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতার উৎসাহদাতার ভূমিকা পালনকারী শাস্ত্র থেকে নিজেদের বিরত রাখে। মুক্তচিন্তা কি আসলেই মুক্ত? মুক্তচিন্তা বলতে আসলে কিসের থেকে মুক্ত বুঝব? মুক্ত মানে সমস্ত অজ্ঞতা-ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার-পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত। এর মানে ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় চিন্তা না করেই খেয়াল-খুশি মতো যে কোন কিছু করা বা বলা নয়। অনেকেই মুক্তচিন্তা বলতে ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করাকে বোঝেন অথবা কোন নিয়ম না মানাকে বোঝেন। তারা মুক্তচিন্তাকে যা ইচ্ছা তাই বলা বা লেখাকে বোঝাতে চান। তারা এই সত্যটি ভুলে যান যে, জাগতিক কোন কিছুই নিয়মের বাইরে নয়। এমনকি মানুষের চিন্তার উৎপত্তির ও প্রতিদিনের চিন্তা করার পদ্ধতিরও একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম সম্পর্কে জানা ও তদনুযায়ী ক্রিয়া করতে পারার নামই স্বাধীনতা। সমাজ বিকাশের নিয়ম মেনে চিন্তা ও কাজ করতে পারার নামই প্রগতিশীলতা। সমাজ বিকাশের নিয়মকে অস্বীকার করে কখনও মুক্তচিন্তক বা স্বাধীন মানুষ হওয়া যায় না। বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকেই মানুষের স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। এ স্বাধীনতা যে অর্জন করতে পারে, সেই অন্ধবিশ্বাস, চিরায়ত প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শেখে। এই প্রশ্নই নতুন জ্ঞান, নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। একটি সত্যিকারের মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র মুক্তচিন্তা ও চিন্তার স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে। মুক্তচিন্তা ও ধর্মবিদ্বেষ ইতোপূর্বে আমার একটি লেখায় লিখেছিলাম, সুনির্দিষ্ট কোন জাতি-গোষ্ঠী-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের প্রতি সচেতনভাবে বিদ্বেষ ছড়ানো কোনভাবেই মুক্তচিন্তা কিংবা মুক্তবুদ্ধির চর্চা হতে পারে না। একইভাবে যারা শুধুমাত্র নিজেদের হীন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সম্পূর্ণযুক্তিহীনভাবে সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অকল্যাণ ও বিশৃঙ্খলার মুখে ঠেলে দেন, তারা কোনভাবেই মুক্তচিন্তক কিংবা মানবতাবাদী হতে পারেন না। কোন ধর্ম, গোষ্ঠী, গোত্র বা বর্ণের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো বা তাদের আঘাত করা অন্যায়– অপরাধ। এমনকি কোন ব্যক্তির প্রতিও এই আচরণ করা অন্যায়। এটা কোন লেখা, বক্তৃতা, বিবৃতি অথবা যে কোন মাধ্যমে হতে পারে। কোন লেখা বা ব্লগ যদি ঘৃণা ছড়ায়, তাহলে তা প্রগতিশীলতা হতে পারে না? প্রগতিশীল মানুষ আলো ছড়াবেন, ঘৃণা নয়? একজন প্রগতিশীল মুক্তচিন্তক সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, পিছিয়ে নয়। ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, ধর্মবিদ্বেষ কিংবা ধর্মান্ধতা; এ সবই প্রগতিবিরোধী ও অমানবিক। আমার চিন্তা এবং মতপ্রকাশের যেমন স্বাধীনতা আছে, তেমনি আমার স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশ যেন অন্যের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত না করে, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা সবসময়ই আপেক্ষিক। আমাকে দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান এবং নৈতিকতাই বলে দেয় আমি কতদূর যেতে পারি? তাই ধর্মবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ কিংবা যে কোন ধরনের বিদ্বেষই অমানবিক ও মুক্তচিন্তা বা বাকস্বাধীনতার মৌলিক দর্শনের পরিপন্থী। ধর্মবিশ্বাস ও মুক্তচিন্তা মুক্তচিন্তা মানেই কি কোন সুনির্দিষ্ট বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের চর্চা? একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কি মুক্তচিন্তক হতে পারেন না? আমি মনে করি অবশ্যই পারেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইউরোপীয় রেনেসাঁ অগ্রদূত বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা। মধ্যযুগে ক্যাথলিক চার্চের যাজকীয় শাসকরা খ্রিস্ট মতবাদের যে প্রতিক্রিয়াশীল ভাষ্য মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, তারই বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষ থেকে খ্রিস্ট ধর্মের বিপ্লবী ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন ইউরোপের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। এঁদের মধ্যে ছিলেন ওয়াইক্লিফ, জন হাস, টমাস মুয়েনৎসার, উইনস্ট্যানলি এবং এ রকম আরও অনেকে। এঁরা কেউই ধর্মবিরোধী বা নাস্তিক বা বস্তুবাদী ছিলেন না। তবুও ধর্মে আস্থা রেখেই এঁরা যেভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেছিলেন তার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না। পরবর্তীতে এঁদের সঙ্গে যুক্ত হয় কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩), ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০) ও গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৬৪২) প্রমুখের সাহসী ও ত্যাগশীল বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা, যা বাইবেলের ‘পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে/সূর্য পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত প্রদক্ষিণ করছে’ মতবাদকে নাকচ করে দিয়ে খ্রিস্ট ধর্মীয় বিশ্বাস ও চার্চভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার গোড়াকে শক্ত হাতে নাড়িয়ে দেয়। এর হাত ধরে পরবর্তীতে ইউরোপে রেনেসাঁস, এনলাইটেনমেন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশনের (বিপ্লব) মতো ঘটনার আবির্ভাব ঘটিয়ে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, দর্শন-সাহিত্যে, অর্থনীতি-রাজনীতিতে ও শিল্প-প্রযুক্তিতে অসাধারণ উন্নয়ন বয়ে আনে। মুক্তচিন্তাকে একটা যান্ত্রিক দৃষ্টিতে দেখা কোনমতেই সঠিক ও ইতিহাস সম্যত নয়। মানব ইতিহাসের দিকে তাকালে সহজেই দেখা যায়- পৃথিবীর প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর সমাজ জীবনেই মুক্তবুদ্ধির চর্চা ধর্মচেতনার একটি দীর্ঘ পর্যায় অতিক্রম করে অগ্রসর হয়েছে এবং মানব সমাজে সে পর্যায়টির চূড়ান্ত অবসান এখনও ঘটেনি। বিশেষত কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থার অধীন যে সমাজ, সে সমাজের চিন্তা-চেতনা তো আজও অনিবার্য রূপেই ধর্মাশ্রয়ী। ধর্মের আওতার ভেতরে থেকেই সে সমাজের মানুষ বুদ্ধির চর্চা করে, সে ধরনের চর্চার মধ্য দিয়েই তার বুদ্ধি শাণিত হয়ে ওঠে ও ক্রমান্বয়ে তাতে মুক্তির ছোঁয়া লাগে। ধর্মকেন্দ্রিক সমাজ কাঠামোতে মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চা ধর্মকে কেন্দ্র করেই স্ফূর্তি পেয়েছে, প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামেও ধর্মকে বাতিল ঘোষণা করেনি। সমাজের ধর্মীয় কর্তৃত্বশীল শাসকগোষ্ঠী ধর্মের যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা কখনই কর্তৃত্ব বঞ্চিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি বরং উল্টোটাই হয়েছে। তাই কর্তৃত্বহীনরা ধর্মের অন্যতর ব্যাখ্যা খুঁজেছে। সে কারণে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কখনই সুনির্দিষ্ট চিন্তা ও বিশ্বাসের সীমারেখায় আবদ্ধ থাকেনি। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, সাদা-কালো, খ্রিস্ট-মুসলিম সর্বোপরি শোষিত-নিপীড়িত সকল মানুষই মুক্তবুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে আলোকিত আগামীর সন্ধান করেছে। উপসংহার পৃথিবীর কোন স্বাধীনতাই শর্তহীন নয়। স্বাধীনতা কল্যাণমুখী যতক্ষণ এর সীমা নির্ধারিত থাকে। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি নিয়ন্ত্রণের নামে স্বাধীনতা হরণ করাও মারাত্মক অন্যায়। মুক্তবুদ্ধি-মুক্তচিন্তা প্রপঞ্চসমূহ স্বার্থান্বেষী মহলের অপব্যবহার ও বিশেষত ধর্মবিদ্বেষের কবল থেকে মুক্ত হতে না পারলে ‘মুক্তচিন্তা’, ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ অনেক কথার কথা হিসেবেই থেকে যাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বুঝতে পারেন না বলেই অনেকে মুক্তচিন্তার নামে, চিন্তার স্বাধীনতার নামে, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খল আচরণকে সমর্থন করেন। তাই যারা মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার কথা বলছেন, তাদের মনে রাখা দরকার যেনতেনভাবে দায়-দায়িত্বহীন একটা মতপ্রকাশ করার নামই চিন্তার স্বাধীনতা নয়। কোপারনিকাস-ব্রুনো-গ্যালিলিও কিংবা বিদ্যাসাগর- রোকেয়া-আবদুল ওদুদ প্রমুখ মনীষী যে মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন তা সমাজকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, কূপম-ূকতার অন্ধকার গহ্বর থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছে। আজকের দিনের মুক্তচিন্তা যদি সমাজে অবস্থিত অসঙ্গতি, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, পশ্চাদপদতাকে দূর করতে না পারে, মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রগতির পথে পরিচালিত করতে না পারে, মানুষ হিসেবে মানবিকতা-মূল্যবোধ সম্পন্ন উন্নত মানসকাঠামো বিনির্মাণ করতে না পারে, তাহলে এমন দায়িত্বহীন মুক্তচিন্তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাই মুক্ত মানুষ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন মানুষ হতে চাইলে সত্যিকারের মুক্তির পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে চিন্তা করার শক্তি মানুষের মধ্যে আছে বলেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। পরিশীলিত জীবনচর্চা ও পরিশীলিত চিন্তাশক্তি হতে পারে মানুষের কল্যাণের অন্যতম পাথেয়। স্বাধীনতা হরণ নয় বরং পরিশীলিত স্বাধীনতাবোধই দায়িত্বশীল মানুষের মানবতাবোধের মাপকাঠি। লেখক : গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র
×