ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাকির হোসেন তমাল

আনন্দ-বেদনার ‘হলজীবন’

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ৪ অক্টোবর ২০১৫

আনন্দ-বেদনার ‘হলজীবন’

দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরসহ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের থাকার জন্য হলগুলোতে ‘গণরুম’ রয়েছে। আবাসিক কক্ষে সিট পাওয়ার আগে ছাত্রদের বেশ কিছুদিন সেখানে থাকতে হয়। এরপরই তাঁদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় কক্ষ। তবে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের থাকার জন্য কোন গণরুম নেই। এই ক্যাম্পাসের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররা প্রথম বর্ষ থেকেই সিট বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের থাকার আবাসিক হল রয়েছে ১১টি। এসব হলে ৬ হাজার ছাত্রের আবাসন সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে। প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ডান দিকে কিছুটা সামনে এলেই দেখা মিলবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও কেন্দ্রীয় মসজিদ। এর সামনে এসে চোখ খুললেই দেখা মিলবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে প্রাচীনতম হলটির। বিনোদপুর গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বাম দিকে কিছুটা এগিয়ে এলেও পাওয়া যাবে হলটি। এই হলের নাম মতিহার। রাজশাহীর মতিহার থানার নাম অনুসারে এই হলটির নামকরণ করা হয়। ক্যাম্পাসটি এই থানার অধীনে থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বলে থাকেন মতিহারের সবুজ চত্বর। ১৯৫৮ সালে টিনসেড দিয়ে তৈরি করা হয় হলটি। তবে ১৯৮০ সালে নতুন করে আবারও তিনতলা বিশিষ্ট হল তৈরি করা হয়। তবে এখনও নতুন ভবনের কাজ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কম ছাত্র থাকেন এই হলে। হলটিতে বর্তমানে ৯১টি সিট রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় হলটির নাম ‘শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হল’। যদিও ১৯৬২-৭১ সাল পর্যন্ত হলটির নামকরণ ছিল ‘জিন্নাহ হল’। পরবর্র্র্র্তীতে দেশ স্বাধীনের পর ’৭২ সালে ফজলুল হকের নাম অনুসারে এই হলটির নামকরণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ সংলগ্ন জমিতে এই হলটির অবস্থান। এই হলে আবাসিক শিক্ষার্থী রয়েছেন ৩০০ জন। হলটিতে একই কক্ষে চারজন থেকে শুরু করে একক সিটেরও কক্ষ রয়েছে। বিশিষ্ট সুফিসাধক হযরত শাহ মখদুম রুপসের নাম অনুসারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় হলটির নামকরণ করা হয় ‘শাহ মখদুম হল’। এই হলটিকে সবাই সংক্ষিপ্ত করে বলেন এসএম হল। ১৯৬২ সালে ক্যাম্পাসের পূর্বপাড়ায় বিনোদপুর গেট দিয়ে কিছুটা সামনেই নির্মাণ করা হয়। হলটিতে বর্তমানে ৪৩০ জন শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হলটিতে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য তিনজন থেকে শুরু করে একজনের জন্যও একটি কক্ষ বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের চতুর্থ হলটির অবস্থান শাহ মখদুম হলের সামনেই। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ স্যার নবাব আবদুল লতিফের নাম অনুসারে হলটির নামকরণ করা হয়। নবাব আবদুল লতিফ হলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে। হলটিতে ৩০০ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এটিই একমাত্র হল, যেখানে কোনো রুমেই দু’জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা নেই। হলটিতে সাধারণ দ্বিতীয় বর্ষের শেষের দিকে এসেই শিক্ষার্থীরা সিট পেয়ে থাকেন। একই বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবিদ সৈয়দ আমীর আলীর নাম অনুসারে পঞ্চম হলটি নির্মাণ করা হয়। শাহ মখদুম ও লতিফ হলের পূর্ব পাশে এই ‘সৈয়দ আমীর আলী হল’টির অবস্থান। হলটিতে ৪২০ জন শিক্ষার্থীর এক সঙ্গে আবাসিকতার ব্যবস্থা রয়েছে। এই হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি হিন্দু শিক্ষার্থী থাকেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র এই হলটিতেই হিন্দু শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা একটি ডাইনিং চালু রয়েছে। এছাড়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য একটি ডাইনিংসহ খাওয়ার জন্য রয়েছে একটি ক্যান্টিন। বাংলাদেশের প্রথম শহীদ শিক্ষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক প্রক্টর শহীদ শামসুজ্জোহার নাম অনুসারে এখানে ষষ্ঠ হলটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৯ সালে শহীদ শামসুজ্জোহা হলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বপাড়ায় বধ্যভূমি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর গেট দিয়ে উত্তর দিকে বেশ কিছুটা পথ আসার পরই হলটি পাওয়া যাবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের জন্য শহীদ মীর আবদুল কাইয়ূম ডরমেটরি নামে একমাত্র আন্তর্জাতিক হলের সামনেই হলটির অবস্থান। এই হলটিতে এক সঙ্গে ৩২০ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ হাবিবুর রহমান নামে একটি হল প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে কিছুটা সামনে এসে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন থেকে কিছুটা পা বাড়ালে দেখা মিলবে সপ্তম হলটির। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হলটিতেই সর্বোচ্চ ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হলটিতে এক সঙ্গে ৬১৪ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। সম্প্রতি হলটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। হলটির সামনে হাবিবুর রহমানের একটি প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক মাদার বখশের নামের সঙ্গে মিল রেখে অষ্টম হলটি নির্মাণ করা হয় ১৯৭৪ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলস্টেশন এলাকায় মাদার বখ্শ হলের অবস্থান। হলটিতে এক সঙ্গে ৫৮৪ শিক্ষার্থী থাকতে পারেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবম হলটি নির্মাণ করা হয় ১৯৭৮ সালে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী নামে এই হলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলের পিছনে স্টেশন এলাকায়। হলটিতে ৫৯২ শিক্ষার্থীর আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। হলটিতে একক সিট থেকে শুরু করে এক কক্ষে চারজন শিক্ষার্থীরও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম অনুসারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম হলটি বির্মাণ করা হয় ১৯৯৩ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ ও শহীদ হবিবুর রহমান হলের মাঝখানে এই হলটির অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়াম থেকে কিছুটা উত্তর পাশে এই হলটি। ৫৯৮ শিক্ষার্থী এক সঙ্গে হলটিতে থাকতে পারেন। বাংলাদেশের রূপকার বঙ্গবন্ধুর নাম অনুসারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সর্বশেষ হলটি নির্মাণ করা হয় ২০০৩ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটারিয়ার পেছনে অবস্থিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র এই হলেই গবেষকদের থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। হলটিতে ৪৫০ শিক্ষার্থীর এক সঙ্গে আবাসন ব্যবস্থা পেয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মিরাজুল ইসলাম ও ফিরোজ আহমেদ বলেন, হল জীবনের অনুভূতি শুধু মুখে বলে শেষ করা যাবে না। আমরা ক্যাম্পাস জীবন শেষ করে এখান থেকে চলে যাওয়ার পর সবচেয়ে বেশি যে স্থানটিকে মিস করব, তা হলো আমাদের এই হলটি। হলের আনন্দে কখন যে মাস গড়িয়ে যায়, তা আমার বলতেই পারি না। মনে হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক ছাত্রের মানসিকতাই এমন হওয়ার কথা।
×