ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এমন কল এখন নিত্যদিনের;###;বস্তিতে ৮৪ শতাংশ ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন

আজ কামে আইতে পারুম না ॥ প্রযুক্তির ছোঁয়া বস্তিতেও

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৪ অক্টোবর ২০১৫

আজ কামে আইতে পারুম না ॥ প্রযুক্তির ছোঁয়া বস্তিতেও

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকছেন ছয় বন্ধু। প্রত্যাশা, মামুন বকসী, মাসুম, বাপ্পি, মাসুদ ও রাসেল। এদের সবারই বাড়ি দেশের উত্তর জনপদের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামে। এরা সবাই ছাত্র। অনেক দিন ভাল কিছু খাওয়া হয় না বলে একদিন সবাই মিলে একটু বেশি করে টাকা দিয়ে গরুর মাংস, ইলিশ মাছ ও পোলাউর চাল কিনতে সকালে বাজারে যায়। ছুটির দিন তাই দুপুরে বেশ জমিয়ে খাওয়া হবে বলে রাত থেকেই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু বাজারে যাওয়ার পথে একজনের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করতেই ওপার থেকে ভেসে আসে, ভাইজান আইজ আর যাইতে পারুম না। শইলডা খুব খারাপ। বুঝতে বাকি রইল না বুয়া অসুস্থ, তাই আসতে পারবেন না। তাৎক্ষণিক তাদের পরিকল্পনা বদল করতে হয়। যদিও তাদের মনের মতো খাওয়া হয়নি কিন্তু তারপরও তারা খুশি, এই জন্য যে কাজের বুয়া ফোনটা না দিলে বাজার করার পর সেগুলো নিয়ে মহা ঝামেলা পোহাতে হতো। কারণ তারা কেউই রান্না করতে পারেন না। এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। জীবনকে অত্যন্ত সহজ করেছে মোবাইল প্রযুক্তি। বস্তিতেও লেগেছে ডিজিটাল বাংলাদেশের ছোঁয়া। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে তথ্য-প্রযুক্তি। বস্তির প্রায় ৮৪ শতাংশ খানায় (পরিবারে) মোবাইল ফোন রয়েছে, ৪৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ পরিবারে রয়েছে টেলিভিশন, ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ পরিবারে রয়েছে রেডিও। এছাড়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিদ্যুত ব্যবহার করছে। এ হার ৮৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কেরোসিন তেল ব্যবহার করে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ মানুষ। এমনই তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে বলা হয়েছে, বস্তিতে বসবাসকারী ১৬ দশমিক ৮০ শতাংশ পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে রিক্সা বা ভ্যান চালনা, ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ পরিবার রিক্সা বা ভ্যান রয়েছে, ১৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ মানুষ গার্মেন্টকর্মী, ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক, ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিক, ২ দশমিক ৮২ শতাংশ হোটেল শ্রমিক, ১৫ দশমিক ৭১ শতাংশ ব্যবসা এবং ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ সেবা খাতে কাজ করে। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার বলেন, পৃথিবীর সকল অর্থনীতিবিদই একমত যে অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন কানেকটিভি। এটি খুবই জরুরী। কারণ মানুষে মানুষে যোগাযোগ ঘটলেই সেখানে অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। আমাদের দেশে মোবাইলের বিকাশ খুব বেশিদিন আগের নয়। ১৯৯৭ সালে মনোপলি ভেঙ্গে বর্তমান সরকার চারটি অপারেটরকে অনুমতি দেয়ার মধ্যদিয়ে এই বিকাশ ঘটে। আমি মনে করি দেশে বর্তমানে ৯৮ শতাংশ জায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক রয়েছে। কিন্তু কোন কালেই ল্যান্ড ফোন এর এক অংশ জায়গাও কভার করতে পারত না। যেমন হাওর এলাকায় এটাত একেবারেই অসম্ভব ছিল। এখন মোবাইল ফোনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকা- বেড়েছে। যেমন একজন সবজি ব্যবসায়ী ভৈরবে কৃষককে ফোন করে সবজির অর্ডার দিচ্ছেন আর বিকাশে তার কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। এতে সময় ও অর্থ সবই ব্যয় কমছে। তাছাড়া কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত ইন্টারনেটের বিপ্লব ঘটবে। সেই সুযোগটিও বস্তিবাসীরা ব্যাপকভিত্তিক কাজে লাগাতে পারবে। তিনি আরও বলেন, মোবাইলের মাধ্যমে ভয়েস ও তথ্য সবই এখন পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই যোগাযোগ স্থাপনে আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। তবে এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সিম নিবন্ধনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে আগামী পাঁচ বছরে (২০১৬-২০) তথ্য ও প্রযুক্তি খাত উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে খাত ভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো হচ্ছে, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় জিডিপির শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ থেকে এক শতাংশে বৃদ্ধিকরণ, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো, টেলি ঘনত্বের হার শতভাগে উন্নয়তিকরণ, ব্রড-ব্যান্ড বিস্তৃতির হার ৩০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া, আইসিটি, ভ্রমণ ও পর্যটন খাত থেকে আয় দেড় বিলিয়ন ডলার থেকে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ। সূত্র জানায়, প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে বস্তির সংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, মূলত পাঁচ কারণে গ্রাম ছেড়ে বস্তিতে আসছে মানুষ। এগুলো হচ্ছে দারিদ্র্য, কাজের সন্ধান, নদী ভাঙ্গন, ডিভোর্স এবং নিরাপত্তাহীনতা। ১৯৯৭ সালে মোট ২ হাজার ৯৯১টি বস্তি থাকলেও সেটি বেড়ে গিয়ে ২০১৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৯৪টিতে। বর্তমানে এসব বস্তিতে বাস করছে ২২ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ জন মানুষ। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৯২৫ জন এবং মহিলা ১০ লাখ ৮৬ হাজার ৩৩৭ জন। সেই সঙ্গে দেশে ঠিকানাবিহীন (ভাসমান) মানুষ রয়েছে ১৬ হাজার ৬২১ জন। যাদের কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। দুটি সিটি কর্পোরেশনে ভাসমান লোক রয়েছে ৭ হাজার ২৪৭ জন। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কানিজ ফাতেমা জানান, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনা ২০১৪ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিসংখ্যানের নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান চাহিদার আলোকে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতের নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক মান ও পদ্ধতি অনুসরণ করে বিভিন্ন শুমারি ও জরিপ পরিচালনা করে আসছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনা করা হয়েছে। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী বাস্তবায়ন, নগর দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিরুপণে এ শুমারিটি বিশেষ গুরুত্ব রাখবে। প্রতিবেদনে বস্তির বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলা হয়েছে, জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি এবং ঘরবাড়ির সংখ্যাধিক্য থাকে এবং একটি কক্ষে অধিক লোক বাস করে, এক শতাংশ জমিতে তিন বা তার বেশি ঘর বাড়ি থাকে, বস্তির জমির মালিকানা বস্তিসমূহ সাধারণত সরকারী, আধা-সরকারী, ব্যক্তি মালিকানাধীন খালি জমিতে, পরিত্যক্ত বাড়ি বা ভবনে, পাহাড়ের ঢাল বা সড়ক বা রেল লাইনের ধারে গড়ে উঠে, পানি সরবরাহ ও পয়োপ্রণালি ব্যবস্থা : বস্তিসমূহে সাধারণত অপর্যাপ্ত বা অপরিষ্কার পানি সরবরাহ, অপ্রতুল, পয়োপ্রণালি ব্যবস্থা (একটি টয়লেট ১৫ বাতার বেশি লোক ব্যবহার করে) ও সর্বোপরি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করে, বস্তিসমূহের রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা ও চলাচলের রাস্তা অপর্যাপ্ত বা একেবারেই থাকে না, বস্তিসমূহের অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুব নিম্নমানের হয়ে থাকে এবং বস্তিবাসীগণ সাধারণত অপ্রতিষ্ঠানিক অকৃষি কাজে নিয়োজিত থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এর আগে বলেছিলেন, আগামীতে ইন্টারনেট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু শুধু ফেসবুক বা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার না করে তরুণদের উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবক হতে হবে। অনেকেই মনে করেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না হলে ভাল পেশা হয় না। কিন্তু সেটা ভুল। এর বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ক্যারিয়ার তৈরির বিপুল সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বৈষম্য কমিয়ে আনতে চাই। মোবাইল প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। সেটি সব শ্রেণীর মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। প্রতিবেদনের ফলাফলে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগে ১০ লাখ ৬২ হাজার ২৮৪ জন, বিভাগ ভিত্তিক বস্তিবাসীর সংখ্যা হচ্ছে, বরিশালে ৪৯ হাজার ৪০১ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৬ জন, খুলনা বিভাগে ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ১ লাখ ২০ হাজার ৩৬ জন, রংপুর বিভাগে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬২৮ জন এবং সিলেট বিভাগে ৯১ হাজার ৬৩০ জন। এলাকাভিত্তিক বস্তির সংখ্যা হচ্ছে বরিশালে ১৩৭টি, চট্টগ্রামে ২ হাজার ২০৮টি, কুমিল্লায় ৪১টি, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ মিলে ৩ হাজার ৩৯৯টি, গাজীপুর ১ হাজার ২৮৭টি, খুলনায় ১ হাজার ১৪৩টি, রাজশাহী ১০৩টি, রংপুর ৪৯টি এবং সিলেটে ৬৬৭টি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বস্তিতে আসার কারণ হিসেবে অর্ধ শতাধিক পরিবার বলেছে কাজের সন্ধানে তারা বস্তিতে এসেছে। ২৯ শতাংশ পরিবার বলেছে তারা দারিদ্র্যের কারণে শহরে এসেছে, এক শতাংশ পরিবার বলেছে তারা নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিঃস্ব হয়ে বস্তিতে বাস করছে। এক শতাংশ মহিলা বলেছে সে ডির্ভোস হয়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়ে এবং শেষে বস্তিতে বসবাস করছে। দুই শতাংশ পরিবার বলেছে তারা নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভিটেমাটি ও গ্রাম ছেড়েছে, এখন বস্তিতে বসবাস করছে। বিশিষ্ট নগর বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের তাবৎ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মূল দর্শন হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। এ লক্ষ্যেই স্বাধীনতার পর থেকে সকল সরকারই তার যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু সরকারের এসব দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রমের সঙ্গে বস্তি উচ্ছেদ চরম সাংঘর্ষিক।
×