ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইএসের দায় স্বীকার বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল

বিদেশী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধনের ইঙ্গিত

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৫ অক্টোবর ২০১৫

বিদেশী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধনের ইঙ্গিত

শংকর কুমার দে ॥ ইতালীয় ও জাপানী দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনায় রাজনৈতিক ইন্ধনের ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারী ও গোয়েন্দারা। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল নয়, বিদেশীরা নিরাপদ নয়, অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি করা, দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলাই হচ্ছে দুই বিদেশী খুনের মোটিভ, নিহত দুই বিদেশী হয়েছে বলির পাঠা। দুই বিদেশী খুনের ঘটনার দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নামে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়ানোর ঘটনাকে বিভ্রন্তি ছড়ানোর কৌশল হিসাবে বেছে নেয়া হয়েছে বলে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা ও তদন্তকারীরা। তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-ের মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রংপুরে জাপানী নাগরিককে হত্যাকা-ের ঘটনায় তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে ছায়া তদন্ত করে যাচ্ছেন দেশের প্রায় সব ক’টি গোয়েন্দা সংস্থা। রংপুরে জাপানী হত্যাকা-ের ঘটনায় অজ্ঞাত তিনজনকে আসামি করে মামলা দায়ের, সিআইডি, জাপানী দূতাবাসের ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ সার্বিক ঘটনার তদন্তে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-ের ক্লু খুঁজে পেতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ গোয়েন্দারা। কিন্তু এখনও দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার তদন্তে গোয়েন্দারা অন্ধকারে। কোনকিছুরই হদিস পাচ্ছেন না তারা। ইতালি নাগরিক সিজার তাভেলা ও জাপানী নাগরিক হোসে কোনিওর প্রকৃত খুনীদের শনাক্ত করতে পারেনি। তবে দুটি হত্যাকা-তেই যে পেশাদার খুনীরা জড়িত সে ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিত গোয়েন্দারা। দুই বিদেশী হত্যাকা-ের ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে তাদের কাছ থেকে কোন আশাব্যাঞ্জক তথ্য পাচ্ছে না পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এদিকে যতই দিন যাচ্ছে ততই খুনীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চাপ বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ প্রভাবশালী বিদেশী দেশগুলো দুই বিদেশী খুনের তদন্তসহ সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা ও হোসে কোনিও হত্যায় ইসলামী স্টেট (আইএস) জঙ্গীদের জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পায়নি তদন্তকারীরা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের খবরে জানা গেছে, দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে মৃত্যুদ-াদেশ আপীলের রায় ঘোষণার পর এখন বিচারে রায় বাস্তবায়নের দিন ঘনিয়ে আসছে। যুদ্ধাপরাধীর গোষ্ঠী দেশের ভেতরে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ হত্যাকা- ঘটিয়েছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, গত ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আবার নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী পেট্রোল বোমার সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটনানোর পর এখন দেশ-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক লবিং করার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করার ঘটনার জের হিসাবে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে দুই বিদেশী হত্যাকা-ের সঙ্গে দেশীয় পেশাদার কিলাররা জড়িত এটা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু পেশাদার কিলার গ্রুপকে শনাক্ত ও গ্রেফতার করার পর্বের সঙ্গে কারা তাদের নিয়োগ করেছে সেই দিকটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিমের প্রথমে সফর স্থগিত, পরক্ষণে ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-, বিদেশীদের চলাচলে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ, তারপর ক্রিকেট দলের সফর বাতিল ঘোষণা, তারপর রংপুরে জাপানী হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো যেন একের পর এক সাজানো নাটকের মতো একই ছকে বাঁধা। একের পর এক ঘটনার ধারাবাহিকতা দেখলে মনে হয়, কোন মহল যেন আগে থেকেই এসব ঘটনা ঠিক করে রেখেছে, যা পর্যায়ক্রমে ঘটে গেছে মাত্র। গোয়েন্দা সংস্থা ও তদন্তকারীরা একমত হয়েছেন যে, দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় পেশাদার কিলাররা জড়িত, তারা দুটি হত্যাকা-ে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছে, দুটো হত্যাকা-েই ব্যবহার করা হয়েছে স্মল আর্মস। দুজনকেই গুলি করা হয় পেছন থেকে। খুনের ঘটনার পর দুই বিদেশীর কাছ থেকে কোনকিছুই নেয়নি খুনীরা। খুনীরা যদি খুনের পর নিহতদের কাছ থেকে কোনকিছুই নেবে না তবে তাদের এত ঝুঁকি নিয়ে খুন করা হবে কেন? নিশ্চয়ই খুনের পেছনে কোন মোটিভ আছে? সেই খুনের মোটিভ কি? খুনের টার্গেটই বা বিদেশীরা হবেন? সবকিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, খুনের মোটিভের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন বা মদদ আছে তা প্রায় নিশ্চিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্তকারী প্রতিনিধি দল, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সবারই অভিন্ন কথা দুই বিদেশী হত্যার মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে নাশকতার নীলনক্সার অংশ হিসেবে তাদের খুন করা হতে পারে। এ পরিকল্পনার সঙ্গে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত জড়িত থাকতে পারে। দুটি গোষ্ঠী অস্থিতিশীল করতে চায় ॥ রাজনৈতিক অঙ্গনের পর্যবেক্ষক মহলে দুই বিদেশী হত্যার পর যেই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে যে, দেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিরোধকে কেন্দ্র করে দেশী-বিদেশী মদদেই এ ধরনের হত্যাকা- ঘটানো হতে পারে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের জোট বিএনপি সরকারী দল আওয়ামী লীগের শাসনকে মেনে নিতে পারছেন না। ভেতরে ভেতরে আছে ছাই চাপা আগুন। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন। এর মধ্যে যানবাহনে পেট্রোলবোমা ও ককটেলের আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৭৪ জন নিরীহ মানুষ। কিন্তু সহিংস সে আন্দোলন সফল হয়নি, বরং আন্দোলনকারীরাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখন তাদের আর কোনভাবে অপেক্ষার পালা সইছে না। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে আরেকটি গোষ্ঠী। সেটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াত-শিবির। দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এর উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া ঠেকানো। সংসদে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া তথ্য অনুসারে শুধু যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত সহিংসতায় প্রাণ যায় ৮৮ জনের। এর মধ্যে শুধু ২৮ ফেব্রুয়ারি একদিনেই মারা যান প্রায় অর্ধশত। জামায়াত শিবির তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েও এতদিনে ঠেকাতে পারেনি যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া। তাদের দুই নেতাকে ইতোমধ্যেই ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আর এবার ফাঁসির রশির একেবারেই কাছে রয়েছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ আর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। পরবর্তী কার্যক্রম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চললে এ মাসেই তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়ে যাওয়ার কথা। তাই অতীতের ব্যর্থ পথে না গিয়ে বিএনপি-জামায়াত এবার একসঙ্গেই ফাঁসি ঠেকানোর নতুন কোন কৌশল নিতে পারে। এবারই প্রথম যুদ্ধাপরাধের জন্য বিএনপির বড় কোন নেতার ফাঁসি কার্যকরের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিদেশী নানা কানেকশনের কথা তো আমরা জানিই। তার মামলার রায়ের সময়ও নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠজনরা। বিদেশী নাগরিক হত্যা কি ফাঁসি ঠেকানোর নতুন কৌশলের অংশ কিনা তাও তদন্তকারী ও গোয়েন্দা সংস্থা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুজন বিদেশী নাগরিককে হত্যার ধরন একই এবং তা একই উদ্দেশে হয়ে থাকতে পারে। কিছু আলামত পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং বিদেশীদের কাছে দেশের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হিসেবে তুলে ধরতে এসব করা হচ্ছে। শীঘ্রই প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জাপানী হত্যা মামলায় অজ্ঞাত ৩ আসামি ॥ রংপুরে জাপানী নাগরিক হোসে কোনিও খুন হওয়ার ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। শনিবার মধ্যরাতের পর পুলিশের পক্ষ থেকে এ হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। শনিবার বেলা ১১টার কিছুক্ষণ আগে কাউনিয়া উপজেলার আলুটারি মহিষওয়ালা মোড়ে ৬৬ বছর বয়সী ওই জাপানীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মামলার এজাহারের বিবরণ দিয়ে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তিনজন মুখোশধারী হোসে কোনিওকে গুলি করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে তাদের কারও নাম এখনও মামলার এজাহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানান। আটক ছয়জনের মধ্যে রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদুন নবী খান বিপ্লব ও সাংগঠনিক সম্পাদক আনিছুর রহমান লাকুও রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। আটক অপরজনরা হচ্ছেন কোনিওর বাড়িওয়ালা মুন্সীপাড়ার জাকারিয়া বালা (৫৮) ও তার শ্যালক হীরা (৪৮), রিক্সাচালক মোন্নাফ আলী ও আলুটারি গ্রামের খোকা মিয়ার ছেলে মুরাদ হোসেন। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশে আসার পর রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ায় জাকারিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন হোসে কোনিও। সেখানে তিনি জমি ইজারা নিয়ে ঘাসের চাষ করছিলেন। গত সপ্তাহে ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ের মতোই হোসে কোনিওকে খুনের দায় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক উগ্রপন্থী দল আইএস স্বীকার করে নিয়েছে বলে জঙ্গী তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’ দাবি করেছে। ওই জঙ্গীগোষ্ঠী আরও হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে জানিয়ে তাদের টুইট উদ্ধৃত করে রয়টার্স বলেছে, ‘ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জোটের দেশগুলোর নাগরিকদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত থাকবে। মুসলমানদের মাটিতে তাদের নিরাপত্তা বা জীবিকা থাকবে না।
×