ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাজীরা জেদ্দা বিমানবন্দরে চরম দুর্ভোগের শিকার ॥ হজ মিশন নির্বিকার

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৫ অক্টোবর ২০১৫

হাজীরা জেদ্দা বিমানবন্দরে চরম দুর্ভোগের শিকার ॥ হজ মিশন নির্বিকার

বাবুল হোসেন, সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে ॥ জামালপুর সদরের পিয়ারপুর এলাকার খোকন আহমদ খান পাঠান হজ শেষে বাংলাদেশে ফেরার জন্য সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দরে যান গত ৩ অক্টোবর ভোরে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা শেষে বিমানে ওঠেন ৪ অক্টোবর (রবিবার)। বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে বিমানে ওঠার সময় পর্যন্ত খান পাঠানকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। সৌদি আরবে হজ শেষে বাংলাদেশের ময়মনসিংহগামী আরেক হাজী শাহ কামালকেও একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। অচেনা বিমানবন্দরে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। টয়লেটে শত শত হাজীর ভিড়। খাবার ও পানীয় জলের কারণেও কষ্ট হচ্ছে হাজীদের। বিমানবন্দর টার্মিনালের ইমিগ্রেশনের ভেতরে ও এর বাইরে বাংলাদেশ মিশনের বিমানবন্দর প্লাজায় শত শত হাজী প্রতিদিন দেশে ফেরার পথে এরকম অসহনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। জেদ্দা বিমানবন্দর প্লাজার বাংলাদেশ হজ মিশনের কর্মকর্তারা এই ক্ষেত্রে হাজীদের কোন ধরনের সহায়তা করতে পারছে না। মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনের কনস্যুলার আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, রবিবার থেকে যেসব হাজী জেদ্দা বিমানবন্দরে আটকা পড়বে তাদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জামালপুরের খান পাঠান ও ময়মনসিংহের শাহ কামালের মতো হাজার হাজার বাংলাদেশী হাজীকে দেশে ফেরার পথে জেদ্দা বিমানবন্দরে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশ হজ মিশনের কর্মকর্তারা হাজীদের জেদ্দা বিমানবন্দরে পাঠানোর পর হাজীদের কোন খোঁজখবর নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী হাজীরা। কোন ধরনের সহায়তা করছেন না বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তারাও। এ অবস্থায় প্রতিদিন বাংলাদেশে ফেরার পথে জেদ্দা বিমানবন্দরে হাজীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। জেদ্দায় বাংলাদেশ বিমানের রিজিওনাল ম্যানেজার (আরএম) আবু তাহের জনকণ্ঠকে জানান, বিমানের ফিরতি ফ্লাইট ঢাকা বিমানবন্দর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে তাদের কিছুই করণীয় নেই। আর জেদ্দা বিমানবন্দরে কর্মরত বাংলাদেশ হজ মিশনের গণসংযোগ কর্মকর্তা আনোয়ারের দাবি, জেদ্দা বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ হাজীরা শারীরিক অসুস্থতা, খাবার ও থাকা নিয়ে কোন ধরনের সমস্যায় পড়ছেন কিনা-এটি দেখভাল করছেন তারা। তবে বিমানের সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বিলম্বিত হাজীদের দুর্ভোগ নিয়ে তাদের করার কিছু থাকছে না। অপেক্ষমাণ হাজীদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে নিতে চাপ দেয়ার পাশাপাশি যেসব হাজীকে দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হবে তাদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে হজ মিশন বিমানবন্দর প্লাজা। দুর্ভোগের শিকার হাজীরা হজ মিশন কর্মকর্তাদের সামনেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাহলে জেদ্দায় হজ মিশন ও বিমান কর্মকর্তাদের পোষা হচ্ছে কেন? সরেজমিন জেদ্দা বিমানবন্দরে খোঁজ নিতে গেলে ভুক্তভোগী হাজীরা জানান, হজ শেষে দেশে ফেরার পথে সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দরে বাংলাদেশী হাজীদের নাভিশ্বাস চলছে। বিমানের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে গিয়ে হাজীদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। এ সময় সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার ও পানীয় জল শেষ হয়ে যাওয়ায় বয়োবৃদ্ধ নারী ও পুরুষ হাজীরা পড়ছেন বিপাকে। এছাড়া অচেনা বিমানবন্দরে বাথরুম সমস্যায় এসব হাজী বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। বিমানের ফিরতি ফ্লাইট শুরুর পর থেকে হাজীদের এ সমস্যা দেখা দিলেও নির্বিকার বাংলাদেশ হজ মিশন ও বিমান কর্তৃপক্ষ। জেদ্দা বিমানবন্দরের বাংলাদেশ হজ মিশন অফিস সূত্র জানায়, গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে বিমানের ফিরতি হজ ফ্লাইট শুরুর পর রবিবার পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানের ২৬টি ও সৌদি এয়ারলাইন্সের ৩৩টি ফ্লাইটে সৌদি আরব ছেড়েছেন ২৩ হাজার ৫২৬ হাজী। সিডিউল বিপর্যয়সহ বিমানবন্দরে চাহিদার সøট না পাওয়ায় জেদ্দা বিমানবন্দরে হাজীদের সমস্যা হচ্ছে স্বীকার করে মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশনের কনস্যুলার আসাদুজ্জামান জনকণ্ঠকে জানান, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। তবে এক সঙ্গে বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ হাজী দেশে ফেরার জন্য জেদ্দা বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত ভিড় করার কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান এই কর্মকর্তা। মক্কাস্থ বাংলাদেশ হজ মিশন অফিসে খোলা বাংলাদেশ বিমান কার্যালয়েও রবিবার দেখা গেছে হাজীদের প্রচ- ভিড়। এদের অনেকে বিমানের টিকেটের তারিখ আগে পিছে করার জন্য এসেছেন। বিমানের নির্ধারিত বাড়তি টাকা জমা দিয়ে অনেক হাজী ফিরতি ফ্লাইটের দিন তারিখ রিসিডিউল করার সুযোগ পাচ্ছেন। তবে ফিরতি ফ্লাইটের হাজীদের দুর্ভোগ নিয়ে কথা বলতে চাননি এই কার্যালয়ের কোন কর্মকর্তা। নির্বিকার হজ মিশন কর্মকর্তারা ॥ পবিত্র হজ উপলক্ষে মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় অবস্থানরত হাজীদের সমস্যা, অভাব-অভিযোগ শুনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ হজ মিশন। মিশনে আইটি শাখার কর্মকর্তা ছাড়াও মিশন কর্মকর্তারা সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। অভিযোগ উঠেছে এসব কর্মকর্তা হাজীদের দুর্ভোগ দুর্দশা কমানোর চেয়ে হাব নেতা ও হজ এজেন্সি মালিকদের সঙ্গে সারাক্ষণ দেনদরবার নিয়েই বেশি ব্যস্ত তারা। আর কমিশনের পদস্থ কর্মকর্তারা ব্যস্ত ভিআইপিদের প্রটোকল ও ফরমায়েস নিয়ে। তিনজন মন্ত্রীসহ প্রায় দুই ডজন ভিআইপি পরিবার ও স্বজন নিয়ে এখন মক্কা ও মদিনায় অবস্থান করছেন। প্রচার রয়েছে- হজ এজেন্সির নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান হুঙ্কার দিলেই মিশনের কর্মকর্তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জড়িত হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে ধর্মমন্ত্রী তদন্তের নির্দেশ দিলেই পকেট ভারি হচ্ছে মিশন কর্মকর্তাদের। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় মিশনে হজ এজেন্সি মালিকদের ঘন ঘন যাতায়াত বেড়ে যায়। মক্কাস্থ বাংলাদেশ মিশনের কনস্যুলার আসাদুজ্জামান মুখস্থের মতো সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, হজ ফ্লাইট শুরুর পর দু’দিন সমস্যা হয়েছিল মোয়াল্লেমদের অজ্ঞতার কারণে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে বলে দাবি এই কর্মকর্তার। হদিস নেই হজ কর্মীদের ॥ হজ শুরুর দিকে কিছু হজ কর্মীকে মক্কা ও মিনায় দেখা গেলেও হঠাৎ করে উধাও তারা। সরকার হাজীদের সহায়তাসহ পথের দিক নির্দেশনা দিয়ে সাহায্য ও হারিয়ে যাওয়া হাজীদের খুঁজে বের করার জন্য মক্কায় ১২০ জন, মদিনায় ৭০ জন ও জেদ্দায় ৩৪ জনসহ মোট ২২৪ হজ কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছিল। মক্কার হজ মিশন, ক্লিনিক ও ভাড়া করা বাড়িতে ২/১ দিন তাদের চেহারাও দেখা যায়। সর্বশেষ মিনার তাঁবুতেও হাতেগোনা কয়েক পোশাকি হজকর্মীর দেখা মেলে। কিন্তু মক্কা থেকে মিনায় যাওয়ার পর আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফায় হজকর্মীদের দেখা পায়নি কোন হাজী। ফলে আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা ও মিনা হয়ে মক্কায় ফেরার সময় পথ হারিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হয় হাজার হাজার হাজী। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে শতাধিক হাজী। এসব হজকর্মী দেশে ফেরার আগে হাজীদের সেবাদানের বদলে কেনাকাটা ও সৌদিতে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনদের কাছে বেড়ানো নিয়ে ব্যস্ত বলে জানা গেছে। মক্কার হিজরা রোডের ৯ নম্বর বাড়িতে দুইজন ও ইব্রাহিম খলিল রোডের ১০ নম্বর বাড়িতে চারজনসহ সরকারী হাজীদের জন্য ভাড়া করা আটটি বাড়ির প্রতিটিতে হজকর্মী নিয়োগ রয়েছে। কিন্তু এসব বাড়িতে থাকা হাজীদের অভিযোগ কোন হজকর্মীর সঙ্গে তাদের দেখা নেই। তৎপরতা নেই প্রশাসনিক টিমের ॥ হজ ব্যবস্থাপনায় মনিটরিংসহ হাজীদের সমস্যা সমাধান, এজেন্সির বাড়ি ভাড়া, এজেন্সি মালিকদের অভিযোগ, হাজীদের অভিযোগ দেখভাল করার জন্য সরকার থেকে ৩৫ সদস্যের দুটি প্রশাসনিক টিম পাঠানো হয় সৌদি আরবের মক্কায় ও মদিনায়। কিন্তু প্রশাসনিক টিমের সদস্যদের তেমন কোন তদারকি চোখে পড়েনি। এরই মধ্যে প্রথম ব্যাচে আসা একটি টিম দেশে ফিরে গেছেন। আর যারা এখনও মক্কায় আছেন তাদের কোন তৎপরতা নেই। জানা গেছে, প্রশাসনিক টিমের কোন কোন কর্মকর্তা হাব নেতা ও হজ এজেন্সি মালিকদের সঙ্গে কেনাকাটা ও দেন-দরবার নিয়ে ব্যস্ত। রোভার স্কাউটের ভূমিকায় হতাশ হাজীরা ॥ সরকার মক্কা ও মদিনায় হাজীদের সব ধরনের সহায়তা দিতে নানামুখী উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৮ সদস্যের একটি রোভার স্কাউট দল হজে পাঠায়। স্কাউট সদস্যরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে হাজীদের মক্কা ও মদিনায় সেবা দেয়ার পাশাপাশি হারিয়ে যাওয়া হাজীদের খুঁজে বের করে মিশনে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল। এছাড়া হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পর মক্কা থেকে মিনার তাঁবু, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা, জামারাতে পাথর নিক্ষেপসহ মক্কায় ফিরে আসা পর্যন্ত হাজীদের যাতায়াত পথে সহায়তা করার কথা ছিল। কিন্তু এসব পথে স্কাউটের কোন সদস্যকে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ হাজীদের। অভিভাবকহীন সরকারী ব্যবস্থাপনার হাজীরা ॥ মক্কা ও মদিনায় অবস্থানরত হাজীদের পাশে নেই কোন হজ গাইড কিংবা হজকর্র্মী। হজ মিশন কর্মকর্তারাও কোন খোঁজ রাখছেন না এসব হাজীদের। হজের শুরু থেকে মক্কা, মিনা, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা ও সর্বশেষ মদিনা গিয়েও হাজীরা পাশে পাননি কোন গাইড ও হজকর্মীর। এমনকি মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন বাড়িতে অবস্থান করা সরকারী ব্যবস্থাপনার হাজীরাও হদিস পাচ্ছে না দুই শতাধিক হজকর্মীর। এর ফলে অনেক হাজীর মক্কা থেকে মিনায়, আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা হয়ে ফের মক্কায় ফিরে আসার ক্ষেত্রে রাস্তাঘাট হারিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। কোন দিকনির্দেশনা না থাকায় মিনার জামারাতে পাথর নিক্ষেপ ও মক্কায় ফিরে ফিরতি তওয়াফ ও সাফা মারওয়া পাহাড় তওয়াফের মতো ফরজ ও ওয়াজিব কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হননি। এসবের বাইরে হোটেল ও বাড়িতে অবস্থান করা সরকারী ব্যবস্থাপনা হাজীদের নিয়মিত খাবার পানি ও টয়লেটের সাবান সরবরাহসহ রুম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। পানি নিয়ে প্রতিদিনই হাজীদের সঙ্গে হোটেল কর্মচারীদের বাগ্বিত-ায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে সরকারের বাড়তি কোটায় আসা পাঁচ হাজার হাজীর খাবার ও পানি সরবরাহ নিয়ে। নাটোরের গুরুদাসপুর থেকে পাঁচ হাজার হাজীর কোটায় আসা হাজী চান মোহাম্মদ অভিযোগ করে বলেন, পাহাড়ের টিলার ওপর থেকে তাদের সমতলের বাড়িতে শিফট করা হলেও হাজীদের সময়মতো খাবার দেয়া হচ্ছে না।
×