ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোন্দকার মুহম্মদ খালেদ

রোগ নিরাময়ের নিখুঁত শিল্পী

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৫ অক্টোবর ২০১৫

রোগ নিরাময়ের নিখুঁত শিল্পী

চিকিৎসা সেবাকে এক ধরনের শিল্পকলা মনে করেন তিনি। কেবল অর্থ উপার্জন নয়, এর বাইরেও চিকিৎসাশাস্ত্র ও চিকিৎসা সেবাকে একটি ভিন্ন আঙ্গিকে দেখারও সুযোগ আছে। তিনি এ পেশাকে বেছে নিয়েছেন ভিন্ন একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। রোগীর আর্থ-সামাজিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে চিকিৎসাবান্ধব একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারলে রোগীর মননকে স্পর্শ করা সহজ। এটা একটা শৈল্পিক কৌশল। এভাবে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক চিকিৎসা সেবাকে দৃশ্যমান মাত্রায় অর্থবহ করে। সেই অর্থে তিনি মানুষ সেবার কারিগরই শুধু নন- একজন নিখুঁত শিল্পীও বটে। ব্যতিক্রমধর্মী এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ। দেশের অন্যতম খ্যাতনামা ও স্বনামধন্য চিকিৎসক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং মেডিসিন বিভাগের ডিন। নিজস্ব বিশেষ গুণাবলীর জন্যই বিশেষ বিশেষ সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্থান থেকেও ডাক পড়ে ডাঃ আবদুল্লাহর। মনে পড়ে, ওয়ান-ইলেভেনের সয়মকার কথা। দুঃসহ এক পরিবেশ। রাজনীতিতে ‘মাইনাস টু’ বা ‘মাইনাস ওয়ান’ তত্ত্ব নিয়ে সর্বত্র আলোচনার ঝড়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সেনা-সমর্থিত মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের কারাগারে বন্দী। চারদিকে সংস্কারবাদী রাজনীতিকদের পদচারণা। বহু নেতা এড়িয়ে চলেন নেত্রীকে। নেত্রীর কারা ফটকের কাছে যেতেও ভয় অনেকের। সেই সময় হাতেগোনা যে দু-তিনজন চিকিৎসককে নেত্রী ডেকে পাঠাতেনÑ ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ তাদের অন্যতম। তিনি যেমন নেত্রীর চিকিৎসক, তেমনি সাধারণ রোগীদেরও একজন দরদী চিকিৎসক। একটি ঘটনা। অসাধারণ কিছু নয়, তবু প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়। রাজধানীর খুবই নামী এক স্কুলের শিক্ষক। দীর্ঘদিন যাবত জ্বরে ভুগছেন তিনি। চিকিৎসাও হয়েছে অনেক। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রচুর ওষুধ সেবন। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শে উনি গেলেন ডাঃ আবদুল্লাহর গ্রীন রোডের চেম্বারে। ডাক্তার সাহেব ওনাকে দেখে-শুধু তলপেটের একটি আলট্রাসনো করে আনতে বললেন। রিপোর্টে দেখা গেল-ওনার গলব্লাডারে পাথর এবং জ্বর সেকারণেই। রোগী পরে আমাকে বললেন, ‘ডাক্তার সাহেব যেভাবে অতি অল্প সময়ে ন্যূনতম প্যাথলজি পরীক্ষায় আমার রোগ নির্ণয় করলেনÑ তাতে আমার মনে হলো, ডাক্তার সাহেব রিপোর্টটা করিয়েছেন শুধু তার রোগ নির্ণয়কে নিশ্চিত করতে। এখানে ওনার চিকিৎসা শাস্ত্রীয় একটা অন্তর্দৃষ্টি মূলত কাজ করেছে। এই অন্তর্দৃষ্টি শক্তিটাই ওনার নিজস্ব স্বকীয়তা। একদিনে এটা অর্জিত হয়নি। নিজেকে তৈরি করেছেন তিনি পেশাগত জীবনের প্রথম থেকেই। তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে এসব চিত্র। ডাক্তার সাহেবের নিজের কথায়ই শোনা যাক কিছুটাÑ ‘১৯৭৯ সালে পাস করার পর যখন আমার গ্রামে পোস্টিং হলো, তখন একটি ডেলিভারির ডাক পড়ল আমার। ঘটনাটি ছিল এরকমÑ বাচ্চার শরীর বের হয়েছে, তবে মাথা পেটের ভেতর রয়ে গেছে। ওই পরিবারটির সামর্থ্য ছিল না রোগী শহরে নিয়ে যাওয়ার। চিকিৎসা আমাকেই করতে হবে। আমি তো গাইনোকলজিস্ট নই। কিভাবে চিকিৎসা করব? দ্বিধায় পড়ে গেলাম। তখন আমার একটাই চিন্তা-রোগীকেও বাঁচাতে হবে, বাচ্চাটাকেও। আল্লাহর রহমতে আমি সফল হয়েছিলাম। ডাঃ আবদুল্লাহ বললেনÑ কোন রোগীকে সুস্থ করে তোলাটাই আনন্দ। আর এই আনন্দ লাভের জন্যই রোগীকে আমি আপন করে নেই। রোগীবান্ধব সেবার মন-মানসিকতা ছাড়া রোগীকে আপন ভাবা যায় না। আর রোগীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি আমার চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম দর্শন। মনে পড়ে, দু’হাজার কি দু’হাজার এক সালের দিকে এদেশে ডেঙ্গু জ্বরের খুব প্রকোপ হয়েছিল। ওই সময়ে ডাঃ আবদুল্লাহ যেন মিশন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। রাত নেই, দিন নেই, তিনি ডেঙ্গু রোগীদের কি করে ভাল করে তুলবেনÑ সেই নেশায় মেতেছিলেন। ওই সময়ে মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরটা ছিল অপরিচিত। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিলÑ ডেঙ্গু হলে আর বাঁচার জো নেই। সে সময়টাতে ডাঃ আবদুল্লাহর সুচিকিৎসায় সিংহভাগ রোগী সুস্থ হন। বলতে গেলে ডেঙ্গু জ্বরের ভীতি থেকে মুক্তি দিতে ডাঃ আবদুল্লাহর অবদান ছিল অসাধারণ। ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহর এই সফলতা তো একদিনে আসেনি। নিখাত দেশপ্রেম ছাড়া তো মানবপ্রেম সম্ভব নয়। সেবা ও ত্যাগের মহান আদর্শ ছাড়া এই গুণাবলী অর্জন অসম্ভব। বিদেশে উচ্চ শিক্ষালাভ ও বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী লাভের পর দেশের বাইরে চাকরি করার লোভনীয় অফার তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু যাননি। আলাপচারিতায় একটি উক্তিতেই প্রমাণ মেলে তার দেশপ্রেমের। তিনি বললেন, ‘বাইরে অনেক লোভনীয় অফার ছিল। কিন্তু তাতে আমার মন সায় দেয়নি। আমি দেশে ফিরে আসি। কারণ আমার কাছে মনে হলোÑ এত ডিগ্রী নিয়ে বিদেশীদের সেবা দেব কেন। দেশের মানুষ আমার সেবা পাবে নাÑএটা তো রীতিমতো ক্রাইম। আমি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে চলে আসলাম।’ অত্যন্ত মেধাবী এই চিকিৎসক দেশে ফিরে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রেও রেখেছেন মূল্যবান অবদান। তার প্রকাশিত চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো দেশে-বিদেশে সমাদৃত ও পঠিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তার লেখা যে বইগুলো পড়ানো হয়-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শর্ট কেসেস ইন ক্লিনিক্যাল মেডিসিন, রেডিওলজি ইন মেডিক্যাল প্র্যাকটিস, ইসিজি ইন মেডিক্যাল প্রাকটিস, লং কেস ইন ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ইত্যাদি। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে শার্ট কেসেস ইন ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বইটি দু’বছর আগে ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশনে পুরস্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া তিনি গণমাধ্যমে লেখালেখি করেন প্রচুর। বড় পত্রিকাগুলোতে তার স্বাস্থ্য বিষয়ক এবং স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হচ্ছে অহরহ। ওষুধের ভুল ব্যবহার, অপচিকিৎসার কুফল, চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমে তার লেখাগুলো বহুল প্রশংসিত। বাংলাদেশের আর দশটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার হাড়িয়াবাড়ী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহর জন্ম। ১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া এই মানুষটি অত্যন্ত মিষ্টভাষী ও বন্ধুবৎসল। বাল্যজীবনে প্রথমে তিনি ভর্তি হন জামালপুর হারিয়াবাড়ী প্রাইমারী স্কুলে। প্রাইমারী শেষ করে ইসলামপুর নেকজাহান হাইস্কুলে ভর্তি হন। গ্রামীণ জনপদের খুবই সীমিত সুযোগ-সংবলিত ওই স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। তিনি স্কুল জীবনে সব সময়েই ছিলেন ক্লাসের ফার্স্ট বয়। খেলাধুলায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। সব সময়েই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হতেন। ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকা এসে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৭২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকা মেডিক্যালের প্রথম ব্যাচই ছিল ওনাদের। ’৭৮ সালে পাস করেই তিনি চলে যান পোস্টিং নিয়ে তার সেই চিরপরিচিত গ্রামে। পরে ঢাকা মেডিক্যালে পোস্টিং পান। তার চাকরি জীবনের এক পর্যায়ে ১৯৮৪ সালে তিনি সৌদি আরব যান। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে এসে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য মনস্থির করেন। ১৯৯২ সালে লন্ডনের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি দেশে ফিরে এসে পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৫ সালে তৎকালীন আইপিজিএসআর (পিজি) এর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই রয়েছেন। কর্মজীবনে একজন রোগীবান্ধব সফল চিকিৎসক হিসেবে অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ এখন অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি ব্যস্ত থাকেন তিনি মানুষের সেবায়। ব্যক্তিগত জীবনে ডাঃ আবদুল্লাহ অত্যন্ত সদালাপী, মিষ্টভাষী, অতিথিপরায়ণ এবং রোগীবান্ধব। পোশাক-আশাক, চলা-ফেরায় অতি সাধারণ। নিরহঙ্কার এই মানুষটির ভূষণ যেন তার বিনয়ী স্বভাব। নিজ গ্রাম ও এলাকার লোকজনের কাছে তিনি অত্যন্ত দরদী ও পরোপকারী হিসেবে সুপরিচিত। তার পারিবারিক জীবনও আলোকময়। স্ত্রী নূরজাহান বেগম রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ছেলে সাদি আবদুল্লাহও একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। মেয়ে সাদিয়া সাবাও মেডিসিনের চিকিৎসক। লেখক : সাংবাদিক
×