প্যানিক এ্যাটাক বা ‘হঠাৎ আতঙ্কগ্রস্থতা’ এমন একটি মানসিক রোগ যার লক্ষণগুলো আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের দেয়া ডিএসএম-এর নির্ধারিত উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকতে হয়। উল্লিখিত উপসর্গগুলো হচ্ছে-
* স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তির মধ্যে হঠাৎ ভয় দেখা দেয়া।
* মাসে কমপক্ষে ৪ বার বা একাধিকবারও এটাক হওয়া। তবে ‘আবার হবে’ এই ভয় মনে তীব্রভাবে বিরাজ করে।
এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সময় নিম্ন বর্ণিত উপসর্গগুলোর কম পক্ষে
৪টি উপসর্গ দেখা দেয়া
১. হঠাৎ বুক ধড়ফড় করা, দম বন্ধের অনুভূতি বা শ্বাসকষ্ট, অনিয়মিত হার্টবিট
২. অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
৩. মারা যাওয়ার ভয়
৪. হাত- পা অবশ হয়ে আসা/সমস্ত শরীরে কাঁপুনি হওয়া
৫. মাথা-নাক-কান-গলা-ঘাড় দিয়ে গরম ভাপ বের হওয়া
৬. বুকে ব্যথা ও অস্বস্তি বোধ
৭. গলায় কিছু আটকান অনুভূতি/বমি বমি ভাব/পেটে অস্বস্তি বোধ করা
৮. মাথা ঝিমঝিম করা/ঘোরা/ হালকা ব্যথা/অজ্ঞানের মতো হয়ে যাওয়া
৯. অপছন্দের পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়
১০. পাগল হয়ে যাওয়ার ভয়
১১. অস্বাভাবিক কিছু করে ফেলার ভয়
১২. আশপাশের সব কিছুকে অপরিচিত মনে হওয়া
ক্স প্যানিক এ্যাটাকের সময় উল্লিখিত উপসর্গের অন্তত ৪টি উপসর্গ ১০ মিনিটের মধ্যে তীব্র পর্যায়ে পৌঁছবে। এর কোনো শারীরিক কারণ পাওয়া যায় না। তবে মাদকাসক্তির মতো কারণ আছে কিনা তা লক্ষণীয় ব্যাপার।
কারণ
এই রোগের সৃষ্টি হয় ব্যক্তির পারিপার্শি¦ক অবস্থা, দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক চাপ মস্তিষ্কের কিছু জৈর রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়ার কারণে, বংশগত কারণে, সমভ্রƒণ বা অভিন্ন যমজদের মধ্যে এ রোগে সমানভাবে ভোগার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত বেশি দেখা যায়। এই রোগের স্থায়ু রাসায়নিক ভিওি পরীক্ষা করার সময় মূলত নজর দেয়া হয়েছে ইপিনেফ্রিন ও নরইপিনেফ্রিন নামক দুটি নিউরোট্রান্সমিটারের ওপর। মস্তিষ্কের পন্স এ লোকাসসেরুলিয়াস নামে নিউক্লিয়াসের কোষরা সংবাদ আদান-প্রদানে মূলত নরইপিনেফ্রিনকে ব্যবহার করে। লোকাসসেরুলিয়াসকে উত্তেজিত করলে ইপিনেফ্রিন নিঃসৃত হয় এবং ভয় পেলে প্রাণীর মধ্যে যেসব আচরণ দেখা যায় এ ক্ষেত্রে তা দেখা দেয়।
ধারণা করা হয়- ল্যাকটেট ও কার্বণ-ডাই অক্সাইড মস্তিষ্কের রক্তের পিএইচকে খুব দ্রুত নামিয়ে দেয়। ফলে প্যানিক এ্যাটাকে দেখা গেছে যেসব ব্যক্তি প্যানিক এ্যাটাকে ভুগছে তাদের শরীরের ল্যাকটিক এসিড পুশ করল্,ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বেশি বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যস নিলে বা আইসোপ্রোটেরেনল বা ক্যাফেইন গ্রহণ করলে তেমন উপসর্গ দেখা যায়।
কিছু কিছু শারীরিক রোগের উপসর্গের সঙ্গে এই প্যানিক এ্যাটাক বা হঠাৎ আতঙ্কগ্রস্ততার উপসর্গের সাদৃশ্য রয়েছে। আর এ জন্যই অনেক সময় ব্যক্তি ঐ সব শারীরিক রোগে আক্রান্ত হয়েেেছ বলে ভুল করে ফেলে। রোগগুলো হচ্ছে- এ্যানজাইনা, মাইট্রাল ভাল্ব প্রোলেপস, হার্ট ফেইলিওর, এ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, হরমোনজনিত অসুস্থতা থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতা বা আর্ধিক্য, প্যানক্রিয়াসে টিউমার, নারীদের রজোনিবৃত্তি, সিসটেমিকলপাস ইরাথোমেটাসাস ইত্যাদি।
অন্যান্য মানসিক রোগের
মধ্যে বা সঙ্গে-
১. শুচিবায়ু
২. দীর্ঘমেয়াদী
৩ সামাজিক ভীতি
৪. এ্যাগোরোফোবিয়া
৫. নেশা করে ছেড়ে দেয়ার পর প্যানিক এ্যাটাক হতে পারে।
আবার এই রোগে দীর্ঘদিন ভুগলে কি কি পরিণতি হতে পারে তা একবার দেখে নেই-
বিষণœতায় ভোগা, নেশায় জড়িয়ে পড়া, ঘুমের সমস্যা, এ্যাগোরোফোবিয়া,আত্মহত্যার চিন্তা বা প্রবণতা, মানব দেহের রেস্পারেটরি সিস্টেমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সময় মতো সঠিক চিকিৎসা না করালে এই রোগীরা বিভিন্ন ডাক্তারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে সর্বস্বান্ত হয় এবং সব শেষে নিজেকে একজন বড় রোগের রোগী ভেবে বা হার্টের রোগী বলে কাজকর্ম ছেড়ে দেয়।
চিকিৎসা
ওষুধ এবং মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার সমন্বিত প্রয়োগের মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়। ওষুধের মধ্যে এমন ওষুধ দেয়া হয় যা রোগটি ভাল হাওয়ার ক্ষেত্রে ২৫% থেকে ৩০% বা কখনও কখনও ৪০ থেকে ৫০% ভাগ পর্যন্ত সাহায্য করে। আর মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মধ্যে ‘কগনেটিভ বিহ্যাবিয়ার থেরাপী’ এর প্রয়োগ সব থেকে বেশি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এই থেরাপীর মাধ্যমে রোগটির ভয়ের বিষয়কে এড়িয়ে না গিয়ে কিভাবে তার মোকাবেলা করা যায় এবং তাকে আয়ত্ত করে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা যায় তা রোগীকে শেখান হয়। এই ‘সি বি টি’ চিকিৎসা পদ্ধতিতে সহজেই আরোগ্য লাভ করা যায়। তবে চিকিৎসাটি দীর্ঘদিন ধরে করলে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা আবশ্যই সম্ভব। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়মিত কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হবে। পরিবারের অন্য ব্যক্তিদের এই রোগী কিভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় তা জরুরী ভীত্তিতে জানতে হবে।
সর্বোপরি এ রোগ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা, রোগীদের সঠিক রোগ নির্ণয় এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা আমাদের সামাজিক সার্বিক দায়িত্ব।
তন্বিতা ঘোষ
সাইক্লোজিস্ট এ্যান্ড থেরাপিউটিক কাউন্সিলর
এমএসসি (মনোবিজ্ঞান)
পিজিটি বিএসএমএমইউ)
মোবাইল : ০১৯১২-০৭৬৮৩৯
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: