গাফফার খান চৌধুরী ॥ অবশেষে ঢাকা ও রংপুরে দুজন বিদেশীকে ফিল্মি স্টাইলে গুলি করে হত্যার পর আইএসের পক্ষে দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়া সংস্থাটি শনাক্ত হয়েছে। যেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর থেকে পরিচালিত হচ্ছে। সংস্থাটির পরিচালক বহুল আলোচিত মহিলা রিটা কাৎজেকেও শনাক্ত হয়েছে। রিটা কাৎজে সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটি একটি বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিশ্বের একটি প্রভাবশালী বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করতেই একের পর এক ব্লগার এবং দুই বিদেশী হত্যা এবং সোমবার পাবনায় চার্চের এক ফাদারকে হত্যাচেষ্টা করা হতে পারে। আর এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদা বা আইএসের জড়িত থাকার দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রচার করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টিই অত্যন্ত সুপরিকল্পিত বলে দেশী-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকার গুলশান-২ নম্বর কূটনৈতিকপাড়ার ৯০ নম্বর সড়কের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমানের সরকারী বাসভবনের প্রাচীর দেয়ালের দক্ষিণ পাশে ফিল্মি স্টাইলে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলাকে (৫০) গুলি চালিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। একটি মোটরসাইকেলযোগে ৩ হত্যাকারী ৯০ নম্বর সড়ক সংলগ্ন ৮৩ নম্বর সড়কের মাথায় অবস্থান নেয়। প্রতিদিনের মতো তাভেলা গুলশানের আমেরিকান স্কুলের সুইমিংপুলে সাঁতার কেটে গুলশান-২ নম্বরের ৫৪ নম্বর সড়কের ১১/বি নম্বর ভাড়া বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় এক সন্ত্রাসী মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। দুজন তাভেলাকে খুব কাছ থেকে পর পর ৩টি গুলি চালিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়।
তাভেলা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও আইসিসিও কোঅপারেশন বাংলাদেশের প্রফিটেবল অপরচ্যুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ছিলেন। এনজিওটি ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে পানি, সেনিটেশন, রিফিওজি সমস্যা ও পুনর্বাসনসহ নানা সমাজসেবামূলক কাজ করে আসছে। চলতি বছরের ১৫ মে সিজার বাংলাদেশে যোগদান করেন। ইতোপূর্বে অন্তত ১০টি দেশে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিওতে কাজ করেছেন তিনি।
এমন ঘটনার আগে এদিনই নাশকতার অজুহাতে বাংলাদেশে নির্ধারিত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল তাদের সফর বাতিল ঘোষণা করে।
তাভেলা হত্যা ও অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সফর বাতিল নিয়ে যখন সারাদেশে হৈচৈ চলছে ঠিক তারই মধ্যে গত ৩ অক্টোবর রংপুরে তাভেলার মতো একই কায়দায় সন্ত্রাসীরা গুলি চালিয়ে হত্যা করে জাপানী নাগরিক হোসে কোমিওকে (৪৮)। পুলিশ সন্দেহভাজন ৪ জনকে আটক করে। নিহত জাপানী বাংলাদেশে ব্যবসা করছিলেন। গ্রামের পথে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ সময় একটি মোটরসাইকেলযোগে তিন সন্ত্রাসীর মধ্যে একজন জাপানীকে তাভেলার মতোই পর পর ৩টি গুলি চালিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই ওই জাপানীর মৃত্যু হয়। এমন ঘটনায় বাংলাদেশস্থ জাপান দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত সোমবার পাবনার ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’ এর ফাদার লুক সরকারকে (৫০) ঈশ্বরদীর বাসায় গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে তিন সন্ত্রাসী। ফাদারের চিৎকারে পরিবারের লোকজন ও স্থানীয়রা এগিয়ে গেলে হত্যাচেষ্টাকারী তিন মোটরসাইকেল ফেলেই পালিয়ে যায়। পুলিশ বলছে, উগ্র মৌলবাদী বা জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্যরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
ইতালীয় ও জাপানী খুনের পর হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস (ইসলামিক স্টেট) এর তরফ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। বিবৃতিটি এসআইটিই (সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিস্ট এন্টিটিজ) নামের একটি ওয়েব সাইট থেকে প্রকাশিত হয়। ওয়েবসাইটটি জঙ্গীগোষ্ঠীর ওপর নজরদারি করে থাকে বলে প্রকাশ পায়। এমন ঘটনায় স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব থাকার বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তরফ থেকে কথা ওঠে। যদিও বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তরফ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে আইএসের কোন তৎপরতা নেই।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দুই বিদেশী খুনের ঘটনায় আইএসআইএস-কে জড়িয়ে বাংলাদেশে প্রথম সংবাদ প্রচারকারী হিসেবে রিটা কাৎজকে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি এসআইটিই (সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেরোরিস্ট এন্টিটিজ) নামের একটি বেসরকারী গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই আইএসের হয়ে বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহর থেকে ওয়েবসাইটটি পরিচালিত হচ্ছে।
রিটা কাৎজে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাবেক পরিচালক জোসেফ ডেভনের সঙ্গে কাজ করেছেন। অনর্গল আরবী ভাষায় কথা বলতে পারেন রিটা কাৎজে। তিনি ছদ্মবেশে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের আন্দোলনে থেকেছেন। সেখানে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’-এর হয়ে কাজ করেছেন।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, রিটার কর্মকা- নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। রিটা কোন বেসরকারী সংস্থায় কাজ করেন নাকি কোন গোয়েন্দা সংস্থার বেসরকারী মুখপাত্র হিসেবে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছেন, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।