ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিশুদের ব্যতিক্রমী স্কুল ঢাকা ও রূপগঞ্জে

ক্ষুদে ইঞ্জিনিয়ার তৈরির কারখানা- প্রযুক্তি আনবে পরিবর্তন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৬ অক্টোবর ২০১৫

ক্ষুদে ইঞ্জিনিয়ার তৈরির কারখানা- প্রযুক্তি আনবে পরিবর্তন

মীর আব্দুল আলীম ॥ রাজধানী ঢাকায় এবং পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গড়ে উঠেছে ব্যতিক্রমধর্মী এক স্কুল। স্কুলের ক্ষুদে সব শিক্ষার্থী হাতে-কলমে ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ শিখছে এবং করছেও দক্ষতার সঙ্গে। এদের সবার বয়স ৭ থেতে ১৬ বছরের বেশি নয়। ছোট্ট বয়স থেকে যেন একেকজন হয়ে উঠছে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। নিজ নিজ বিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি ছুটির দিনে ইঞ্জিনিয়ারিং শিখছে এই শিশুরা। আর এ উদ্যোগটি নিয়েছেন রূপগঞ্জের এক তরুণ যিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ করার আগেই এ কাজে হাত দেন। তিনি নিলয় হোসেন অনিক। এ ধরনের স্কুল শুরু করার পেছনে নিলয়ের মূল উদ্দেশ্য ছিল যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা এবং প্রযুক্তি দিয়ে দেশ তথা গোটা বিশ্বে পরিবর্তন আনা। রূপগঞ্জের ভুলতা এলাকার নিলয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফর চিল্ডেন এই সেøাগানে ‘দ্য টেক স্কুল’-এর উদ্বেগ সবখানে প্রশংসিত হতে থাকে। সাধুবাদের পাশাপাশি সেটি বাহবাও পায়। নিলয়ের এ অসাধারণ কাজটি ভাল একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন সবাই। প্রশ্ন হলো ক্ষুদে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর আইডিয়াটা নিলয়ের মাথায় এলো কি করে? যারা নিলয়ের ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ফর চিল্ডেন’ স্কুলে ভর্তি হচ্ছে তারা নিজ নিজ স্কুলের পড়ালেখার পাশাপাশি এ বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করছে। এখানে পড়াশোনা করা অনেক ক্ষুদে ইঞ্জিনিয়ার আবার এ বিদ্যালয়ে রীতিমতো শিক্ষকতাও করছে দক্ষতার সঙ্গে। ২০১৩ সালের কথা। তখন তার কয়েক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ুয়া বন্ধুদের সহায়তায় কিছু পথশিশুদের নিয়েই এর পথচলা শুরু হয় নিলয়ের। এসব শিশুদের চিন্তা-শক্তিকে বাড়িয়ে তোলা এবং হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। নিলয় বলেন, আমার মনে পড়ে একটা শিশুর ইচ্ছা ছিল সে রকেট বানাবে। তো তাতে রকেট সায়েন্সের ওপর বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখানো, বোতল দিয়ে রকেটের বিভিন্ন মডেল বানানো, এর পেছনে ফিজিক্সের বিভিন্ন আইনের ব্যাপারে ধারণা দেয়া, এসবের মাধ্যমে তাকে আরও আগ্রহী করে তোলাটাই থাকত আমার চেষ্টার মধ্যে। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে একটা সময় প্রজেক্টটা বন্ধ করে দিতে হয়। আর এই ব্যর্থতাই আমার মাঝে একজন উদ্যোক্তার জন্ম দেয়। আমি অনুভব করি আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাকে একটা সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন কাঠামো নিয়ে ভাবতে হবে। তারপর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আবারও আমি কাজ শুরু করি। আমার নতুন লক্ষ্য এবার মধ্যবিত্ত পরিবারের বাচ্চারা। নিকেতনে একটা বাসা সাবলেট নিয়ে শুরু করি নতুন আরেক অধ্যায়। কিছু শিক্ষার্থীও পেয়ে যাই। ওদের নিয়ে পরিকল্পনা ছিল পদার্থ, কম্পিউটার বিজ্ঞান, সাইকোলজি, আর্কিটেকচার, ফিলোসফি এবং রোবটিকস বিষয়গুলো থেকে তারা ইচ্ছামতো বিষয় নিয়ে ইঞ্জিরিয়ারিং পথে এগোবে এবং শিখবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা এবং পরিচিত শুভাকাক্সক্ষীরা সাহায্য করতে আগ্রহী হয়ে গেল। এর পরও ঝামেলার শেষ নেই। অভিভাবকদের কাছে এ আইডিয়াটা গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে পরিকল্পনাও বেশিদিন টিকল না। তারপর আর বেশি চিন্তা না করে ফোকাস করলাম শুধু রোবটিক্সের ওপর। সঙ্গে একজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে শুরু করলাম ওনেস স্কুল অব রোবটিক্স (ডঘঊঝ ঝপযড়ড়ষ ড়ভ জড়নড়ঃরপং). এবারও একই লক্ষ্য, এটাতেও অভিভাবকরা খুব একটা আস্থা দেখালেন না। কিন্তু তার পরেও পেয়ে গেলাম কিছু ব্যতিক্রমধর্মী অভিভাবক এবং খুবই আগ্রহী শিক্ষার্থী। জাওয়াদ তাদের মধ্যে একজন। সে এখনও আছে আমার স্কুলে, কিন্তু ছাত্র হিসেবে নয়, সহকারী শিক্ষক হিসেবে। তার বয়স ১২। ধীরে ধীরে পেয়ে গেলাম সাফওয়ান, টোনার, সাইমানসহ আরও অনেককে। তাদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিযোগিতা এবং আয়োজনে সক্রিয় অংশগ্রহণে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি ও আবিষ্কার আস্তে আস্তে সবাইকে এ ব্যাপারে ভাবাতে শুরু করে। তারপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এবং এ সাফল্যে জন্ম দেয় আরেক নতুন অধ্যায়ের ‘দ্য টেক স্কুল’। শুরুটা রাজধানী ঢাকার গুলশান নিকেতনে হলেও বর্তমানে নিজ এলাকা রূপগঞ্জে গড়ে উঠেছে দ্য টেক স্কুলের শাখা। স্কুলটিতে মাত্র ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সের বাচ্চাদের ইঞ্জিনিয়ারিং তথা প্রোগ্রামিং ইলেট্রনিক্স, রোবটিক্স এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেখানো ছাড়াও টেক স্কুল রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট বা দ্য টেক ফার্মে বিভিন্ন রিয়েল লাইফ প্রজেক্ট ডেভেলপ করার কাজ শেখানো হয়। যদিও প্রচলিত স্কুলিং সিস্টেমের ঠিক উল্টোটা বেশ ভালভাবেই চর্চা হয়। দ্য টেক স্কুলে যেটা করা হয় সেটা বাচ্চাদের ইচ্ছাকে প্রচ- রকমভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক, ডেভেলপার, স্টাফ কাউকেই এমন কিছু শিখতে বা করতে হয় না যেটার ব্যাপারে তার কোন ইচ্ছা বা আগ্রহ নেই। এটাই যে কোন শিক্ষাব্যবস্থা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা করে তোলে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সবার জন্য এক সেখানে প্রত্যকের জন্য আলাদা ব্যবস্থা টেক স্কুলে। নিজেকে একটা প্রশ্ন করলেই অনুভূতির প্রকৃত অর্থটা বোঝা যাবে। তাই দ্য টেক স্কুলকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলাই নিলয়ের লক্ষ্য। নিলয় বলেন, একজন শিশু যে বিষয়ে তার ক্যারিয়ার গড়তে চায় তার জন্য একমাত্র এবং পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে দ্য টেক স্কুল। আর এটাকে সারা বাংলাদেশে এবং ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া নিলয়ের স্বপ্ন বা ইচ্ছা। নিলয় ও তার সহযাত্রীরা বাংলাদেশের প্রত্যকটা শিশুকে টেকনোলজি ডেভেলপার হিসেবে দেখতে চায় এবং বাস্তবায়ন আশা করে তাড়াতাড়িই হবে। টেক স্কুলে বর্তমান পরিকল্পনা মতো, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক দক্ষ হলে তাদের টেক ফার্মে ডেভেলপার হিসেবে জয়েন করতে পারে। বর্তমানে সেখান থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন টেকনোলজিক্যাল সলিউশন বা প্রোটোটাইপ ডেভেলপ করে দেয়া। দ্য টেক স্কুলের কর্ণধার নিলয় হোসেন আরও বলেন, ‘আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা খুব শীঘ্রই টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবশ করা। যার মাধ্যমে টেকনোলজি সবার হাতে হাতে নিয়ে আসতে পারব বলে আমি বিশ্বাস করি।’
×