ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

খেলা নেই, পড়ে আছে সুসজ্জিত স্টেডিয়াম;###;সামিউল ইসলাম শোভন

বিদ্রোহের অনলে দেশের হকি!

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৭ অক্টোবর ২০১৫

বিদ্রোহের অনলে দেশের হকি!

খেলোয়াড়রা দাবি জানিয়েছেন দলবদল করার সুযোগ করে দেয়া হোক। এই দাবিতে দাঁড়িয়েই তারা জাতীয় দলের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বয়কট করেছে। গত প্রায় দুই বছর ধরে লিগ বন্ধ। খেলোয়াড়রা বেকার। তারা এখন মাঠে নামার জন্য অস্থির। এক কথায় অধির আগ্রহে অপেক্ষমাণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন হকি খেলোয়াড়ের সবচেয়ে বড় উপার্জনটা আসে লিগ থেকে। কারণ, জাতীয় দলে খেললেও আমরা তাদেরকে তেমন আর্থিক সহায়তা দিতে পারি না। তো, সেদিক দিয়ে বিবেচনা করতে গেলে আমি মনে করি অবশ্যই তাদের দাবি যৌক্তিক।’ বলছিলেন বাংলাদেশ হকি ইতিহাসের অন্যতম তারকা খেলোয়াড়ের একজন রফিকুল ইসলাম কামাল। সাবেক এই খেলোয়াড় একই সঙ্গে ফেডারেশন ও ঊষা ক্লাবে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশে হকির অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা যে দাবিতে ফেডারেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, সেটাও পুরনো। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? যে দেশের ক্রিকেট দিনে দিনে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, যে দেশের ঘরোয়া ফুটবলে এখনও জোয়ার নামে। দলবদলে ফুটবলারদের নিয়ে টানাটানি চলে সেদেশে হকির মতো একটি জনপ্রিয় খেলায় আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের কথা না হয় বাদই দিলাম, ঘরোয়া লিগটা পর্যন্ত হচ্ছে না! বর্তমান অবস্থা নিয়ে সাবেকরা কথা বললেও, হঠাৎ করেই যেন রং বদলে ফেললেন দলের বেশকিছু খেলোয়াড়। সবকিছু নিয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল তাপস বর্মনের সঙ্গেও। কিন্তু সাফ জবাব, ফেডারেশনের অনুমতি ছাড়া কথা বলবেন না। অন্যদিকে তারাই আবার দলবদলের দাবিতে ফেডারেশনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদিকে সাবেকরা মনে করছেন সনবকিছু থেকে বের হয়ে আসতে লিগ আয়োজনের বিকল্প নেই। কামালের ভাষায়, ‘আমরা যখন খেলতাম তখনও এই অবস্থা ছিল। দলবদল হবে কিনা, সেটা নিয়ে চিন্তা থাকতই। তবে আমাদের সময়ে যখন শাহবাজ-তাহির জামান, আবাহনীতে ধনরাজ পিল্লাই-মুকেশ কুমার, মোহাম্মদ শাকিলের মতো খেলোয়াড়রা লিগে খেলতে আসতেন, তখন আবহাওয়াটা অন্যরকম ছিল। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম। ক্লাবগুলো সবাই মিলে লিগ করতে চায় না। আবার যখন লিগ করতে চেষ্টা করে তখন বেঁকে বসে কয়েকটি ক্লাব। এখানে ফেডারেশনের আসলে তেমন কিছুই করার নেই। তবে তারা যদি স্পন্সর যোগাড় করে দিতে পারত, অর্থের ব্যবস্থা হতো, তাহলে হয়ত ক্লাবগুলো আগে বাড়ত। কিন্তু তেমন কোন নিয়ম আসলে নেই।’ এক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার রয়েছে। স্পন্সর। হকিতে লিগ কিংবা টুর্নামেন্ট না হওয়ার পিছনে আর্থিক সঙ্কট বেশ প্রকট। কারণ, হকিতে অর্থ কম। তাই ভাল স্পন্সর আসে না। কিন্তু তারপরেও তো খেলাটাকে চালিয়ে নিতে হবে। কি উপায়? ‘ঊষা কামাল’ পরিচিত রফিকুল ইসলাম কামালের মতে, ফেডারেশন যদি এমন কিছু করতে পারত যে লিগে অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক। না খেললে শাস্তির দেয়া হবে তাহলে হয়ত অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন আসলেও আসতে পারে। বলে রাখা ভাল, গত দুই বছর ধরে লিগ মাঠে না গড়ানোর মূলে নির্বাচন। হকির ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই পাঁচটি ক্লাব লিগে খেলতে আসছে না। এর মধ্যে আবার ফেডারেশনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছেই। মাঝখান থেকে আয়-রোজগার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন খেলোয়াড়রা। কামাল বলেন, ‘পাচটি ক্লাব খেলবে না, বাকিরা খেলবে। এটা খেলোয়াড়দের জন্যই নেতিবাচক। তাতে করে অন্তত ১০০ জন খেলোয়াড় কোন দলই পাবে না।’ ক্লাব সম্পর্কে যায়ই বলা হোক না কেন, ক্লাবগুলোই আসলে বাংলাদেশ হকির মূল চালিকা শক্তি। ফেডারেশন হকির উন্নয়ন করবে, ফেডারেশন ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক খেলা আয়োজন করবে। কিন্তু হকি খেলোয়াড়দের জীবিকা অর্জনের যে ব্যাপারটা, সেটা ক্লাব থেকেই। তাই ক্লাবগুলো যদি এগিয়ে না আসে, অথবা আশু সমাধান না করে তাহলে সমস্যা আরও প্রকট হবে বৈ কমবে না একটুও। এদিকে দলবদলের সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে হকি ফেডারশনের সাধারণ সম্পাদক খাজা রহমতুল্লাহকে অপসারণের দাবি উঠেছে। কিন্তু সাবেকরা উত্তরসূরিদের এই দাবিতে কতটুকু একমত? আবারও রফিকুল ইসলাম কামাল। তিনি বললেন, ‘কিছু কিছু সময়ে কিছু অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি আপনাকে মেনে নিতেই হবে। এখানে ছোট হওয়ার কিছু নেই। দু’বছর আগের সেই নির্বাচনের সময় থেকেই খাজা রহমতুল্লাহকে অপসারণের দাবি করা হচ্ছিল। তবে তিনি এমন কিছুই করেননি যাতে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি নির্বাচিত। শুধু দলবদল নয়। কোচিং প্রসঙ্গে দ্বিমত রয়েছে। একজন বিদেশি কোচ আনতে গেলে মাসে তিন-চার হাজার ডলার গুনতেই হবে। কিন্তু বর্তমানে দায়িত্ব পাওয়া সাবেক খেলয়াড় মামুনুর রশিদকে কোচের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মাসিক ২৫ হাজার টাকা বেতনে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে হকির মতো একটি জনপ্রিয় খেলার জাতীয় দলের কোচ মাত্র ২৫ হাজার টাকা বেতনে কাজ করবেন তাও আবার ফুলটাইম, সেটা নিয়ে আপত্তি থেকেই যায়। কামাল কোচিং কমিটির সেক্রেটারি হিসেবেও এই ব্যাপারটিকে সমর্থন করেন না। ২৫ হাজার টাকা বেতন দেয়া নিয়ে এরই মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সে কারণেই কিনা কামাল বললেন, ‘যখন আমরা কোচ নির্বাচন করি, তখনই আমরা বেতন বাড়ানোর জন্য আবেদন করি। আমাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয়। পরবর্তীতে বর্তমান বেতনের ৫০ ভাগ বাড়িয়ে দেয়া হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। একজন বিদেশি কোচকে আনলে তিন-চার হাজার ডলার গুনতে হয়। সেখানে দেশী কোচকে নামমাত্র এই বেতনের ব্যাপারে ফেডারেশনের আরও একটু চিন্তা করা উচিত। আমি মনে করি বিদেশি কোচের মতো, দেশী কোচের জন্যও যদি স্পন্সর যোগাড় করে ভাতা বাড়ানো যায়, তাহলে অনেক ভাল হবে।’ হকির যেন ‘সারা গায়ে ব্যথা’। হকির উন্নতির জন্য যে পরিকল্পনাগুলো গত দু’বছর আগে নেয়া হয়েছিল, সেটা দু’বছর পর আবার আগের জায়গাতেই ফিরে গেছে। কামালের ভাষায়, ‘দু’বছর আগে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেখানেই আবার নেমে গেছি।’ তবে এখনও সময় রয়েছে সুদিন ফিরিয়ে আনার। সেটা কিভাবে? পুরো ব্যাপারটাই লিগের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করেন কামাল। পাশাপাশি স্কুল হকি আবার চালু করার প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রিমিয়ার ডিভিশনের সারাদেশের খেলোয়াড়রা আসবেন। কিন্তু এসে যদি খেলতেই না পারেন তাহলে সেটা দুঃখজনক। আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন স্কুল টুর্নামেন্ট থেকে শুরু করে সবখানেই স্পন্সরের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আবার সব হারিয়েছি আমরা। এর মূল কারণ, মাঠে হকি নেই। ‘নতুন করে আবারও আলোর মুখ দেখবে হকি। নিজেদের স্বপ্নকে সত্যি করতে পারবেন, এমন আশা করতেই পারেন কামালরা। তবে আক্ষেপ যেন কিছুতেই ঘুচছে না। কণ্ঠের হতাশাটা সহজেই ধরা পড়ে একটি বাক্যেই- ‘দু’বছর আগে যেখান থেকে হকির উন্নতির জন্য কাজ শুরু করেছিলাম, দু’বছর পর সেখানেই আবার ফিরে এসেছি’।
×