ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অতশী রহমান

‘গোল মেশিন লেভানডোস্কি’

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৭ অক্টোবর ২০১৫

‘গোল মেশিন লেভানডোস্কি’

সময়ের দুই সেরা তারকা লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো নামডাক নেই। তবে যদি সার্বিক পারফরমেন্স বিবেচনা করা হয় তাহলে সাম্প্রতিক সময়ে এই দুই মহাতারকাকেই পেছনে ফেলবেন রবার্ট লেভানডোস্কি! অনেকের কাছেই বিষয়টি আপত্তিকর মনে হতে পারে। তবে আরও একবার নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছেন বেয়ার্ন মিউনিখের পোলিশ তারকা। মেসি ও রোনাল্ডোর বদনাম আছে, তারা ক্লাবের হয়ে আকাশছোঁয়া সাফল্য পেলেও নিজ নিজ দেশের হয়ে কিছুই করতে পারেন না। কিন্তু লেভানডোস্কির এই বদনাম নেই। কি ক্লাব, কি জাতীয় দল সবখানেই সমানতালে গোল পেয়েছেন তিনি। গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে কি অবিশ্বাস্য কা-ই না করেছেন। বুন্দেসলীগার ম্যাচে উলফসবার্গের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠ মিউনিখের অ্যালিয়েঞ্জ অ্যারানায় প্রথমার্ধে এক গোলে পিছিয়ে ছিল স্বাগতিক বেয়ার্ন মিউনিখ। বিরতির পর পরই থিয়াগো আলকান্তারার বদলে লেভানডোস্কিকে মাঠে নামান বাভারিয়ান কোচ পেপ গার্ডিওলা। মাঠে নামার ছয় মিনিটের মধ্যেই শুরু হয় লেভানডোস্কির ম্যাজিক। ৫১ মিনিটে করেন প্রথম গোল। এরপর ৬০ মিনিটের মধ্যে করলেন আরও চার গোল! সবমিলিয়ে মাত্র ৯ মিনিটে করলেন ৫ গোল!! সাময়িক এই ঝড়েই ল-ভ- হয়ে যায় উলফসবার্গ। এবারের লীগে বেয়ার্নকে প্রথমবারের মতো ধাক্কা দেয়ার স্বপ্নও ভেস্তে যায়। অনন্য এই কীর্তিতে কয়েকটি গৌরবময় রেকর্ডের মালিক হয়েছেন পোলিশ তারকা। মাঠে নামার ছয় মিনিটের মধ্যে প্রথম গোল করেন লেভানডোস্কি। ৫১ মিনিটে টমাস মুলারের পাস পেয়ে খুব কাছ থেকে বল জালে পাঠান তিনি। পরের মিনিটে ডি বক্সের বাইরে থেকে দ্বিতীয় গোলটি করেন এই স্ট্রাইকার। হ্যাটট্রিকের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি সাবেক বরুসিয়া ডর্টমুন্ড তারকাকে। মাত্র তিন মিনিট ২২ সেকেন্ডের মধ্যে নিজের তৃতীয় গোলটি পেয়ে যান তিনি। তার প্রথম শট বারে লেগে ফিরে আসে, দ্বিতীয় শট ফিরিয়ে দেন গোলরক্ষক, তবে তৃতীয় শট কোন বাধা মানেনি, সোজা আশ্রয় নেয় জালে। বেয়ার্নের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে এটাই লেভানডোস্কির প্রথম গোল। ৫৭ মিনিটে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ডগলাস কোস্টার দারুণ ক্রসে ১২ গজ দূর থেকে জোরালো শটে চতুর্থ গোলটি করেন লেভানডোস্কি। ৬০ মিনিটে দুর্দান্ত এক ভলিতে পঞ্চম গোলটি পেয়ে যান এই স্ট্রাইকার। নয় মিনিটে পাঁচ গোলের রেকর্ডের পাশাপাশি সবচেয়ে কম সময়ে হ্যাটট্রিক করার নতুন রেকর্ড গড়েছেন ২৭ বছর বয়সী এই তারকা। প্রথম তিনটি গোল করতে তিনি সময় নিয়েছেন মাত্র পাঁচ মিনিট ১৯ সেকেন্ড। এছাড়া সাত মিনিট ৪২ সেকেন্ডে করা চতুর্থ গোলটিও বুন্দেসলীগার নতুন রেকর্ড। আর পঞ্চম গোলটি করেছেন নয় মিনিটের মধ্যে। ১৯৯১ সালের আগস্টে কার্লশ্রুইয়ের বিরুদ্ধে ডুইসবার্গের ৬-২ গোলে জয়ের ম্যাচটিতে মাইকেল টোয়েনিস পাঁচ গোল করেছিলেন। তারপর বুন্দেসলীগায় এটাই প্রথম পাঁচ গোলের ঘটনা। তবে বদলি হিসেবে নেমে পাঁচ গোল করা খেলোয়াড় লেভানডোস্কিই প্রথম। এতসব রেকর্ডের মধ্যে অবশ্য একটি ব্যক্তিগত রেকর্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বেয়ার্ন তারকা। ১৯৭৭ সালে ওয়ের্ডার ব্রেমেনের বিরুদ্ধে কোলন ৭-২ গোলে জয়ী হয়েছিল। সেই ম্যাচে ডিয়েটার মুলার একাই ছয় গোল করেছিলেন। যা এখন পর্যন্ত এক ম্যাচে বুন্দেসলীগার কোন খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাকি ৩০ মিনিটে এই রেকর্ড ভাঙতে পারেনি লেভানডোস্কি। কিন্তু দ্রুততম সময়ে পাঁচ গোলের রেকর্ড ঠিকই গড়েন তিনি। লেভানডোস্কির এমন কীর্তি তো এটাই প্রথম নয়। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিফাইনালে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে তিনি একাই করেছিলেন চার গোল। তাঁর সেই কীর্তি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই ম্যাচ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেভানডোস্কি বলেছেন, চ্যাম্পিয়নস্ লীগের সেমিফাইনালে রিয়ালের বিরুদ্ধে চার গোল করা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা আমার ক্যারিয়ারে অনেক বড় একটি গল্প। কিন্তু এবার পাঁচ গোল করে সেই ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে গেছি। ম্যাচ শেষে উচ্ছ্বসিত লেভানডোস্কি আরও বলেন, আমি সত্যিই খুব খুশী। আমি যখন খেলতে নামি তখন বেয়ার্ন ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিল। আমি জানতাম আরেকটু চেষ্টা করলেই জয় সম্ভব। কিন্তু পাঁচ গোল করা সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমি কোনো দিন ভাবিনি যে এমন কিছু করতে পারব। অবিশ্বাস্য এক কা- ঘটালাম। ম্যাচ শেষে ঘোরের মধ্যে ছিলেন বেয়ার্ন কোচ পেপ গার্ডিওলাও। তিনি আসলেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না চোখের সামনে কিছুক্ষণ আগে তিনি যা দেখেছেন তা সত্যি কি না। গার্ডিওলা বলেন, আমার চোখের সামনে এমন কিছু ঘটবে, সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার কোচিং জীবনে এমন অনন্য ঘটনার মুখোমুখি আমি আগে কখনও হইনি। উফ্?! নয় মিনিটে পাঁচ গোল!! তবে রবার্ট কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এই দুনিয়ারই অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার। লেভানডোস্কি দ্রুততম সময়ে হ্যাটট্রিক করে ভেঙ্গে দিয়েছেন ডুয়েসবার্গের মিচেল টোয়েন্নিয়েসের রেকর্ড। ১৯৯১ সালে টোয়েন্নিয়েস বুন্দেসলীগার এক ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ছয় মিনিটের ব্যবধানে। লেভানডোস্কির কীর্তিতে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে টোয়েন্নিয়েস বলেন, রবার্ট এই রেকর্ড নিজের করে নিয়েছে, সে জন্য ওকে অভিনন্দন। আমি ২৪ বছর ধরে রেকর্ডটি দখলে রেখেছিলাম। সেই দখল হারিয়ে খারাপ যে লাগছে না সেটা বলব না। আমি তৃপ্ত যে রবার্টের মতো একজন দারুণ স্ট্রাইকারের কাছে হার মানলাম। সে যা করেছে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। উলফসবার্গের বিরুদ্ধে গোল-উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই ২৬ সেপ্টেম্বর মেইঞ্জের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হয় লেভানডোস্কির দল। আর এই ম্যাচেও জোড়া গোল করেন তিনি। এর ফলে দল জিতে ৩-০ গোলের বড় ব্যবধানে। সেইসঙ্গে নতুন এক মাইলফলকও গড়েন ২৭ বছর বয়সী লেভানডোস্কি। জার্মানির বাইরের ফুটবলার হিসেবে বুন্দেসলীগায় দ্রুততম শততম গোল করার অবিস্মরণীয় কীর্তি গড়েন তিনি। এই টুর্নামেন্টে ১৬৮ ম্যাচ খেলে ১০০ গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি। এর দুইদিন পর আবারও ঝলক দেখান। এবার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফুটবলে ক্রোয়েশিয়ার ক্লাব ডায়নামো জাগরেবের বিরুদ্ধে চোখ ধাঁধানো হ্যাটট্রিক করেন। এরপর ৪ অক্টোবর বুন্দেসলীগায় বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে করেছেন দুই গোল। অর্থাৎ প্রতিটি ম্যাচেই প্রতিপক্ষের জাল অবলীলায় খুঁজে পাচ্ছেন ২৭ বছর বয়সী এই পোলিশ।
×