ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৯৮ ভাগ নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ এই সম্পর্ক;###;বিষাক্ত ভাইরাসের মতো ছড়াচ্ছে হত্যাকা-ের প্রবণতা

সমাজে পরকীয়া থেকে খুনের ঘটনা বাড়ছেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৭ অক্টোবর ২০১৫

সমাজে পরকীয়া থেকে খুনের ঘটনা বাড়ছেই

শর্মী চক্রবর্তী ॥ মোবাইল ফোনে পরিচয়ের মাধ্যমে সোনিয়ার প্রেম হয়েছিল রুবেলের সঙ্গে। চার বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল তাদের। ততদিনে এলএলবি পাস করা সোনিয়াকে বিয়ে দিতে তার পরিবার উঠেপড়ে লাগে। এরই মধ্যে ঘটকের বদৌলতে বর হিসেবে খোঁজ আসে ওবায়দুল হাসানের। ওবায়দুল বন্দর নগরীর প্রতাপশালী এক রাজনীতিবিদের ভাগ্নে হওয়ায় ওই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করে তাহমিনা খাদিজা সোনিয়ার পরিবার। এতে সোনিয়ার দ্বিমত থাকলেও পছন্দের পাত্র রুবেলের পড়াশোনা তখনও শেষ হয়নি। তাই পরিবারের চাপ ও রুবেলের বেকারত্বের দায়ে শেষ পর্যন্ত গত বছরের ১৪ নবেম্বর ওবায়দুলকে বিয়ে করেন সোনিয়া। তবে পুরনো প্রেমিককে তিনি তখনও ভুলতে পারেননি। বিয়ের পরও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বিয়ের ৮ মাস না পেরুতেই পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাধার স্বপ্ন বিভোর হয়ে নিজের স্বামীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। সেই পরিকল্পনা থেকেই গত ২৬ জুন রাতে কর্মস্থল বসুন্ধরা সিটি থেকে রিক্সায় বাসায় ফেরার পথে সার্কুলার রোডে হত্যা করা হয় ওবায়দুলকে। সেই হত্যাকা-কে প্রথমে ছিনতাই বলে চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী মাহমুদুল হাসান মিঠু ও তানভীর আহমেদকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় ওবায়দুল হত্যার নেপথ্যে ছিল পরকীয়া। শুধু ওবায়দুলই নয়, পরকীয়া প্রেমের কারণে এমন অনেক নারী-পুরুষের প্রাণ যাচ্ছে। পরকীয়া সমাজের একেবারে নতুন উপাদান নয়। তবে বিশেষত বাংলাদেশের সমাজে এ ধরনের সম্পর্ক এতটা সর্বগ্রাসী আগে কখনই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পরকীয়া মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ই অবৈধ্য প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এই প্রেমের টানে সংসার ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন অজানা গন্তব্যে। পরিবার-পরিজন, স্বামী-সন্তান সবই তুচ্ছ করে অবৈধ্য সম্পর্কটা তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভাঙ্গনের প্রধান কারণ হলো পরকীয়া। অজ্ঞতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, অবৈধ সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত করতে পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে পর্যন্ত লিপ্ত হয়ে যায়। এমনকি এই পরকীয়া সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য হত্যাকা-ের মতো ঘটনা ঘটায় অনেকে। এতে পরিবারে নেমে আসে অশান্তি। বিশেষ করে সন্তানদের ওপর প্রভাব পড়ছে বেশি। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধার কারণে এ ধরনের অনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়কেও একটি বড় কারণ মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। ভিনদেশী টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন প্রোগ্রাম ছাড়াও ইদানীং দেশে তৈরি অনেক নাটক-সিনেমাতেও পরকীয়াকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সুখ নষ্ট হয়। একটি সমাজকে নষ্ট করে দেয়ার জন্য পরকীয়া বিষাক্ত ভাইরাসের মতোই কাজ করে বলে তারা মনে করেন। পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে অনেকে হিতাহিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে। সন্তান তাদের এ সম্পর্কে বাধা দিলে কিংবা প্রতিবাদ করলে সন্তানের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দিতেও তাদের অন্তর কাঁপে না। স্ত্রীর পরকীয়া স্বামী ও সন্তান হত্যার মতো লোমহর্ষক অনেক ঘটনা ঘটেছে। আবার স্বামীর পরকীয়ার বলি হচ্ছেন অনেক স্ত্রী। পরকীয়ার কারণে সংসার ও প্রিয় স্ত্রীর প্রতি সকল ভালবাসা ভুলে তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে স্বামীর বিবেকে বাধা দিচ্ছে না। অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক এখন শুধু যুবক-যুবতীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে পড়েছে কিশোর-কিশোরীর মধ্যেও। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় চলতি বছর এ পর্যন্ত সারাদেশে ৩ হাজার ৬১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১৭২ জন। যার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক কারণে খুন হয়েছে ১৬২ জন। নারীদের নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংস্থা আছে। সেখানে অভিযোগের ফাইল খুললেই দেখা যায় বর্তমানে পরকীয়া মাত্রা বেড়ে গেছে। কারণ সেখানে বেশিরভাগ অভিযোগ হলো পরকীয়ার কারণে স্ত্রীর ওপর স্বামীর নির্যাতন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৯৮ ভাগ নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণই হচ্ছে পরকীয়া। প্রযুক্তির কল্যাণে এমন সম্পর্কে আজকাল জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই। বিশেষ করে ফেসবুক ও মোবাইলফোনে নারী-পুুরুষের সম্পর্ক প্রথমে বন্ধু হিসেবে গড়ে ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব থেকে তা প্রেমের সম্পর্কে পরিণত হয়। অদেখা ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমে জড়াচ্ছেন বিবাহিতরা। এই সম্পর্কের প্রভাব এতবেশি যে, ধর্ম-বর্ণ, বয়সের বাধ না মেনেই তা এগিয়ে যায়। যার ফলে তচনছ হয়ে যায় সুন্দর, সাজানো সংসার। স্ত্রীর পরকীয়ায় স্বামী খুন ॥ দুই সন্তানের জননী লাভলী আক্তার লীনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল একাদশ শ্রেণীর ছাত্র তানভীর আহমেদের। কাজীর কাছে নিজ বিয়ের কথা গোপন রেখে তানভীরকে বিয়েও করে লীনা। গত বছরের ১৯ অক্টোবর রাতে মিরপুর ১০-এর সি-ব্লকে গিয়াসকে হত্যা করে তার স্ত্রী লীনার প্রেমিক ও বন্ধুরা। রাত সাড়ে ১০টার পর গিয়াস বাসায় ঢুকতেই তাকে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করে তানভীর। এরপর এলোপাতাড়ি তাকে আঘাত করে তানভীর ও তার দুই বন্ধু। একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করলে গিয়াস মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এ ঘটনায় গ্রেফতারের পর বিএন কলেজের ছাত্র তানভীর জানিয়েছিল, লিনার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক জানার পর লীনাকে মারধর করতেন গিয়াস। এতে গিয়াসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে লীনা। তাকে লীনা প্রায়ই বলত, তাদের ভালবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে গিয়াস। তাকে ডিভোর্স দিলেও সে শান্তিতে থাকতে দেবে না তাদের। এজন্য গিয়াসকে মেরে ফেলতে হবে। শেষ পর্যন্ত নিজ স্ত্রীর নির্দেশেই হত্যা করা হয় গিয়াস উদ্দিন মাতব্বরকে। স্ত্রীর হাতে খুন না হলেও স্ত্রীর প্রেমিকের হাতে জীবন দিতে হয়েছে মিরপুরের গিয়াস উদ্দিন মাতব্বরকে। মায়ের অবৈধ সম্পর্কে বাধা দেয়ায় ছেলে খুন ॥ গত ১২ আগস্ট পত্রিকার রিপোর্টে জানা যায়, কামরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত কামরুজ্জামানের বাবা মোঃ আশক আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ডেমরা থানায় ১৩ আগস্ট একটি হত্যা মামলা করেন। ১ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্তভার ডিবিতে ন্যস্ত হয়। অবৈধ প্রেমে বাধা দেয়ায় সন্তানকে খুন করেন মা মরিয়ম বেগম। এ ঘটনায় মা ও তার প্রেমিক মোঃ আজিজুল হক ওরফে আজিজসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এছাড়া গত ১৬ অক্টোবর রাজধানীর কল্যাণপুরে একাধিক বিয়ে করার কারণে বটি দিয়ে কুপিয়ে সালাহ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে খুন করে তার স্ত্রী লাবনি আক্তার। স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন ॥ গত ২৯ জুন বরগুনায় স্বামীর পরকীয়ায় বাধা দেয়ায় স্ত্রী মিনারা বেগমকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় প্রতিবেশী খাদিজা (৩০) নামে এক নারীকে আটক করেছে পুলিশ। নিহতের বাবা আঃ মান্নান বলেন, দেলোয়ারের দ্বিতীয় স্ত্রী মিনারা। তার সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে দেলোয়ার পরকীয়া করে আসছিলেন। এতে বাধা দেয়ায় মিনারার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান তিনি। একপর্যায়ে নির্যাতনের পর মিনারার গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে হত্যা করে দেলোয়ার। পরকীয়ার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান পুলিশ। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাহবুবা নাসরীন বলেন, দেশের মানুষের নৈতিক অবক্ষয় হয় তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এক সময় ডিভোর্স ছিল লজ্জার বিষয় কিন্তু বর্তমানে কোন কিছু হলেই ডিভোর্স দিয়ে দেয়া হয়। এ যেন কোন বিষয়ই না। অবৈধ সম্পর্কে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। বর্তমানে সবার মাঝেই আধুনিকায়নের ছোয়া লেগেছে। সে ছোয়ায় এই অবক্ষয় দেখা দিয়েছে বেশি। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য প্রফেসর খন্দকার মোকাদ্দেম হুসেন বলেন, দেশের মানুষের এখন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। জৈবিক চাহিদা, মানসিক নির্ভরতা, আর্থিক নিরাপত্তাসহ নানা কারণে নারী-পুরুষ উভয়ই পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পরে। শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। আগে স্বামী বা স্ত্রী সংসারের জন্য যে টান ছিল বর্তমানে তা দেখা যায় না। তারা পশ্চিমা বিশ্বের অনেকদিক থেকে প্রলুব্ধ হচ্ছে। এসব কারণে বর্তমানে বাড়ছে পরকীয়া। পরকীয়া সম্পর্কে জড়ানোর ফলে পরিণতি অনেক খারাপ হয়। জীবনের সবকিছু শেষ হয়ে যায়। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে প্রথমতো সব শ্রেণীর মধ্যে এই সম্পর্কের কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যেবোধ সমুন্নত রাখতে হবে। সামাজিক অবক্ষয়ও দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই সামাজিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যাবে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে ধর্মীয় মূল্যেবোধ সৃষ্টি করতে হবে। প্রত্যেক ধর্মে মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়।
×