ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘন নীল আকাশে ভাসেনি সাদা মেঘের ভেলা-কাশ শিউলির উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৭ অক্টোবর ২০১৫

ঘন নীল আকাশে ভাসেনি সাদা মেঘের ভেলা-কাশ শিউলির উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ মাত্র দুই মাস সময়। এরই মাঝে বদলে যায় প্রকৃতি। বছরে বদলায় ছয় বার। এ কারণেই ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। ঋতু বদলের প্রক্রিয়ায় এখন শরত কাল। ১ ভাদ্র শুরু হয়েছিল। আজ আশ্বিনের ২১। অর্থাৎ, আর মাত্র কয়েকদিন। এর পরই বিদায় নেবে প্রিয় ঋতু। তবে তা পঞ্জিকার হিসেবে। আদতে শরত দেখার এখনও বাকি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা-/ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা...। না, এখনও ঘন নীলে সাজেনি আকাশ। সাদা মেঘের ভেলা ভাসেনি। শরত শেষ হতে চললেও, সময়টা আসি আসি করছে। প্রতীক্ষা করে আছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। অবশ্য যথারীতি হেসে ওঠেছে কাশবন। শিউলি কোড়ানোর দিন এসেছে। প্রকৃতিতে যেমন পরিবর্তন, মনেও তা-ই। শরতের আবেদন উপেক্ষা করতে পারছেন না ছেলে বুড়ো কেউ-ই। সময়টা দারুণ উপভোগ করছেন। প্রিয় ঋতুর রং রূপে নিজেকে খুঁজছেন, যেমন খুঁজেছেন কবিরা। শিল্পীরা। এখন বাংলার প্রায় প্রতি প্রান্তে দোল খাচ্ছে কাশের গুচ্ছ। নদীর ধারে, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে সাদা ফুল দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনকি রাজধানী শহর ঢাকায় আছে একাধিক কাশবন। বিশেষ করে উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকাটি ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। এখানে বিশাল খোলা জায়গা। পুরোটাই কাশবন। গোটা শহরের মানুষ বেড়াতে যাচ্ছে। যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও একটি বিশাল কাশবন চোখে পড়ছে। জায়গাটির নাম কোনাপাড়া। এর পাশ দিয়ে হাঁটা পথ। যেতে আসতে কাশবনের শরতটুকু দেখা হয়ে যায়। এমনই দেখা শেষে হয়ত রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- আবার আর-এক দিকে চড়ার উপরে বহুদূর ধরিয়া কাশবন; শরৎকালে যখন ফুল ফুটিয়া উঠে তখন বায়ুর প্রত্যেক হিল্লোলে হাসির সমুদ্রে তরঙ্গ উঠিতে থাকে ...। শরতের আরেক অনুসঙ্গ শিউলি। প্রতি রাতেই ফুটছে প্রিয় ফুল। কাশের কোন ঘ্রাণ হয় না। তবে শিউলির বেলায় বিপরীত। কী যে মিষ্টি ঘ্রাণ! এ ঘ্রাণেই ভর করেছে শরত। শিউলি অবশ্য শেফালি নামেও পরিচিত। কাশের গুচ্ছ আর শেফালিমালায় শরত খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথও। কবিগুরু তাই লিখেছেন- আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে...। প্রেমের কবি নজরুল শরত দেখতে বেশি তাকিয়েছেন শিউলির পানে। শরত দেখতে গিয়ে শিউলি আর শিউলি দেখতে গিয়ে শরত দেখেছেন তিনি। মুগ্ধ কবি তাই লিখেছিলেন- এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।/এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...। অন্যত্র কবির উচ্চারণ- শিউলিতলায় ভোর বেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী-বালা।/শেফালি পুলকে ঝ’রে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতলা...। প্রায় একই রকম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে কবিগুরু লিখেছেন- শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে।/আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে...। হৃদয়ের কিছু লুকোনো ব্যথাও হয়ত খুঁড়ে তুলে আনে শরত। তা না হলে নজরুল কেন লিখেন- শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথি কই...। একই রকম বিরহের প্রকাশ ঘটিয়ে কবি লিখেন- দূর প্রবাসে প্রাণ কাঁদে আজ শরতের ভোর হাওয়ায়।/শিশির-ভেজা শিউলি ফুলের গন্ধে কেন কান্না পায়...। কিছু পাওয়ার আকুতি শোনা যায় কবিগুরুর কণ্ঠেও। তিনি লিখেছেন- আজি শরততপনে প্রভাতস্বপনে কী জানি পরান কী যে চায়।/ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে বিহগ বিহগী কী যে গায় গো...। এভাবে বন ও মনের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ হয়ে আসে শরত। তবে সে পরিবর্তন দেখার চোখ থাকা চাই। উপলব্ধি করার মতো মন আবশ্যক। আছে তো সেই চোখ? মনটি আছে তো?
×