ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ নাটকের আদ্যোপান্ত

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ৮ অক্টোবর ২০১৫

ঈদ নাটকের আদ্যোপান্ত

বাংলাদেশী নাটক বরাবরই অন্যান্য নির্মাণের চেয়ে খ্যাতির শীর্ষে। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও এর ব্যাপক চাহিদা। বাজেট কমে যাওয়া আর চ্যানেল বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন গত ক’বছর ধরেই বৃদ্ধি পেয়েছে সস্তা নাটক নির্মাণ। তবে, এই ঈদে কিন্তু মানসম্মত অনেক নাটক দেখতে পেয়েছেন দর্শকরা। কিছু চ্যানেল বিরতিহীন নাটক প্রদর্শনের কারণে তালিয়া কুড়িয়েছে খুব। বিস্তারিত নিয়ে লিখেছেন মাহবুবুর রহমান সজীব ঈদের ছুটি তিন-চারদিন। বাসে ঝুলে, জ্যাম ঠেলে কারও অফিসে-ভার্র্সিটিতে যাওয়ার তাড়া নেই। নিশ্চিন্তে নাটক দেখতে তো বসে পড়াই যায়! আগে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচুর বিরক্তির উদ্রেক করত। বিষয়টা ঠিক এমন ছিল। নাটকের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন না, বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকেই নাটক দেখাত চ্যানেলগুলো। ঈদ উপলক্ষে এবার কিছুটা কমেছে তা। গাজি টেলিভিশন তো পুরো ঈদ অনুষ্ঠানমালাই সাজিয়েছে বিরতিহীনভাবে! কোন বিজ্ঞাপন নেই, ভাবা যায়! সপ্তাহব্যাপী ঈদ আয়োজনে জিটিভির পর্দাজুড়ে ছিল প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত এয়ারটেল নিবেদিত বিরতিহীন টেলিফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ভালোবাসা ১০১, ভিটামিন টি, মানকি বিজনেস, ভালোবাসি তাই,ভালোবাসার বিশ বছর, ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই, অলটাইম দৌড়ের ওপর, আমাদের গল্প; এই আলোচিত টেলিফিল্মগুলো পুনরায় মানুষ আগ্রহভরেই দেখেছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টায় ছিল গাজী গ্রুপের সৌজন্যে বাংলাদেশের বরেণ্য নাট্য পরিচালকদের নাটক। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ছিল আঞ্চলিক ভাষায় ঘণ্টাব্যাপী বিশেষ নাটক। রাত সাড়ে ৮টায় ঈদের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ছিল চয়নিকা চৌধুরীর ‘হৃদয়ের গহীনে’, শিহাব শাহিনের ‘নীলাঞ্জনা’, অনিমেষ আইচের ‘অনুগমন’, মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘ফ্যান পেজ’, তানিম রহমান অংশুর ‘আপনার অনুভূতি কী’, শারলিন আশফাক নিপুনের ‘অবাক ভালোবাসা’, ইমরাউল আরাফাতের ‘ইমোশনাল’। রাত সাড়ে ১০টায় ছিল গ্রামীণফোন নিবেদিত তানিম রহমান অংশুর পরিচালনায় তরুণদের জন্য সাত পর্বের বিশেষ ধারাবাহিক। ঈদ-উল-আজহার সঙ্গে উদ্যাপিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল স্যাটেলাইট চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’য়ের জন্মদিন। এজন্য ঈদ উৎসবের সঙ্গে ছিল জন্মদিনের উৎসবও। ঈদ ও জন্মদিন এই দুই উৎসবকে একত্র করে চ্যানেল আইয়ের পর্দায় আয়োজন করা হয়েছে ৯ দিনের আনন্দউৎসব। এ উৎসবের অনুষ্ঠানমালায় ছিল হুমায়ূন আহমেদের ‘ভালবাসার গল্প’, ফরিদুর রেজা সাগরের ৮ পর্বের ‘রাজশাহীর রসগোল্লা’সহ মোট ২১টি নাটক। বরাবরের মতো এবারও খ- নাটক ছিল প্রচুর। সপ্তাহব্যাপী সেই নাটক টেনে নিতে গিয়ে কিছু কিছু হারিয়েছে মান, কিছু কিছু বেশ পরিপাটি মনে হয়েছে। যার মধ্যে এটিএন বাংলার ৬ খ-ের নাটক ‘এই শহরে মেয়েরা একা’, ‘ভ্যাগাবন্ড’, ৫ খ-ের নাটক ‘প্যারাসিটামল দুইবেলা’, আরটিভির ৬ পর্বের ধারাবাহিক ‘প্যারা’, ‘কপালে যদি থাকে হাড়, ‘ফরমাল-ইন রি-এ্যাকশন’ খুব ভাল হয়েছে। এনটিভির বিশেষ ধারাবাহিক নাটক ‘নিশ্চিত প্রেমের ৭টি উপায়’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’ও সুনাম কুড়িয়েছে। একুশে টেলিভিশনে প্রচারিত ধারাবাহিক ‘চেয়ারম্যানের তেলেসমাতি’, ‘ব্রোকেনহার্ট’, ‘সতর্ক সমশের’ও যথেষ্ট মানসম্মত ছিল। বাংলাভিশন যে কেন এখনও সিকান্দার বক্স সিরিজটি টেনে বেড়াচ্ছে, বোঝা মুশকিল। এই সিরিজের প্রথম দুই-তিনটি ধারাবাহিক দর্শকপ্রিয়তা পেলেও পরবর্তীতে একই ন্যাকামো দর্শকের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঈদের ‘সিকান্দার বক্স এখন নিজ গ্রামে’ ওই একই রকম। ঘুরে ফিরে মোশারফের অকারণ প্যানপ্যান। দু-চারটে ডায়ালগ আর হাস্যরস থাকলেই যদি সেটাকে নাটক বলা হয়, তাহলে তো কেল্লাফতে! নাটক নিয়ে এই অদ্ভুত নাটক আর কত? সহ্যের তো একটা সীমা থাকে! তবে বাংলাভিশনের অন্যকিছু নাটক, যেমন- ‘ডিসাইড টু সুইসাইড’, ‘ওয়াইফ মানে ইস্তিরি’ ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ মনে ধরেছে দর্শকদের। ঈদ আনন্দে পিছিয়ে ছিল না দেশটিভিও। বিশেষ নাটক ‘এই রোদ এই বৃষ্টি’, ধারাবাহিক ‘মি. ৪২০’ নির্মাণ এবং গল্পের দিক থেকে খুব ভাল ছিল। মাছরাঙা টেলিভিশনের বিশেষ ধারাবাহিক নাটক ‘ঈদের নাটক’, এক বিরতির নাটক ‘ড্রাইওয়াশ’, ‘চোখে রাখ চোখ’ও পেয়েছে প্রবল দর্শকপ্রিয়তা। এসএ টেলিভিশনের বিশেষ ধারাবাহিক ‘পাতায়ার পথে নেয়ামত’, বিশেষ নাটক ‘ছায়াসত্তা’ দেখেও জুড়িয়েছে অনেকের মন। এছাড়াও এই ঈদে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে ‘অতঃপর অরিন্দম কহিল’, ‘প্রেম অথবা দুঃস্বপ্নের রাত দিন’, ‘এক বিকেলের সুখ-দুঃখ’, ‘সেই ছেলেটা’, ‘প্রমিজ’, ‘টু এয়ারপোর্ট’, ‘অনিন্দিতা’, ‘সিন্ড্রেলা’, ‘মেঘেদের রংমিছিল’, ‘ড্রেস কোড লুঙ্গি’, ‘অপর পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য’, ‘বিভোর বনলতা’, ‘প্রফেসর শেয়াল’, ‘মুখোশের আড়ালে’, ‘লাইক এ্যান্ড শেয়ার’, ‘সিস্টেম’, ‘নেপথলিন’, ‘আবারও আতা তোতা’, ‘আর্ট জসিম’, ‘এ এক অদ্ভুত ভালবাসা’ সহ অসংখ্য নাটক। যেগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বাকি সবই দেখার মতো ছিল। দর্শকরা দেখেছেও সেগুলো। যার ফলে খুব কম বাড়ি থেকেই শোনা গেছে ভারতীয় চ্যানেলের প্যানপ্যানানি। ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও জানান দিয়েছেন অনেকে তা। চ্যানেল বেড়ে যাওয়ার ফলে এবং বাজেট কমে যাওয়ার কারণে হঠাৎ করেই হারাতে শুরু করেছিল আমাদের নাটকের মান। এসব নিয়ে দর্শকদের তো বটেই, খোদ শিল্পীদেরও কিন্তু অভিযোগের অন্ত নেই; আছে আক্ষেপও। কিন্তু প্রবীণ অভিনেতা, নির্দেশক আবুল হায়াত এবার বললেন ভিন্ন কথা, আশার কথা। ‘বাজেট কমে গেছে। তবুও মানের কমতি হয়নি। এমনকি এই বাজেটে ভাল কাজও হচ্ছে।’ আরও বললেন, ‘বর্তমানে নাটকের হালচাল ভাল। তবে চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন বিরতির দৈর্ঘ্য বেড়েছে। এর মাঝেও মানুষ নাটক দেখছে।’ বিজ্ঞাপন যদি খুব বিরক্ত না করত, মানটা যদি ঠিক রাখা যেত, তাহলে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর ওপর মানুষের আগ্রহ আস্তে আস্তে কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমে যেত। বিজ্ঞাপনের জন্য পুরো একটা নাটক দেখাও কষ্টকর হয়ে পড়ে অধিকাংশ সময়ই। জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা পার্থ বড়ুয়া বললেন, ‘বিজ্ঞাপন প্রচারের নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত। আমিও একজন টিভি নাটকের দর্শক। যখন নিজে কোন চ্যানেলে নাটক দেখতে বসি, তখন বিরক্ত হয়ে যাই। এত বিজ্ঞাপন যে, নাটক দেখার আগ্রহই হারিয়ে ফেলি। এ অবস্থা দূর করতে অবিলম্বে সুষ্ঠু বিজ্ঞাপন প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। নতুবা হয়ত বাংলা নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে দর্শক।’ আমরা চাই না সেটা। কেউ-ই চায় না। পার্থ আরও বললেন, ‘নাটকপাড়ার হালচাল এখন তুলনামূলকভাবে খারাপ। কারণ, বাজেট দিন দিন নিচের দিকে নামছে। আর বাজেট নেমে গেলে নাটকের মানও পড়ে যায়। ত্রুটি থেকে যায় দৃশ্যায়ন-সম্পাদনায়ও’। যাই হোক, মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম গড়ালো না! এই ঈদ থেকেই পুনরায় শুরু হোক নাটকপাড়ায় মানসম্মত নাটকের জয়জয়কার, চ্যানেলগুলো নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসুক বিজ্ঞাপন প্রচার, দর্শকরা ক্রমেই আবার ঝুঁঁকে পড়ুক নিজস্ব চ্যানেলগুলোর দিকে; এই আশাতেই বাঁচি আপাতত...
×