ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইব্রাহিম নোমান

হোমো নালেডি মানুষের বিবর্তনের নতুন এক অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ৯ অক্টোবর ২০১৫

হোমো নালেডি মানুষের বিবর্তনের নতুন এক অধ্যায়

আধুনিক মানুষের প্রজাতিগত পরিচয় হোমো স্যাপিয়েন্স (Homo sapiens)। বুদ্ধিমত্তা ও দলগত ঐক্যের কারণে এরা সব প্রাণীর ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। তবে নতুন এক প্রজাতির মানুষের সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। নাম দেয়া হয়েছে হোমো নালেডি (ঐড়সড় হধষবফর)। এদের হাত, কবজি কিংবা পায়ের পাতা অবিকল আধুনিক মানুষের মতোই। আর দেহের ওপরের অংশ দেখতে আদিম মানুষের মতো। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের পাশের একটি এলাকায় পাওয়া গেছে নতুন এ প্রজাতির মানুষের ১৫টি দেহের প্রায় ১৫ হাজার হাড়ের জীবাশ্ম। আফ্রিকায় এটাই এ ধরনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। এসব জীবাশ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এটি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। জীবাশ্মগুলো মিলেছে জোহানেসবার্গ থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত একটি গুহায়। ওই গুহা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত। সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই অনুসন্ধান চালিয়ে আসছেন জোহানেসবার্গের ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটারসর‌্যান্ড-এর একদল গবেষক। এই দলটিই ২০১৩ সালে জীবাশ্মগুলোর সন্ধান পায়। এগুলো গবেষণা করে দেখা গেছে, এদের শরীরের উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতো, ওজন ছিল প্রায় ৪৫ কেজি। এদের মগজ অনেকটা কমলালেবুর মতো। বিজ্ঞানীদের অনুমান, হোমো নালেডিদের হাত, কব্জি এবং পায়ের পাতা আধুনিক মানুষদেরই মতো আর দেহের উর্ধাংশ ও মগজের আকার মানুষের আদিতম পূর্ব পুরুষদের মতোই ছোট। এরা হাতে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে কাজ করত। তবে এদের আঙ্গুলগুলো বেশি বাঁকানো। তার মানে এরা কোন কিছু বেয়ে ওপরে উঠতে পারত। জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারসর‌্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এ জীবাশ্ম খুঁজে পান। এ আদি মানব প্রজাতি কত বছর আগের বিজ্ঞানীরা তা নির্ধারণ করতে পারেননি। তবে দলের প্রধান বিজ্ঞানী প্রফেসর লি বের্গার বলেন, এ প্রজাতি খুব সম্ভবত মানুষের প্রথম পুরুষের (জেনাস হোমো) সময়কার। তারা হয়ত ৩০ লাখ বছর আগে আফ্রিকায় ছিল। আবিষ্কৃত ১৫টি কঙ্কালের মধ্যে নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষের হাড় পাওয়া গেছে। রয়েছে নবজাতক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাড়ও। মানুষেরই অন্য কোন একটি প্রজাতি গভীর গুহায় হোমো নালেডি প্রজাতির মানুষের হাড়গুলো রেখে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। আফ্রিকায় এ আবিষ্কার নজিরবিহীন। প্রথম মানবজাতির বিবর্তন কিভাবে হলো এর মধ্য দিয়ে তা আরও ভালভাবে বোঝা যাবে বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। জার্নাল ‘ইলাইফ’-এ প্রকাশিত এই গবেষণা প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয় এই প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালনের অভ্যেস ছিল। নালেডি নামে অভিহিত এই প্রজাতিটির গণ হচ্ছে হোমো, আধুনিক মানুষও এই গণের অন্তর্ভুক্ত। তবে যে সকল গবেষক এই আবিষ্কার করেছেন তারা নিশ্চিতভাবে জানেন না, হোমো নালেডি ঠিক কত বছর আগে পৃথিবীতে বসবাস করত। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক লী বার্জার জানান, সম্ভবত হোমো গণের প্রথম প্রজাতি ছিল এরাই এবং এরা আজ থেকে ৩০ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। তিনি আরও দাবি করেন, হোমো নালেডি সম্ভবত আদিম দু’পেয়ে প্রাইমেট ও আধুনিক মানুষের মধ্যবর্তী কোন প্রজাতি। অধ্যাপক লী জানান, হাড়গুলো কতটা সুরক্ষিত ছিল, তা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। খুলি, দাঁত ও পা দেখে মনে হচ্ছিল এগুলো হয়ত কোন মানবশিশুর, যদিও কঙ্কালটি ছিল আসলে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর। এর হাত ছিল মানুষের হাতের মতোই, হাতের আঙ্গুলগুলো শিম্পাঞ্জী বা বানরের মতো বাঁকানো। এটির মতিষ্কে ছিল গরিলার মতো ছোট এবং ঊরুসন্ধি ও কাঁধ ছিল আদিম মানুষদের মতো। তারপরেও এরা আধুনিক মানুষদের মতো একই গণের অন্তর্ভুক্ত। কারণ এর খুলির গড়ন বেশ উন্নত, দাঁতগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট, পাগুলো লম্বা এবং পায়ের পাতা আধুনিক মানুষের মতো। লী বলেন, ‘আফ্রিকায় পাওয়া যে কোন আদিম মানুষের চেয়ে হোমো নালেডি ভিন্ন। গবেষকরা ধারণা করছেন যে, গুহাটি সম্ভবত মৃতদেহ কবর দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো এবং নালেডিরা প্রতিটি মৃতদেহকে এখানে বয়ে নিয়ে আসত। গবেষকদের ধারণা সত্যি হলে এটা ধরে নিতে হবে যে, হোমো নালেডিরা ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত ছিল, যা এখনও মানুষের মধ্যে বিরাজমান এবং জানা মতে গত ২০ লাখ বছর ধরে মানব প্রজাতি তা অনুসরণ করে এসেছে। অধ্যাপক লী বলেন, আমাদের ধারণা কি তবে ভুল, যা আমরা এতদিন ভেবে এসেছি আধুনিক মানষের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে। তবে গবেষকদের ধারণা মানবজাতির ক্রমবিকাশের সত্যিকারের ইতিহাস হয়ত নতুন করে রচনা করতে হতে পারে। অধ্যাপক লী বলেন, ‘কর্ম সম্পাদনের ২১ দিন পরে আমরা আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মানুষের সঙ্গে অধিক সম্পর্কযুক্ত প্রজাতির সবচেয়ে বৃহৎ জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছি। এটি ছিল আমাদের জন্য একটি ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা।’ দেহাবশেষের ১৫টি অংশের মধ্যে বিভিন্ন বয়সের যেমন, সদ্যোজাত থেকে বয়স্ক পুরুষ ও নারী উভয়েই ছিল। গবেষকরা জানান, আমরা জানতে চলেছি কখন প্রজাতির শিশুরা কখন জন্মগ্রহণ করত, কখন মায়ের বুকের দুধ খেত, কিভাবে তাদের বিকাশ হতো, তাদের বিকাশের গতি, বিকাশের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের ভিন্নতা, কিভাবে শৈশব থেকে কৈশোর ও কৈশোর থেকে বয়স্ক হতো এবং কিভাবে তাদের মৃত্যু হতো। যেখানে এই প্রাণীটির কঙ্কাল পাওয়া গেছে, সেখানকার স্থানীয় ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে স্টার বা তারকা। প্রাণীটি হোমো প্রজাতির। এবার যে কঙ্কাল পাওয়া গেছে তার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হচ্ছে- নালেডি গ্রুপেরই অন্য সদস্যরা, মাটির নিচে অত্যন্ত সরু এবং অন্ধকার একটি রাস্তা ধরে খুব সতর্কভাবে এই গুহার ভেতরে এসেছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই প্রাণীটি আসলে আধুনিক কালের মানুষ এবং আদিকালের মানব প্রজাতির একটি বিস্ময়কর সংমিশ্রণ। আদিকালের দ্বিপদী কোন প্রাণীর সঙ্গে বর্তমানের মানুষের মধ্যেই এই প্রাণীটিই হয়ত এযাবতকালের মধ্যে পাওয়া সবশেষ সেতু। নাকি বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া যাবে নতুন কোন প্রজাতির সন্ধান, যা মানবপ্রজাতির বিবর্তন সম্পর্কে দেবে আবারও কোন নতুন ধারণা। [email protected]
×