ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বপ্নের শহর বাগদাদ

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৯ অক্টোবর ২০১৫

স্বপ্নের শহর বাগদাদ

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ আশির দশকে ইরাকের তেল মন্ত্রণালয়ে একটা ভাল সুযোগ পেয়ে ইরাকি এয়ারলাইন্সের বাগদাদ বিমানবন্দরে পৌঁছতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বিমানবন্দরের বাইরে দেখলাম ফলেভরা অনেক খেজুরগাছ। গাড়িতে যেতে যেতে চোখে পড়ে দজলা নদীর পাড়ে সবুজ দৃষ্টিনন্দন পার্ক। দু’পাড়ে পুরনো ও নতুন বাগদাদ যুক্ত হয়েছে সুন্দর ব্রিজ দিয়ে। সুন্দর টলমলে পানি বিখ্যাত দজলার। স্বচ্ছ পানিতে অফুরন্ত মাছের ডুবসাঁতার দেখে মন জুড়িয়ে যায়। গরমে গলা শুকিয়ে আসায় পাশের দোকান থেকে নির্ভেজাল কমলার রস পানে তৃষ্ণা নিবারণ করি। দজলা নদীর পাড়ঘেঁষে গড়ে ওঠা দোকানপাটে নানা ধরনের খাবারের পসরা। নদী থেকে সদ্য ধরা আস্ত মাছ ফ্রাই করে বিক্রি করতে দেখলাম। তখন ইরাকের সুবর্ণ সময়। মন্ত্রণালয়ে কাজে যোগদানের পর আমার পোস্টিং হয় বাগদাদ সিটিতে। সরকারী চাকরিতে অনেক সুযোগ-সুবিধা। প্রথম কিছুদিন মন্ত্রণালয়ের রেস্ট-হাউসে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বিনামূল্যে সরাবরাহ করা হয় ভাল খাবার-দাবার। যাতায়াতের জন্য আলাদা গাড়ি, টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার। প্রজেক্টে খেতে কোন পয়সাও দিতে হয় না। অসুখ হলে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধপত্র। স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটিছাটা পেতে নেই কোন সমস্যা। আমি বাগদাদের হোটেলে কিছুদিন কাটিয়েছি আমার স্ত্রী ও ছেলেকে ইরাকে নিয়ে আসার আগে। দিনরাত কখনও হোটেল রুমের দরজা বন্ধ করতে হতো না। ইরাকজুড়ে ছিল না কোন চুরি-ডাকাতি। বেশিরভাগ সময় বাগদাদের ভাল হোটেলে কোন সিট পাওয়া যায় না। সারাবছরই বিদেশী পর্যটকদের ভিড়ে বাগদাদ জমজমাট হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক ইরাকি সারামাস হোটেলের রুম ছেড়ে রাতে খোলা আকাশের নিচে ছাদে এসে ঘুমায়। বাগদাদ সিটি সেন্টার থেকে আমার বাসা কিছু দূরে হলেও, অফিস থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। বাগদাদের অন্যতম প্রধান সড়ক সাদুন স্ট্রিটে প্রোজেক্ট এ্যাক্সিকিউশন অফিসে রোজ সকালে হাজির হই। সঙ্গে সঙ্গে অফিস বেয়ারা এক কাপ কালো কফি সামনে এনে দেয়। কফিতে দেয়া হয় প্রচুর পরিমাণে চিনি। অফিসটির প্রধান কাজ ঠিকাদার দিয়ে করানো প্রজেক্টের কর্মকৌশল নির্ধারণ ও কাজের মান নিয়ন্ত্রণ। সহকর্মী ইরাকী পুরপ্রকৌশলী আহমদের মতো ভাল মানুষ বিদেশ-বিভূঁইয়ে আমি কম দেখেছি। বাগদাদ থেকে বেশ দূরে রামাদী শহরের একটি লেকের পাশঘেঁষে চলে কাজ। রামাদীর হাব্বানিয়া লেকের পাশে একটি পেট্রোল স্টেশন নির্মাণের কজে নিযুক্ত ছিলাম রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। সাইটে ঠিকাদারের মার্সিডিস বেঞ্জে করে নিয়ে যায়। খাবারও সরবরাহ করে তারা। মাঝেমধ্যে চলে চা ও জুস পান। নানা ধরনের ফল তো রয়েছেই। ইরাকের খেজুরের কোন জুড়ি নেই। বাগদাদে আমার বাসায় খেজুর, আঙ্গুর ও মাল্টা গাছ সবই ছিল। প্রোজেক্ট সাইটে আমরা বেশিরভাগ সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যারাভানে বিশ্রাম নিতাম। বিকেলবেলা কাজ শেষে আমার বাসায় পৌঁছবার আগে আহমদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামত। ওর বাড়িটি ছিল বড্ড মনোরম, নানা ফুল ও ফলে ভরা। সে আমাকে নিয়ে যেত তার ঘরে। আস্ত মাছ ভাজা ভাত-রুটি দিয়ে এক টেবিলে বসে সবাই মিলে খেয়ে তবেই আমার ছুটি মিলত। আহমদের ছেলেমেয়েরা যেন ধীরে ধীরে আমার আপনজন হয়ে যায়। আমার প্রতি আহমদের পরিবারের এমন ভালবাসার কথা আজও ভুলতে পারিনি। বাংলাদেশীদের প্রতি ইরাকীদের আলাদা একটা মমত্ব¡বোধ ছিল। অথচ প্রথম অবস্থায় আমি এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়ি। একদিন এক ভদ্রলোক আমার পরিচয় জানতে চান। আমি আমার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মাতৃভূমি বাংলাদেশের নাম বলতে উনি যা বলেন তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে আসে। জানতে চান, আমি সদ্য স্বাধীন সে দেশের মানুষ কিনা, যেখানে তাদেরই কেউ জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সেদিনের দুঃখ আর লজ্জার কথা আজও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ইরাক সরকারের উল্লেখযোগ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুবাদে সারা ইরাক ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার মতো সুযোগও ছিল। অতিথি পেলেই ঠা-া পানি দিয়ে প্রথমেই অভ্যর্থনা শুরু করা ইরাকের পুরনো সংস্কৃতি। এমনকি ইরাকের বিভিন্ন শহরের আবাসিক এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে ঠা-া পানির জার ও গ্লাস থাকে পথচারীদের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। কোথাও অতিথি হলে আপ্যায়ন করা হয় ভাজা মুরগি, মাছ, ভাত, রুটি, খাঁটি দুধের তৈরি দই, বাগানের মিষ্টি তরমুজ, আঙ্গুর, মাল্টা আরও কত কী দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে চলবে উন্নতমানের সুগন্ধি চায়ের মেলা। আর অতিথি হোক না ভিনদেশী, বিশ্বাসভাজন হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে একেবারে অন্দরমহলে। সেখানে বিশাল এক প্লেটে পরিবারের সকলের সঙ্গে কার্পেট বিছানো মেঝেতে আয়েশের সঙ্গে মিলেমিশে খাওয়ার মতো দুর্লভ সুযোগটি মিলবে। পেস্তা, বাদাম, কিশমিশে ভরা ঝরঝরে পোলাও এবং খাঁটি ঘিয়ে ভাজা একটি আস্ত বিশাল দুম্বার রোস্ট। আমি জীবনে অনেক উন্নত শহর দেখেছি। কিন্তু সেদিনের বাগদাদের মতো এত ভাল লাগেনি কোথাও। স্নিগ্ধ পরিবেশে সুন্দর রাস্তাঘাট, সাজানো গোছানো দোকানপাট। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে অনেক স্ট্যাচু ও ম্যুরাল। তৎকালীন প্রসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কিছু প্রতিকৃতি। বাগদাদ সিটি সেন্টারে রয়েছে ‘আননোন সোলজার মনুমেন্ট’। বাগদাদ সিটি সেন্টার থেকে জাফরানিয়া এলাকায় আমার বাসায় আসার পথে মর্জিনা স্কোয়ারের সেই ঐতিহাসিক চল্লিশ চোরের মনুমেন্টটির গা বেয়ে সারাক্ষণ পানি ঝরে। বাগদাদের সুন্দর এলাকা জাফরানিয়ার একটি দোতলা বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতাম। বাড়ির পাশেই ছিল বিশাল সবজি বাগান। সেখানে বেগুন, ঢেঁড়স ও টমেটো ধরত প্রচুর। আমার স্ত্রী ও ছেলে ওখান থেকে সকালবেলা তাজা সবজি কিনে আনত। চাল-ডাল কেনার জন্য পাড়ায় পাড়ায় ইরাকীরা দোকান করত। বলে দিলে গ্যাস সিলিন্ডারসহ অন্য সব সওদা বাসায় পৌঁছে দিত। রমজানের সময় পাশের বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেয়া হতো রকমারি ইফতারি। সঙ্গে থাকত গাছপাকা খেজুর ও ডুমুর। আমার ভাড়া বাসায়ও ছোট্ট একটি গাছে প্রচুর খেজুর ধরত। অবসরে ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে স্ত্রী-ছেলেকে নিয়ে বাগদাদের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। সে সময় ইরাকের যে কোন শহর বা গ্রামে দিনে-রাতে যে কেউ নির্বিঘেœ দূর-দূরান্তে চলাফেরা করতে পারত। ছিল না কোন নিরাপত্তার ভয়। সারাদিন ঘুরে বাগদাদের ঐতিহাসিক শহরের নানা স্থান ঘুরে দেখতাম আমরা। তৃষ্ণা পেলে রাস্তার পাশ থেকে ফ্রেশ জুস পান করতাম। বাগদাদ মিউজিয়াম ছিল অনেক পুরনো সভ্যতার স্বাক্ষর। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত হলে প্রয়োজনে কোন পার্কে বিশ্রাম সেরে নিতাম। দুপুর হলে যে কোন খাবারের দোকান থেকে মাংস-রুটি বা ভাত খেয়ে নেয়া যেত। তেঁতুল দিয়ে মাংস ও বিনস খুব মজাদার খাবার। ইরাকের নানা ধরনের কাবাব ও দোলমাও নামকরা। সে সময়ে খাবার-দাবারের দামও ইরাকজুড়ে ছিল একই। ওখানকার রেস্তোরাঁয় খাবার যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত। নির্দ্বিধায় খেয়ে নেয়া যায়। বেশিরভাগ ইরাকী রেস্তোরাঁয় খেতে অভ্যস্ত। এমনকি ঈদের মতো অনুষ্ঠানে ইরাকীদের ঘরে তেমন কোন খাবারের আয়োজন হয় না। এসব উৎসবে ওরা নজফ, কুফা, কারবালার মতো স্থান ঘুরে দেখে এবং ইবাদত করে কাটায়। বাগদাদে আমরা ঈদ বা কোন অনুষ্ঠানের সময় বাংলাদেশী বন্ধু-বান্ধব মিলে বাসায় একত্রে রান্না করে খেতাম। কেউ কেউ নিকটস্থ দজলা বা শাখা নদী থেকে জাল দিয়ে মাছ ধরে আনত। খানিকটা সময় মাছ ধরলে সে মাছ খেয়ে কয়েক দিনেও শেষ করা যেত না। বেশ কিছু দিন ইরাকে অবস্থানকালে সারা ইরাক ঘুরে বেড়ানোর দুর্লভ সুযোগ মিলেছে। দেখেছি নজফ, কুফা, কারবালার মতো ঐতিহাসিক স্থান। হযরত আব্দুল কদের জিলানী (র)-এর রওজা জিয়ারত করেছি বেশ কয়েকবার। সেখানে রসুল হযরত মুহম্মদ (স)-এর শহীদ হওয়া দন্ত মোবারক দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে। দেখার সুযোগ মিলেছে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বেবিলনের শূন্য উদ্যান। চিনেছি ইরাকের মানুষজন। সারা ইরাক আজ বিধ্বস্ত। প্রতিনিয়ত বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ইরাকবাসীর প্রাণ। আমার স্মৃতিবিজড়িত ইরাকজুড়ে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, আমার একান্ত পরিচিত জনপদের বিকৃত ছবি দেখে মন কেঁদে ওঠে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল। হাসপাতালে আহতদের ঠাঁই নেই। ছবিতে রাস্তায় পড়ে থাকা হাজারও লাশের মাঝে আমার পরিচিত মানুষগুলোর মুখ খুঁজে ফিরি। ধর্ম-সম্প্রদায়ের মতপার্থক্য, বিদ্বেষের বিষবাষ্প শেষ করে দিয়েছে তিল তিল করে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী একটি দেশ, অতি প্রাচীন মানবসভ্যতা। ভেঙ্গে দিয়েছে দীর্ঘকালের লালিত সম্প্রীতির বন্ধন। নিঃশেষ করেছে মজবুত অর্থনৈতিক ভিত। সেখানে আজ অভাব-অনটনের কালো থাবা প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলেছে নিরীহ ইরাকীদের, অসহায় শিশুদের। শিশুখাদ্যের অভাব। চিকিৎসার অভাবে মরছে মানুষ। যে ইরাক আমার মতো এক স্বল্প বিদ্যাবুদ্ধির মানুষকে চাকরি দিয়ে নিয়ে গেছে, সে দেশের মানুষই আজ বেকার। চাকরির জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে দেশ-দেশান্তরে। আমার মন কেঁদে কেঁদে ফেটে পড়ে দুঃখ-বেদনায়। বিদগ্ধ ইরাকের অসহায় মানুষের সঙ্গে আমি যেন একাত্ম হয়ে যাই। বোমা, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আমার প্রিয় ইরাকী আপনজন, হাসান, আহমদের মতো অনেক বন্ধুবান্ধবের কে কোথায় কেমন আছে, জানি না। ইচ্ছা হয় আরেকটিবার ঘুরে আসি আমার স্মৃতির শহর বাগদাদ, যেখানকার বিশাল জনপদ ঘিরে কেটে গেছে আমার জীবনের অনেকটা মূল্যবান সময়। ইরাকের মানুষ স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছে আমার হৃদয়। তাই তো স্মৃতির শহর বাগদাদসহ সারা ইরাকের বিভিন্ন শহরে কাটানো দিনগুলোর সুখময় স্মৃতি ভুলতে পারিনি। আমি মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চাকরি করেছি, ঘুরে দেখেছি ইউরোপ, আমেরিকার নানা শহর, তাতে একটি বিশ্বাস আমার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেÑ সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কোন দেশে একদিনে গড়ে ওঠে না।
×