ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বীপকন্যা কুকরি-মুকরি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ৯ অক্টোবর ২০১৫

দ্বীপকন্যা কুকরি-মুকরি

নিদেল শরিফ শরৎচন্দ্রের মতে, ‘দিন-কয়েক বাহিরে যাওয়ার অজুহাতে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লেখার বিপদ আছে’। কিন্তু সমস্যাটা হলো আনন্দের কথা না লিখলে মন ও শরীর কোনটাই হালকা হয় না। সমগ্র দেশ ঘোরার ইচ্ছা থেকেই এবারের যাত্রা চরাঞ্চল। ‘নদী সাগর কোম্মে চলে বইয়া/পদ্মপাতায় পানির ফোডা হইয়া’। জীবনানন্দের বরিশালের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সদরঘাট হতে। আমরা উঠে গেলাম ঢাকা-চর ফ্যাশনের লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়ার পর কেন যেন বুড়িগঙ্গাও অনেক সুন্দর দেখাচ্ছিল! বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কীর্তিনাশা হয়ে আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চলেছে চার পাশের জনপদকে পেছনে ফেলে। জেলেদের মাছ ধরার নৌকা, মালবাহী স্টিমার, যাত্রীবাহী লঞ্চ আর চাঁদের ওপর মেঘের নিত্য আসা-যাওয়া পরিবেশটাকে অনন্যসুন্দর করে তুলেছে। লঞ্চের সামনের পাটাতনে বসে প্রকৃতির এই রূপ দেখা বড়ই আনন্দদায়ক,রোমাঞ্চকর। চরফ্যাশন নেমে অনেক উঁচু একটা টাওয়ার দেখা গেল। টাওয়ারে উঠে দেখলাম বিশাল নদী, চর এবং উপকূলীয় জনপদ। ওখানে থেকে নেমে নাস্তা করে আবার রওনা দিলাম চর দক্ষিণ আইচার পথে। চর ফ্যাশন থেকে চর দক্ষিণ আইচায় চমৎকার পিচ রাস্তা আর চোখ জুড়ানো প্রকৃতি রয়েছে। দক্ষিণ আইচা থেকে অটোতে করে গেলাম চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। বৃষ্টির দিনে এর চেয়ে সুন্দর প্রকৃতি আর হয় না। এবার নৌকায় করে আমাদের যাত্রা চর কুকরি-মুকরির উদ্দেশে। চর কচ্ছপিয়া খালের ভেতর দিয়ে নৌকা ছুটে চলল চর কুকরি-মুকরির দিকে। চারপাশে সবুজ আর সবুজ। মনে হচ্ছিল, যেন আমরা সবুজ স্বপ্নের ভেতর প্রবাহিত হচ্ছি। এভাবেই এক সময় মেঘনা, মেঘনার শাখা নদী বুড়ি গৌড়াঙ্গ পেরিয়ে এসে পড়ি কুকরি খালে। দুইপাশে সবুজ বন, মধ্যখানে কুকরির খাল। অনেকে তাকে বলে ভারানির খাল। দৃষ্টিকে সম্মোহন করে এবার দূর থেকে দেখতে পাই কাক্সিক্ষত দ্বীপ চর কুকরি-মুকরি। কুকরির খাল পেরিয়ে আসতেই নজরে আসে ঘরবাড়ি আর মাছ ধরার নৌকা। ভোলা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দ্বীপ চর কুকরি-মুকরি ‘দ্বীপকন্যা’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বন্য প্রাণীর অন্যতম অভয়ারণ্য এটি। বঙ্গোপসাগর ঘেঁষে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় এর অবস্থান। চর কুকরি-মুকরির নামকরণ প্রসঙ্গে একটা মজার জনশ্রুতি আছে। প্রিন্স ব্রাউন নামের জার্মান যুবরাজ বহু আগে ঘুরে বেড়াতে এসে বিরান চর কুকরি-মুকরিতে জাহাজ নোঙ্গর করেন। চরটিতে তাঁর জাহাজ নোঙ্গর করানোর উদ্দেশ্য ছিল পশু-পাখি শিকার, কিন্তু তিনি নিরাশ হন। দ্বীপটিতে নেমে তিনি দেখতে পান পশুপাখি বলতে এখানে প্রচুর কুকুর ও ইঁদুরের ছোটাছুটি। এমন অদ্ভুত কাণ্ড দেখে যুবরাজ প্রিন্স ব্রাউন দ্বীপ চরটিকে কুকরি-মুকরি নামে ডাকেন। ভিন্নমত হচ্ছে, একসময় এখানে ইঁদুর ও কুকুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। স্থানীয়ভাবে ইঁদুরকে মেকুর বলা হয়। মেকুর থেকে মুকরি। এভাবেই দ্বীপের নাম চর কুকরি-মুকরিস। কুকরি ঘাটে নেমে গ্রামের রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এখানে থাকার কোন হোটেল নেই। ইউনিয়ন পরিষদের বাংলোতে নামমাত্র মূল্যে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। ইউনিয়ন পরিষদের স্বচ্ছ পুকুরে গোসল সেরে বাজারে গেলাম দুপুরের খাবার খেতে। খেয়ে এসে একটু রেস্ট নিয়ে ঘুরতে বের হলাম চর কুকরি-মুকরি। ডাকাতিয়া ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে গেলাম এখানকার প্রধান আকর্ষণ নারকেল বাগান দেখতে। নারকেল বাগান আসলে ম্যানগ্রোভ এবং নারকেল আর খেজুর গাছের বাগান। এখানে প্রচুর হরিণ দেখতে পাওয়া যায় আর শীতকালে আসে অতিথি পাখি। বর্ষায় মাছ ধরার দৃশ্য এবং ঘাটে নৌকা দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য আমাদের দেখা অন্য অনেক সৌন্দর্য থেকে অতুলনীয়। মেঘনা নদী আর সাগর মিলিত হয়ে এখানে বালির সৈকত তৈরি হয়েছে। ম্যানগ্রোভ বন এবং সৈকতে একসঙ্গে হাঁটলে মন ভাল হয়ে যায় আনমনে। এখানকার নীরব প্রকৃতি আমাদের সবাইকে বিমোহিত করে তুলেছিল। চর কুকরি-মুকরির অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম নিত্যদিনের দু:খ ভুলে।
×