ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নূরুল আরেফিন

ফিরে দেখা এডওয়ার্ড সাঈদ

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৯ অক্টোবর ২০১৫

ফিরে দেখা এডওয়ার্ড সাঈদ

পাশ্চাত্যের সমাজ, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যে প্রাচ্যসমাজের- বিশেষ করে, আরব সমাজের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে পশ্চিমা লেখক এবং বুদ্ধিজীবীদের একদেশদর্শিতার মূল কারণ উদ্ঘাটনে যার চিন্তাধারা গত আশির দশকে পাশ্চাত্যে বিস্ময়কর আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সেই চিন্তানায়ক এডওয়ার্ড সাঈদের মৃত্যু দিবস ছিল গত ২৫ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ দশ বছর মরণব্যাধি লিউকোমিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে ২০০৩ সালে ৬৭ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরব সমাজে বর্তমানে যে ভয়ঙ্কর মানবসৃষ্ট সর্বগ্রাসী সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তার বিশ্লেষণে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা, নোয়াম চমস্কির মতো মুষ্টিমেয় দুয়েকজন ছাড়া, যদি একদেশদর্শী না হতেন, তা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় সমাজে সমস্যার সঠিক কারণ চিহ্নিত হতো এবং সমাধান কিছুটা সহজ হতো। ‘‘দি ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেসনস্ এ্যান্ড দ্যা রিমেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’’ (স্যামুয়েল পি হানটিংটন, ১৯৯৬), ‘‘দ্যা এন্ড অব হিস্ট্রি এ্যান্ড দি লাস্টম্যান” ( ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা, ১৯৯২) বা এই শ্রেণীর উদ্দেশ্যমূলক গ্রন্থে সভ্যতা, সমাজ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণে সচেতন মানসিকতার গভীরে লেখকদের যে অবচেতন মানসিকতা কাজ করে, তা অনুধাবনের জন্য এডওয়ার্ড সাঈদের চিন্তাধারার পুনর্পাঠের প্রয়োজনীয়তা একবিংশ শতাব্দীতে বিশেষভাবে দেখা দিয়েছে। হানটিংটন তাঁর গ্রন্থের প্রতিপাদ্য সম্পর্কে বলেন : ‘‘It is my hypothesis that the fundamental source of conflict in this nwe world will not be primarily ideological or primarily economic. The great divisions among mankind and the dominating source of conflict will be cultural” (দি ক্ল্যাস অব সিভিলাইজেসনস্, প্রবন্ধ, ভল.৭২, নং ৩, ফরেন এ্যাফেয়ার্স পত্রিকা, ১৯৯৩। এই প্রবন্ধটির বক্তব্যই হানটিংটন ১৯৯৬ সালে বই আকারে প্রকাশিত করেন) আর সভ্যতার বর্তমান পর্যায়কে ফুকুইয়ামা তাঁর গ্রন্থে এভাবে দেখেন : পশ্চিমা বিশ্বে স্থাপিত সরকার ব্যবস্থাই হচ্ছে ‘‘ঞযব বহফ ঢ়ড়রহঃ ড়ভ সধহশরহফ’ং রফবড়ষড়মরপধষ বাড়ষঁঃরড়হ ধহফ ঃযব ঁহরাবৎংধষরুধঃরড়হ ড়ভ ডবংঃবৎহ ষরনবৎধষ ফবসড়পৎধপু ধং ঃযব ভরহধষ ভড়ৎস ড়ভ যঁসধহ মড়াবৎহসবহঃ’’। এই গ্রন্থ দুটিতে আরব সমাজে বর্তমান সংঘর্ষের অনিবার্যতা ও সেখানে ‘‘লিবারাল গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বিষয়ে পশ্চিমা সরকারের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭৮ সালে এডওয়ার্ড সাঈদের সাড়া জাগানো পুস্তক ‘ওরিয়েন্টালিজম’ প্রকাশিত হয় এবং প্রাচ্যের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন বিশ্লেষণে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতা গঠন সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বটির মৌলিকতা পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা খ-ন করতে না পেরে, ভীষণভাবে বিব্রত বোধ করেন। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ যদিও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্থাপনে আজও তেমন সহায়ক হয়নি, কিন্তু সাহিত্য মূল্যায়ন এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিশ্লেষণে তাঁর পদ্ধতি স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ‘‘ওরিয়েন্টালিজম’’ গ্রন্থে সাঈদ প্রাচ্যের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিশ্লেষণে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের মানসিক সীমাবদ্ধতা তাদের অবচেতন মনের গভীরে কিভাবে সৃষ্টি হয়, তা যুক্তির নিরিখে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে তাঁর অক্লান্ত সৃজনশীল বিশ্লেষণমূলক লেখা সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, মানবভূগোল এবং প্রাচ্য-সমাজ বিশ্লেষণ ও বিচার পদ্ধতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সাধারণ সমাজে সাঈদের পরিচিতি স্বতন্ত্র প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের প্রবক্তা এবং বন্ধু নোয়াম চমস্কির মতো মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির তীব্র সমালোচক হিসেবে। তাঁর এই অবস্থান তাঁর মূল তাত্ত্বিক চিন্তাধারার বিপ্রতীপ নয়। ফিলিস্তিন প্রশ্নে তাঁর যে রাজনৈতিক অবস্থান, তার পিছে নিহিত রয়েছে প্রাচ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ‘‘সাবজেক্টিভ’’ ধ্যান-ধারণা। ‘‘ওরিয়েন্টালিজম” গ্রন্থের পরে প্রকাশিত ‘‘কালচার এ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’’ (১৯৯৩), “কালচার এ্যান্ড রিসিস্টান্স” (২০০৩), “হিউম্যানিজম এ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক ক্রিটিসিজম” (২০০৫), “ন্যাশনালিজম, কলোনিয়ালিজম এ্যান্ড লিটারেচার’’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলোতে এই ধ্যান-ধারণা আরও খোলাখুলি এবং বিশদভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘‘ওরিয়েন্টালিজম’’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে, তাঁর বক্তব্য পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী মহলের প্রাচ্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধ্যান-ধারণার ভিত্তিমূলকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রাচ্য সম্পর্কে পশ্চিমা লেখক রচিত সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, জীবন, রাজনীতি, ইতিহাস বিষয়ক বহু গ্রন্থ বিশ্লেষণ করে সাঈদ তাঁদের উপস্থাপনের অযৌক্তিকতা, কল্পনাপ্রসূতা, হৃদয়নির্ভরতা, পূর্বধারণা এবং অবচেতন মনের প্রভাবকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করেন। ফলে সাঈদের বক্তব্য একদিকে যেমন সমালোচনার ঝড় তোলে, অন্যদিকে সমর্থনও লাভ করে, যদিও বিরোধিতার পাল্লায় ছিল ভারি। তবে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী মহলে একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হিসেবে তাঁর স্বীকৃতিও অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে। তাঁর মূল্যায়নের মাপকাঠি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ অধ্যয়ন ও বিচারে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। তাঁর মূল অবস্থান অবশ্য পরবর্তী সংস্কৃতি ও সমাজবিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থগুলোতে অনেক পরিশীলিত হয়েছে এবং প্রাথমিক বিদ্রোহের সঙ্গে অনেক বাস্তবতার সহনশীলতা ও প্রজ্ঞা যুক্ত হয়েছে। সাঈদ ছিলেন বহুমুখী তীক্ষè বুদ্ধিনির্ভর প্রতিভা এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, সঙ্গীত, দর্শন, রাজনীতি, প্যালেস্টাইন সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর প্রায় চল্লিশটি মৌলিক পা-িত্যপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বেশির ভাগ গ্রন্থ ইংরেজী ভাষায়, তবে ফরাসী ও আরবীতেও তাঁর অনেক লেখা রয়েছে এবং তিনটি ভাষাতেই তাঁর দখল ছিল সমান। সাঈদের স্বাতন্ত্র্যবোধ ও মননশীলতা বিকাশে জন্মস্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবারিক পরিবেশ, আরব সংস্কৃতি, শিক্ষা, এবং সঙ্গীত প্রীতির সৃষ্টিশীল সংমিশ্রণ ঘটেছিল। প্রথমত, তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন প্যালেস্টাইনের খ্রিস্টান। তাঁর জন্ম হয় জেরুজালেমে এবং প্রারম্ভিক লেখাপড়া করেন জেরুজালেমের এ্যাংলিকান সেন্ট জর্জস্ একাডেমিতে এবং পরে মিশরের আলেক্সয়ানড্রিয়ার ভিক্টোরিয়া কলেজে। ফলে আরব সমাজ, সংস্কৃতি ও মানসিকতা সম্পর্কে তাঁর পরিচয় ও জ্ঞান ছিল প্রত্যক্ষ ও গভীর। দ্বিতীয়ত, তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সবচেয়ে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং পি এইচ. ডি ডিগ্রী অর্জন করে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী ও তুলনামূলক সাহিত্যে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে পূর্ণকালীন অধ্যাপক হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে হার্ভার্ড, জনস্ হপকিন্সস্, ইয়েল ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। পশ্চিমা সমাজে অবস্থান, পড়াশোনা, অধ্যাপনা এবং নিবিড়ভাবে সে সমাজকে জানার ফলে পশ্চিমা মানসিকতার গঠন বিশেষভাবে অনুধাবন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তৃতীয়ত, পশ্চিমা খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গ লেখকদের সঙ্গে তাঁর আর একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। তিনি আরবী ভাষী ছিলেন, তাই আরবমানসকে ভিতর থেকে বুঝতে পারতেন; আবার ধর্মে খ্রিস্টান হওয়ার জন্য আরব মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি কোন স্বধর্মীয় দৌর্বল্যও ছিল না। এসব কারণে প্রাচ্যকে তার প্রকৃত পরিচয়ে উপস্থাপন করা পশ্চিমা লেখকদের চেয়ে অনেক বেশি অপক্ষপাতকতার নিরিখে সম্ভবপর হয়। বিশ্বায়নের শতাব্দীতে সমাজ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে যে অপ্রতিরোধ্য নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তার গভীরতর অনুধাবনে সাঈদকৃত বিশ্লেষণ দিকনির্দেশনা হতে পারে। ‘‘ওরিয়েন্টালিজম’’ গ্রন্থে তাঁর প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এই যে, পশ্চিমা লেখকগণ প্রাচ্য, তথা বিশেষ করে আরববিশ্বকে পক্ষপাতদুষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন বলে পশ্চিমা জনগোষ্ঠীতে প্রাচ্যের সমাজ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিয়েছে। তিনি একে বলেছেন, “ subtle and persistent Eurocentric prejudice against Arab-Islamic peoples and their culture (ওরিয়েন্টালিজম, পৃঃ ১৪)। অনেক পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের লেখায় এই মানসিকতা সচেতনভাবে, অনেকের ক্ষেত্রে অবচেতনভাবে কাজ করেছে, যা তাঁরা বুঝতে অপারগ ছিলেন । আর একটি বিষয় তাঁর কাছে বিশেষভাবে প্রতিভাত হয় যে, প্রাচ্যের সমাজ ও সংস্কৃতিকে পশ্চিমা লেখকদের দর্পণে দেখে দেখে আমাদের মন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, আমরা যে আমাদেরকে তাদের দর্পণে দেখছি, সেটা সর্ম্পকে সচেতন নই। কবিতা, নাটক, উপন্যাস ও অন্যান্য সাহিত্যের মূল্যায়ন কালেও এই মানসিকতা কাজ করে। তাঁর বক্তব্য, পশ্চিমা সাহিত্য ও অন্য বিষয়ক গ্রন্থে প্রাচ্য সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনকে উপস্থাপিত ও যাচাই করা হয়েছে পাশ্চাত্যের মানদ-ে। তাই প্রাচ্যকে তাদের কাছে মনে হয়েছে, সাঈদের সাহিত্যিক ভাষায়, “কুহকী” (বীড়ঃরপ), ‘‘ রহস্যাবৃত’’(রহংপৎঁঃধনষব) ইত্যাদি। তাঁর মতে প্রাচ্য, পাশ্চাত্যের লেখায় ‘‘অযৌক্তিক’’ ‘‘দুর্বল’’ ‘‘অপুরুষালী’’ অন্যপক্ষ, যা পশ্চিমের ‘‘যৌক্তিক’’ ‘‘শক্তিশালী ও ‘‘পৌরুষতাময়’’ অবস্থান থেকে ভিন্ন। তিনি মনে করেন, কোন ইংরেজ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারত ও মিশরকে তাঁদের উপনিবেশ হিসেবেই সে সমাজ ও সংস্কৃতিকে দেখেছেন। এই অবস্থান থেকে আরও গভীরে যেয়ে তিনি বলেন ‘‘ To say this may seem quite different from saying that academic knowledge about India and Egypt is somehwo tinged and impressed with, violated by, the gross political fact - and yet this is what I am saying in this study of orientalism’’ (ওরিয়েন্টালিজম, পৃঃ ১১)। এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা উপস্থাপনে সাঈদ প্রাচ্যের সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কালের পশ্চিমা লেখকদের বহু গ্রন্থ বিশ্লেষণ করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁদের অবচেতন মনের দ্বারোদ্ঘাটন করতে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য যেমন, গ্রীক নাট্যকার এস্কিলাসের ‘‘দি পারসিয়ানস্’’ থেকে সুরু করে, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সাহিত্য যেমন দান্তের মহাকাব্য ‘‘দি ডিভাইন কমেডি’’ থেকে আধুনিক পশ্চিমা সাহিত্য যেমন জন অস্টিন, রুডির্য়াড কিপ্লিং বা ডাবলিউ বি ইয়েটস্ ইত্যাদি সাহিত্যিকদের কাব্য, নাটক ও উপন্যাসে- প্রাচ্যের চরিত্র চিত্রণে আখ্যান উপস্থাপন, প্রধান চরিত্র বা পার্শ্ব চরিত্র চিত্রণ, দৃশ্য বর্ণনা, সংলাপ এমনকি কাব্যভাষা, রচনাশৈলী ও বাক্যবিন্যাস বিশ্লেষণ করেছেন এবং তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছেন। এই মানসিকতা ইউরোপীয় রাজনৈতিক আধিপত্যের গভীরতা থেকে এমনভাবে সৃষ্ট হয়েছে যে, সবচেয়ে সহানুভূতি সম্পন্ন, বুঝমান ও জ্ঞান সমৃদ্ধ পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের লেখাকেও প্রভাবিত করেছে। সাঈদ পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ্দের উপস্থাপনের পক্ষপাতদুষ্টতার বিশ্লেষণে তাঁদের যুক্তিকেই ব্যবহার করেছেন। ফরাসী দার্শনিক জ্যাঁ দেররীদা ও মিশেল ফুকোর বিশ্লেষণ পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। এই পদ্ধতি কিছুটা কার্ল মার্কসের হেগেলীয় দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগের মতো, যা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির শোষণের চরিত্র উন্মোচনে সহায়ক হয়েছে। দেররীদার ‘ডিকন্সট্রাকশন’ পদ্ধতি প্রাচ্যবিদ্দের ‘লেখাংশ’-এর বা ‘টেকস্ট’-এর অঙ্গবীক্ষণ করতে পরম্পপরতার যোগসূত্র স্থাপন, প্রতিস্থাপন এবং ‘ভাল’ ও ‘মন্দ’ শুধু এই অবস্থানের দৌর্বল্য তাত্ত্বিকভাবে নিরূপণে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। ফরাসী দার্শনিক ফুকোর ‘ক্ষমতা’, ‘ক্ষমতা ও জ্ঞান’ এবং পশ্চিমা চিন্তাধারাÑ এই তিন বিষয়ের অন্তর্নিহিত যোগসূত্রের প্রভাব, সাঈদ ব্যবহার করেছেন, পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের মানসগঠনে অবচেতন স্থরে কিভাবে প্রবেশ করেছে, তা উদ্ঘাটন এবং তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিকভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে। পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের গ্রন্থ ব্যবচ্ছেদন কালে তিনি লক্ষ্য করেন যে, তাঁদের ব্যক্তিগত (রহফরারফঁধষ) মানসিকতা গঠনে প্রাচ্য সর্ম্পকে শতাব্দীব্যাপী দীর্ঘ যুগের সমষ্টিজাত ভ্রান্তিভিত্তিক ধারণার অংশদ্বারিত্ব রয়েছে এবং এই মানসিকতা পাশ্চাত্যের উপনিবেশ বিস্তার এষণায় পরোক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন যুগিয়েছে। হানটিংটন ও ফুকুয়ামার গ্রন্থ দুটিও একবিংশ শতাব্দীতে বর্তমানের ভিন্নচারিত্রিক পশ্চিমা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের তাত্ত্বিক যৌক্তিকতার ভিত্তি প্রস্তুত করেছে। পাশ্চাত্যের মাপকাঠিতে প্রাচ্য হচ্ছে “ব্যত্যয়”(ফবারবহঃ) আর এই তফাৎ ধারণার মূলে রয়েছে যুগপথ সচেতন ও অবচেতন মানসিক অবস্থার সমষ্টিগত পাটাতন, যা লেখকের সাহিত্য, দর্শন ও লেখাকে অবচেতনভাবে প্রভাবিত করে। ‘ওরিয়েন্টালিজম’-এর পরবর্তী গ্রন্থ “কালচার এ্যান্ড ইমপিরিয়ালিজম” (১৯৯৩), “কালচার এ্যান্ড রিসিস্টান্স” (২০০৩) ইত্যাদি গ্রন্থে খোলাখুলিভাবে সংস্কৃতি ও উপনিবেশবাদের সংঘর্ষের কথা বলেছেন। “ওরিয়েন্টালিজম” এবং তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলো পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী মহলে সমালোচনার ঝড় তোলে। আর্নেস্ট গেলনার, বানার্ড লেউইস, রবার্ট আরউইন, ম্যাকসিম রোডিনসন, ম্যালকম র্কার, উইলিয়াম এম ওয়াট ইত্যাদি লেখকরা সাঈদের বক্তব্য খ-নে বিভিন্ন যুক্তিতর্ক খাড়া করেন। সংক্ষেপে এগুলো হচ্ছে : (১) প্রাচীন কাল থেকে পাশ্চাত্য যে প্রাচ্যের ওপর আধিপত্য করেছে, সাঈদের এই তথ্য সঠিক নয়; (২) অটোম্যানদের (তুর্কী সম্রাজ্যের) উত্থানের পূর্বে প্রাচ্যকে ইউরোপ কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেনি, তাই কোন ‘কমপ্লেক্স’ বোধ মনে কাজ করেনি; (৩) সাঈদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল মধ্যপ্রাচ্যে, যা তাঁর তত্ত্বকে সীমাবদ্ধতার নিগড়ে বেঁধেছে; (৪) তার মূল উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য উপস্থাপনা; (৫) তিনি পাশ্চাত্যের সকল প্রাচ্যবিদকে একই পাল্লায় দাঁড় করিয়েছেন; এবং (৬) প্রাচ্যবিদদের মানসিকতা গঠনে তিনি সর্ম্পকের আপেক্ষিকতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, যা তাঁর যুক্তিকে অহংয়ের (ঝড়ষরঢ়ংরংস) কুহেলিকায় আবদ্ধ করেছে ইত্যাদি। এসব কঠোর সমালোচনা ও তার ব্যাপকতা সাঈদের চিন্তাধারাকে সুসংহত এবং পরিণত করতে সহায়ক হয়েছে। সমালোচনার বিস্তার থেকে অনুধাবন করা যায় তাঁর তত্ত্বের মৌলিকতা ও পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার ওপর প্রভাব। তিনি অনেক লেখককে নতুনভাবে ভাবিতও করেছেন। রোনাল্ড ইনডেন, নিকোলাস ড্রিক্স ইত্যাদি লেখকদের প্রাচ্য বিষয়ক লেখায় বা সাহিত্যতাত্ত্বিক গায়ত্রী স্পিভাক, হামিদ দাবাশি, হোমি ভাবার উপর প্রভাব থেকে বিষয়টি অনুধাবনীয়। তাঁর অবদান পশ্চিমা লেখকদের প্রাচ্যের সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিশ্লেষণে একটি নতুন ও স্থায়ী মাত্রা যোগ করেছে, যা তাঁর সমালোচক ও সমর্থক সকলেই স্বীকার করেন। সমালোচকদের অনুশোচনা তাঁর তত্ত্বের সীমাবদ্ধতায়; আর সমর্থকদের প্রশংসা, বিশেষত সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যায়নে, তাঁর তত্ত্বে নতুন দিকনির্দেশনায়। সাঈদের ‘‘ওরিয়েন্টালিজম তত্ত্ব” আলোচনায় একটি বিষয় আলাদা করে মনে করতে হয়, এজন্য যে তাঁর মানসিকতার সৌকর্য গঠনে সঙ্গীত এক দূরান্বয়ী ভূমিকা পালন করেছে। সঙ্গীত বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কয়েকটি পুস্তক যথা- “মিউজিক্যাল ইলাবোরেসনস্” (১৯৯২), ‘‘প্যারালালস্ এ্যান্ড প্যারাডক্সে ঃ এক্সপ্লোরেশনস্ ইন মিউজিক এ্যান্ড সোসায়েটি” (ডানিয়েল বোরেন বোইমের সঙ্গে যৌথভাবে, ২০০৩) ইত্যাদি। ১৯৯৯ সালে আর্জেনটাইন বন্ধু ও সঙ্গীত পরিচালক ডানিয়েল বারেনবোইমের সঙ্গে “ওয়েস্ট ইস্ট দিভান অকেস্ট্রা” প্রতিষ্ঠা করেন। এই চিন্তানায়কের সঙ্গীতপ্রিয়তা ও অবদানের স্মরণে তাঁর মৃত্যুর এক বছর পর ২০০৪ সালে প্যালেস্টাইনের বীরজেইট বিশ্ববিদ্যালয় স্বীয় সঙ্গীত বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে “এডওয়ার্ড সাঈদ ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব মিউজিক” নামকরণ করে। ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, তাঁর মতো প্রচ- রাজনৈতিক প্রতিবাদী কণ্ঠ, তুখোড় বুদ্ধিজীবী, প-িত, অধ্যাপক, লেখক ও দার্শনিক— সঙ্গীতের প্রতি এত নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তিনি নিয়মিত সঙ্গীত বিষয়ে ‘দি নেশন’ পত্রিকায় লিখতেন এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের নৈকট্য অনুসন্ধান ও স্থাপনে উদ্যোগী ছিলেন, সম্ভবত এই কারণে যে প্রাচ্য ও পশ্চিমা সংস্কৃতির ফলপ্রসূ সংমিশ্রণে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন- যে সংমিশ্রণ, তিনি ভেবেছেন, পশ্চিমা সমাজকে প্রাচ্যকে বুঝবার ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং সম্প্রসারিত করতে সাহায্য করবে। [email protected]
×