ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূলঃ জেমস্ জয়েস;###;অনুবাদ : নূর-ই-ফাতিমা ;###;মোশারফ জাহান

এ্যারাবি

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৯ অক্টোবর ২০১৫

এ্যারাবি

নর্থ রিচমন্ড স্ট্রিট কানাগলি হওয়ায় ক্রিশ্চিয়ান ব্রাদার্স স্কুলের ছেলেদের ছুটির সময় ব্যতীত সারাক্ষণ নীরব থাকত। কানাগলির শেষ মাথায় একটি চৌকো জমির ওপর একটি জনশূন্য দোতলা বাড়ি প্রতিবেশীদের থেকে আলাদাভাবে অবস্থিত ছিল। গলির অন্য বাড়িগুলো তাদের ভেতরকার ভদ্র জীবনধারার ব্যাপারে সচেতন হয়ে একে অপরের প্রতি ধূসরনেত্রে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকত। আমাদের বাড়ির প্রাক্তন ভাড়াটিয়া ছিলেন একজন পাদ্রী, যিনি পেছনের বসার ঘরে মারা গিয়েছিলেন। অনেকদিন বন্ধ থাকায় সবগুলো ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে ছাতাপড়া দুর্গন্ধ আর রান্নাঘরের পেছনের জরাজীর্ণ ঘরে ছিল পুরানো অদরকারি কাগজের আবর্জনা। এসবের মধ্যেই কিছু কোঁচকানো, ছাতাপড়া, মলাট করা বইয়ের খোঁজ পেয়েছিলাম- তার মধ্যে ছিল ওয়াল্টার স্কটের ‘দি এ্যাবট’, ‘দ্য ডিভাউট কমিউনিক্যান্ট’ ও ‘দ্য মেমোয়ের্স অব ভিডক’। এর মধ্যে শেষের বইটি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল লেগেছিল এর হলদেটে পাতাগুলোর জন্য। বাড়ির পেছনে অযতেœ বেড়ে ওঠা বাগানের একদম মাঝখানে ছিল একটি আপেল গাছ আর এদিক সেদিক গজিয়ে ওঠা কিছু ঝোপঝাড় যার নিচে আমি মৃত ভাড়াটিয়ার জং ধরা সাইকেলের পাম্পটি পেয়েছিলাম। পাদ্রী মশাই খুব দানশীল লোক ছিলেন। তিনি উইল করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার সমস্ত টাকাপয়সা আর নিজের বোনকে তার আসবাবপত্র দিয়ে গিয়েছিলেন। শীতকালে দিন যখন ছোট হয়ে এল, তখন রাতের খাবারের পর্ব ভালভাবে শেষ হওয়ার আগেই সন্ধ্যা নামত। আমরা যখন একসঙ্গে খেলা করার জন্য পথে বেরিয়ে আসতাম, চারপাশের বাড়িগুলোতে ততক্ষণে আঁধার নেমে এসেছে। আমাদের মাথার ওপরের খোলা আকাশে তখন নানারকম বেগুনী রংয়ের ছটা আর রাস্তার বাতিগুলো সেদিকে নিস্তেজ লন্ঠনগুলো তুলে ধরত। শীতের বাতাসে গায়ে কাঁটা দিত আর আমরা ঘেমে লাল হওয়ার আগ পর্যন্ত খেলা করতাম। আমাদের চিৎকার এই নীরব গলিটিতে প্রতিধ্বনিত হত। এই খেলাধুলা আমাদের টেনে আনত বাড়ির পেছনের অন্ধকার আর কাদায় ভরা পথের মাঝে, যেখানে পথের দু’পাশের বদমেজাজি বাসিন্দাদের চোখ রাঙানি আর ধমক পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যেতাম অন্ধকার শিশিরভেজা বাগানের পেছনের দরজার দিকে যেখানে ছাইগাঁদা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াত, আর যেতাম দুর্গন্ধময় আস্তাবলের দিকে যেখানে কোচোয়ান ঘোড়ার পরিচর্যা করত কিংবা টুংটাং শব্দে ঘোড়ার লাগাম ও জিন পরিষ্কার করত। আমরা যখন গলিতে ফিরে আসতাম, তখন রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে চারদিক আলোকিত করত। আমার কাকাকে গলির মোড়ে দেখা গেলেই আমরা অন্ধকারে ছায়ায় লুকিয়ে থাকতাম তিনি নিরাপদে বাড়িতে ঢোকার আগ পর্যন্ত। আর যদি ম্যাঙ্গানের বোন তাদের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে তার ভাইকে চা খেতে ডাকত, তাহলে আমরা আমাদের লুকানোর জায়গা থেকে বারবার উঁকি দিয়ে তাকে দেখতাম। সে দাঁড়িয়ে থাকে নাকি চলে যায় তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। সে থেকে গেলে আমরা ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে ম্যাঙ্গানদের দোরগোড়ায় গিয়ে বসে পড়তাম। সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করত। আধখোলা দরজার ফাঁক গলে আলো পড়ে তার দেহের আদলটি ফুটে উঠত। বোনের কথা শোনার আগে ভাইটি সবসময় তার সঙ্গে একটু খুনসুঁটি করত, আর আমি রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তার শরীর নড়ে উঠলেই তার পোশাকটিও দুলে উঠত, আর তার নরম দড়ির মতো চুল একপাশ থেকে অন্যপাশে দুলতে থাকত। প্রতিদিন সকালে আমি সামনের বসার ঘরের মেঝেতে শুয়ে তার বাড়ির দরজার দিকে নজর রাখতাম। দরজার পর্দাটি তখন সযতেœ চৌকাঠের সঙ্গে মিলিয়ে রাখতাম যাতে আমাকে দেখা না যায়। সে দোরগোড়ায় বেরিয়ে এলেই আমার হৃৎপি- লাফিয়ে উঠত। আমি দৌড়ে হলঘরে গিয়ে বইপত্র বগলদাবা করতাম আর তারপর তাকে অনুসরণ করতাম। তার বাদামি দেহাবয়ব সারাক্ষণ আমার চোখে লেগে থাকত আর যে জায়গায় এসে আমাদের দু’জনার পথ দু’দিকে ভাগ হয়ে যেত সেখানে এসে আমি দ্রুত পা চালিয়ে তাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতাম। দিনের পর দিন সকালে এমনটি হত। তার সঙ্গে কখনও আমার কথা হয়নি, কেবলমাত্র কয়েকটি সাধারণ কথাবার্তা ছাড়া, তবুও তার নামটি আমার নির্বোধ রক্তকণিকায় সর্বদা যেন সমন জারি করত। প্রেমের পক্ষে নেহাৎ বেরসিক জায়গায়ও তার কল্পনা আমার সঙ্গী হত। শনিবারের সন্ধ্যাগুলোয় কাকিমা বাজার করতে গেলে কিছু কিছু জিনিসপত্র বয়ে আনার জন্য আমাকেই তার সঙ্গে যেতে হত। ক্রমশ চওড়া হতে থাকা রাস্তার মাঝ দিয়ে আমরা হেঁটে যেতাম মাতাল আর দরকষাকষিরত থাকা মহিলাদের গায়ের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে আর রাস্তার দিনমজুরদের খিস্তি, কসাইয়ের দোকানের কর্মচারী ছোকরাদের বেসুরো হাঁকডাক, পথগায়কদের খোনা গলার গান (যার বিষয় মাতৃভূমির দুঃখ দুর্দশা) শুনতে শুনতে। এসব শব্দগুলো একটিমাত্র রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয়ে আমার হৃদয়ে এসে জমাট বাঁধত। কল্পনা করতাম যে, আমি একদল শত্রুর মাঝখান দিয়ে একটি পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছি। মাঝে মাঝে প্রার্থনা আর স্তোত্রপাঠ করার সময় কেমন করে যে অদ্ভুতভাবে তার নামটি আমার মুখে উঠে আসত তা আমি নিজেও বুঝতে পারতাম না। প্রায়ই আমার চোখে জল আসত (জানি না কেন আসত) আর অনেকসময় আমার হৃদয় থেকে একটি প্লাবন যেন আমার বুকের মাঝে এসে সাজোরে আছড়ে পড়ত। ভবিষ্যতের কথা তখন অল্পই ভাবতাম। কখনও তার সঙ্গে কথা হবে কিনা জানতাম না, যদিও বা কখনও কথা হয় তখন কেমন করেই বা আমার এই বিহ্বল মুগ্ধতার কথা তাকে জানাব। কিন্তু আমার শরীর যেন এক বীণা যার প্রতিটি তারে ঝঙ্কার তুলত তার কথা আর ইশারা। এক সন্ধ্যায় আমি পেছনের বসার ঘরে গেলাম যেখানে পাদ্রী মশাই দেহ রেখেছিলেন। সেই অন্ধকার বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় বাড়িতে কোন সাড়াশব্দ ছিল না। জানালার একটি ভাঙা কাচের ফাঁকগলে শোনা যাচ্ছিল পৃথিবীর বুকে অবিরাম বর্ষণের ঝমঝম শব্দ। সুঁইয়ের মতো তীক্ষè বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ভেজা নরম মাটিকে যেন ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। দূরের কোন জানালায় আবছা আলো দেখা যাচ্ছিল। এত কম দেখতে পেয়েই আমার মন তুষ্ট ছিল। আমার সমস্ত চেতনা যেন অবচেতন হতে ব্যাকুল। আমি যে দিশেহারা হওয়ার উপক্রম তা বুঝতে পেরে নিজের দু’হাতের তালু একসঙ্গে মিলিয়ে চেপে ধরে রাখলাম যতক্ষণ না হাত কাঁপতে শুরু করল, আর বিড়বিড় করে বলতে থাকলাম, ‘হে প্রেম! হে প্রেম!’ অবশেষে তার সঙ্গে আমার কথা হলো। সে যখন প্রথমবারের মতো আমাকে কিছু বলেছিল, আমি তখন এতটাই হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম যে ভেবে পাইনি কী জবাব দেব। সে জানতে চাইল আমি ‘এ্যারাবি’তে যাব কিনা। উত্তরে ‘হ্যাঁ’ নাকি ‘না’ বলেছিলাম তাও মনে নেই। খুব নাকি জমকালো মেলা বসবে। সে বলেছিল যে তার যাবার খুব শখ। ‘কিন্তু তোমার যাওয়া হবে না কেন?‘ আমি জানতে চাইলাম। কথা বলার সময় সে তার হাতের রূপার বালাটি বারবার ঘুরিয়ে দেখছিল। সে বলেছিল তার যাওয়া হবে না কারণ তাকে তার কনভেন্টের স্কুলে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যেতে হবে। তার ভাই আর অন্য দু’টি ছেলে নিজেদের খুনসুঁটি আর ঠাট্টা নিয়ে ব্যস্ত। আমি তখন রেলিংয়ের একপাশে একা দাঁড়িয়ে। আর সে তখন তার মাথাটি আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকিয়ে রেলিংয়ের একটি শিক ধরে দাঁড়িয়েছিল। আমাদের বাড়ির দরজার উল্টোদিক থেকে বাতির আলো এসে তার ফর্সা ঘাড়ের বাঁকে পড়ায় তার ঘাড়ে পড়ে থাকা চুল আর রেলিংয়ে রাখা হাত যেন জ্বলজ্বল করছিল। তার লম্বা জামার একপাশে আলো পড়ে সেই আলো এসে জামার নিচের পেটিকোটের পাড়েও লাগছিল। সে সহজভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছিল বলেই তার পেটিকোটের পাড়টি দেখা যাচ্ছিল। সে বলল, ‘তুমি গেলে ভালই হবে’। আমি বললাম, ‘যদি যাই তবে তোমার জন্য কিছু কিনে আনব’। সেই সন্ধ্যার পরে কত অগণিত নির্বোধ ভাবনা যে আমার দিনের আরাম আর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল! আমার ইচ্ছে করত মেলার আগের সেই একঘেয়ে দিনগুলোকে একদম মুছে ফেলতে। স্কুলের কাজের চাপে যেন ক্ষয়ে যাচ্ছিলাম আমি। যখনই অনেক কষ্টে পড়ায় মন বসাতে চাইতাম তখনই তার কল্পনা দিনের বেলায় স্কুলঘরে আর রাতের বেলায় শোবার ঘরে আমার আর আমার বইয়ের পাতার মাঝখানে এসে দাঁড়াত। গভীর নীরবতার মাঝেও ‘এ্যারাবি’ কথাটির প্রতিটি শব্দ যেন আমার সমস্ত অস্তিত্বকে এক অসীম আনন্দের মাঝে ডেকে নিয়ে প্রাচ্যের মোহজাল আমার ওপর বিস্তার করত। বাড়িতে শনিবারের মেলায় যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলাম। কাকিমা বেশ অবাক হলেন; ভাবলেন কোন আজেবাজে (প্রোটেস্ট্যান্ট ফ্রিম্যাসন্ দলের) মেলা না হলেই হয়। সেদিন ক্লাসের পড়া ঠিকমত বলতে পারিনি। দেখলাম যে মাস্টার মশাইয়ের মুখের কোমলভাব বদলে গিয়ে কঠিনভাব দেখা দিচ্ছে। আমাকে তিনি পড়ালেখায় ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারে সাবধান করে দিলেন। কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারলাম না। আমার আর আমার স্বপ্নের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়ানো যতসব নিরস কাজকর্মের ওপর আমার বিরক্তি ধরে গেল। এসব কাজগুলোকে তখন নিছক ছেলেখেলা বলে মনে হতে লাগল- বিশ্রী আর একঘেয়ে সব ছেলেখেলা। শনিবার সকালে কাকাকে আবারো মনে করিয়ে দিলাম যে সন্ধ্যায় মেলায় যেতে চাই। তিনি তখন হলঘরের দেরাজে টুপি ঝাড়ার বুরুশ খোঁজায় ব্যস্ত। তাই তার চাঁছাছোলা জবাব এল, ‘হ্যাঁ রে বাপু, জানি’। তিনি তখন হলঘরে থাকায় সামনের বসার ঘরে গিয়ে জানালার ধারে শুয়ে থাকতে পারলাম না। বাড়ির পরিবেশ সুবিধার মনে হলো না। আস্তে আস্তে স্কুলের দিকে পা বাড়ালাম। কনকনে ঠা-া বাতাস যেন গায়ে এসে বিঁধছিল আর এরই মধ্যে আমার মন একেবারেই দমে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় যখন খাবার খেতে বাড়িতে ঢুকলাম, কাকা তখনও ফেরেননি। হাতে তখনও মেলায় যাওয়ার মতো সময় ছিল। বসে বসে কিছুক্ষণ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর যখন ঘড়ির টিকটিক শব্দে বিরক্তি ধরে গেল তখন ঘরটি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় চলে গেলাম। উঁচু উঁচু ফাঁকা ঘরগুলো বেশ ঠা-া আর মলিন। এখানে এসে আমি যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে এ ঘর ও ঘর ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগলাম। নিচের রাস্তায় দেখলাম আমার খেলার সাথীরা খেলছে। তাদের চিৎকারের শব্দ আমার মনকে অস্থির আর দুর্বল করে দিল। জানালার শীতল কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে আমি সেই আলোহীন বাড়িটির দিকে তাকালাম যেখানে সে থাকত। প্রায় ঘণ্টাখানেক সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেও কিছুই দেখতে পাইনি কেবল আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনায় তার ধূসর দেহাবয়বটি ছাড়া। সেই অবয়ব যার মরাল গ্রীবায়, রেলিংয়ে রাখা হাতে আর পেটিকোটের পাড়ে লণ্ঠনের আলোর আলতো ছোঁয়া লেগেছিল। এরপর নিচে নেমে এসে দেখি মিসেস মার্সার বসার ঘরের উনুনের পাশে বসে আছেন। এই বাঁচাল বৃদ্ধা এক বন্ধকী মহাজনের বিধবা। মহিলা ধর্মীয় সাহায্যের চাঁদা তোলার নাম করে পুরনো ডাকটিকিট বিক্রি করে বেড়াতেন। বাধ্য হলাম চায়ের টেবিলের বাজে গাল-গল্প সহ্য করতে। রাতের খাবারের পর্ব আরও ঘণ্টাখানেক পিছিয়ে গেল তবু কাকার দেখা নেই। মিসেস মার্সার এবার যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে বললেন যে তিনি আর বসে থাকতে পারছেন না। ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা পেরিয়ে গেছে। তাছাড়া রাতের হিমেল হাওয়া তার শরীরের জন্য ভাল নয় বলে তিনি রাত করে বাড়ির বাইরে থাকা পছন্দ করেন না। মহিলা চলে যাওয়ার পর রাগে গজগজ করতে করতে আমি ঘরময় পায়চারী করতে থাকলাম। কাকিমা বললেন, ‘তুই বরং আজকের মতো মেলায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দে।’ রাত নয়টায় শব্দ পেলাম কাকা হল ঘরের দরজা খুলছেন। শুনতে পেলাম তিনি আপন মনে কথা বলছেন। তার ওভারকোটের ভারে হলঘরের কোট রাখার আলনাটির দুলে ওঠার শব্দ হলো। কাকার খাওয়া প্রায় অর্ধেক হয়ে এলে তাঁর কাছে মেলায় যাওয়ার টাকা চাইলাম। তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘মেলার সবাই এখন ঘুমিয়ে পড়েছে আর এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাদের এক ঘুম হয়েও গেছে।’ শুনে আমার মোটেও হাসি পেল না। কাকিমা বেশ উদ্যমের সঙ্গে বললেন, ‘টাকাটা দিয়ে ওকে যেতে দিচ্ছ না কেন? এমনিতেই ওর অনেক দেরি করিয়ে দিয়েছো।’ কাকা বললেন যে, তিনি ভুলে যাওয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। এবং আরও বললেন যে, তিনি এই প্রবাদটি বিশ্বাস করেন- ‘খেলা ছেড়ে শুধুই পড়া, ছেলের মাথায় গোবর পোরা।’ তিনি জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছি। আর তাঁকে সেটি দ্বিতীয়বারের মতো বলার পর এবার তিনি জানতে চাইলেন আমি সেই আরব বেদুইনের কবিতাটি জানি কিনা। রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম তিনি কাকিমাকে কবিতাটির প্রথম পংক্তিগুলো শোনাতে শুরু করেছেন। লম্বা লম্বা পা ফেলে বাকিংহাম স্ট্রিট থেকে স্টেশনের দিকে যাওয়ার সময় শক্ত করে টাকাটি ধরে রাখলাম। রাস্তায় নেমে চোখ ঝলসানো আলো আর খদ্দেরের জটলা দেখে মেলায় যাবার কারণটি আবারো মনে পড়ে গেল। একটি খালি রেলগাড়ির তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় আমি নিজের আসনে গিয়ে বসলাম। অসহ্য রকমের দেরি হওয়ার পর ধীরে ধীরে গাড়িটি স্টেশন ছাড়ল। ভাঙাচোরা বাড়িঘর আর ঝলমলে নদীর ওপর দিয়ে রেলগাড়ি এগিয়ে চলল। ওয়েস্ট ল্যান্ড রো স্টেশনে আসার পর একদল লোক কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করল। কিন্তু কুলিরা তাদের পিছু হটিয়ে দিল এই বলে যে এটা মেলার জন্য চালু করা বিশেষ রেল। খালি কামরায় আমি একাই বসে রইলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়িটি একটি কাঠের অস্থায়ী প্লাটফর্মের পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে নেমে রাস্তার বড় ঘড়িতে দেখলাম দশটা বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। আমার সামনে পড়ল একটি বড় দালান যাতে সেই মোহিনী নামটি লেখা। সস্তায় মেলার ভেতরে ঢোকার মতো কোন ফটক খুঁজে পেলাম না। মেলা বন্ধ হয়ে যাবে এই ভয়ে ক্লান্ত চেহারার এক লোকের হাতে এক শিলিং গুঁজে দিয়ে ঘূর্ণি-দোরের ভেতর দিয়ে মেলায় ঢুকে পড়লাম। ভেতরে একটি বড় হলঘর তার চেয়েও অর্ধেক উচ্চতার বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। মেলার প্রায় সবক’টি দোকানই তখন বন্ধ হয়ে গেছে আর হলঘরটির বেশিরভাগ অংশই তখন গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন। সেখানে তখন এমনই নীরবতা নেমে এসেছে যেমনটি নেমে আসে গীর্জায় প্রার্থনা সঙ্গীত শেষ হয়ে যাওয়ার পর। ভয়ে ভয়ে মেলার ঠিক মাঝখানে গেলাম। যে কয়টি দোকান তখনও খোলা ছিল তার সামনে অল্প কিছু লোকের আনাগোনা ছিল। একটি পর্দার ওপর রঙিন বাতি দিয়ে লেখা “ক্যাফে শ্যঁতো”। তার সামনে দু’জন লোক একটি থালার ওপর টাকাপয়সা রেখে গুনছিল। পয়সার ঝনঝনানির দিকে মন চলে গেল। আমার এখানে আসার কারণটি কষ্টে সৃষ্টে মনে পড়ার পর এসব দোকানের একটিতে ঢুকে কিছু চীনামাটির ফুলদানি আর ফুল-আঁকা চায়ের সেট পরখ করে দেখছিলাম। দোকানটির দরজায় দাঁড়িয়ে একজন তরুণী ভদ্রমহিলা দু’জন তরুণ ভদ্রলোকের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছিল। তাদের বাচনভঙ্গি লক্ষ্য করার সময় তাদের কথাবার্তার কিছু অংশও আমার কানে এল। ‘ইশ, আমি কক্ষনো এমন কথা বলিনি।’ ‘উঁহু, তুমি অবশ্যই বলেছ।’ ‘উঁহু, আমি মোটেও সেকথা বলিনি।’ ‘ও তো বলল।’ ‘হ্যাঁ, আমিও ওকে বলতে শুনেছি।’ ‘ইশ, একদম বাজে কথা।’ আমার দিকে নজর পড়ায় তরুণীটি (বিক্রয় কর্মী) এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল আমি কিছু কিনতে চাই কিনা। তার বলার ভাবটি তেমন উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। শুনে মনে হলো কেবল কর্তব্যের খাতিরেই আমাকে একথা বলা। অন্ধকারাচ্ছন্ন দরজার দু’পাশে প্রাচ্যের প্রহরীর মতো দাঁড় করান দু’টি বড় ঘড়ার দিকে বিনীতভাবে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, ‘না, ধন্যবাদ’। তরুণীটি তখন চীনামাটির একটি ফুলদানির জায়গা বদল করে সেই তরুণ দু’টির কাছে ফিরে গেল। তারা অবার সেই একই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করল। দু’একবার তরুণীটি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। সেখানে আমার আর কোন প্রয়োজন নেই জেনেও দোকানটির সামনে আরও কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করলাম শুধুমাত্র দোকানের জিনিসপত্রগুলোতে আমার যে সত্যি খুব আগ্রহ সেটি বোঝানোর জন্য। তারপর আস্তে আস্তে ফিরে চললাম মেলার মাঝখান দিয়ে। পকেটে থাকা একটি বড় পয়সার সঙ্গে অন্য দু’টি ছোট পয়সাও রেখে দিলাম। মেলার এক পাশ থেকে বাতি নেভানোর ঘোষণা ভেসে এল। হলঘরের ওপারের অংশটি তখন পুরোপুরি অন্ধকার। সেই অন্ধকারের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে পেলাম নিজেরই মিথ্যা অহমিকার ফলে অপদস্থ হওয়া এক জীব হিসেবে। আর তখন তীব্র রাগে-দুঃখে আমার চোখ দু’টি জ্বলতে লাগল।
×