ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লঞ্চ বাস টার্মিনাল রেলস্টেশন- খোলা জায়গা পেলেই এসব পথবাসী গড়ে তোলে বসতি

৪০ হাজার মানুষ ঢাকায় থাকেন ফুটপাথে- পলিথিন টাঙিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১০ অক্টোবর ২০১৫

৪০ হাজার মানুষ ঢাকায় থাকেন ফুটপাথে- পলিথিন টাঙিয়ে

শাহীন রহমান ॥ জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জের সাজেদা খাতুন। দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও স্বামী নিয়ে মোট ছয় সদস্যের অভাবের পরিবার। গ্রামের বাড়িতে চাষ করে খাওয়ার মতো জমি নেই। স্বামীর দিন মজুরির টাকায় খুব কষ্টে দিন কাটত। টাকার অভাবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানো সম্ভব হয়নি। একজনের আয়ে ছয় সদস্যের পরিবার চলত না। বেশির ভাগ সময় একবেলা খেয়ে থাকতে হতো। বসতভিটা ১৯৯৮ সালের বন্যায় নদীতে বিলীন হয়ে যায়। চারপাশে অভাব। চার দিন স্বামী-সন্তান নিয়ে না খেয়ে এক স্কুলের বারান্দায় দিন কাটায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের নিজের বাড়িতে চলে গেলেও তার কোন যাওয়ার জায়গা না থাকায় খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয় এ পরিবারের। একদিন পাশের বাড়ির সুলতানা খালার হাত ধরে পরিবার নিয়ে পাড়ি জমায় রাজধানী ঢকায়। কিন্তু ঢাকায় ঠিকানা না থাকায় ঠাঁই হয় কাওরানবাজার পান্থকুঞ্জ এলাকায়। এখানে তার মতো অনেক অসহায় পরিবার খোলা আকাশের নিচে পলিথিন টাঙ্গিয়ে বসবাস করে। শুধু সাজেদা খাতুন নয়, এরকম হাজারও মানুষের বসবাস রাজধানী ঢাকায়। যারা ভাসমান বা পথবাসী হিসেবে পরিচিত। যাদের মাথা গোঁজার কোন ঠাঁই নেই। খোলা আকাশের নিচেই বসবাস। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকায় এ ধরনের পথবাসীর বা ভাসমান লোকের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার জরিপে দেখা গেছে বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করে রাজধানীতে এমন পথবাসীর সংখ্যা প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজারের মতো। যাদের সুনির্দিষ্ট কোন আয় নেই। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সবই রাস্তায়। রাজধানীতে মাথাগোঁজার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েই আশ্রয় নিচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। পলিথিন টাঙ্গিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে ফুটপাথ, লঞ্চ বা ফেরির টার্মিনালে। রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, মার্কেট প্লেস, নির্মাণাধীন ভবনের পাশে বা বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কবরস্থানের পাশেই গড়ে উঠছে তাদের জীবন পদ্ধতি। এসব পথবাসী পুনর্বাসনের জন্য ২০০৮ সাল থেকে কাজ করছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছেÑ সাজিদা ফাউন্ডেশনের ‘আমরাও মানুষ’ নামের একটি প্রকল্প, কনসার্ন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড বাংলাদেশ, কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর। সাজিদা ফাউন্ডেশনের ‘আমরাও মানুষ’ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের এক জরিপে রাজধানীতে এদের সংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের মতো। প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে বাইরে থেকে আসা এসব ভাসমান লোকের সংখ্যা বাড়ছে। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের পুনর্বাসন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা মানুষ প্রকল্পে কো-অর্ডিনেটর মোঃ ফারুক হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, গবেষণায় মূলত তিন ধরনের পথবাসীর সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথমত, গ্রাম থেকে অনেক নিঃস্ব মানুষ যারা এলাকায় কর্মসংস্থানে ব্যর্থ হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। আশ্রয় হচ্ছে বিভিন্ন ফুটপাথে, অলিগলি ও কমলাপুর রেলস্টেশনের মতো জায়গায় খোলা আকাশের নিচে। দ্বিতীয়ত, ভাসমান এসব মানুষের তালিকায় রয়েছে নারীপ্রধান কিছু পরিবার। বিশেষ করে যেসব নারীর স্বামী মারা গেছে অথবা ছেড়ে চলে গেছে; সেসব মহিলা তাদের সন্তানদের নিয়ে ফুটপাথে আশ্রয় নিচ্ছে। আবার অনেকে রয়েছে যারা পরিবার-পরিজন বিচ্ছিন্ন। এসব লোকের পরিবারের সঙ্গে কোন প্রকার যোগাযোগ নেই। এ তালিকায় অনেক মহিলা আছেন যারা অন্যের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে, যাওয়ার কোন জায়গা না থাকায় আশ্রয় নিচ্ছে ফুটপাথে। খোলা আকাশের নিচেই চলছে তদের বসবাস। তিনি জানান, মূলত গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান, যাদের কোন আয়ের ব্যবস্থা নেই, নদী ভাঙ্গনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্বÑ তারাই মূলত ছুটে আসছেন রাজধানীতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরে ভাসমান মানুষের ধারণা বহু পুরনো। খ্রীস্টান ধর্মের প্রবর্তক স্বয়ং যিশুখ্রিস্টও জন্মেছিলেন শহরের পাশেই অবস্থিত এক আস্তাবলে। বিশ্বের অনেক বড় বড় শহরের রাস্তায় ভাসমান লোক বা পথবাসীর দেখা মেলে। এ থেকে ব্যতিক্রম নেই রাজধানী ঢাকা শহরও। রাত হলেও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোলা আকাশের নিচে শামিয়ানা, মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমাতে দেখা যায় অনেক পথবাসী বা ভাসমান মানুষকে। কথা বলে জানা গেছে, এসব পথবাসীর রাজধানীতে নেই কোন মাথাগোঁজার ঠাঁই। তাদের নির্দিষ্ট কোন আয়ের উৎস নেই। তবু অজানার উদ্দেশ্যেই অন্যের হাত ধরে পাড়ি জমাচ্ছে রাজধানীতে। ফুটপাথে বা রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাস্তায় বিয়ে হয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে এমনও আছে। আর পরিবার-পরিজন নেই তাদের সংখ্যা কম নয়। শুধু ঢকা শহর নয়। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরে ভাসমান অনেক মানুষকে দেখা যায় ফুটপাথে, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ টার্মিনাল কিংবা রেলস্টেশনে ঘুমাতে। ঘরহীন এসব মানুষের অনেকেরই থাকার কোন আবাস না থাকায় তারা রাত কাটাতে বেছে নেয় এসব স্থানকে। আবার অনেকের ঘর থাকলেও জীবিকার প্রয়োজন কিংবা অন্য কোন কারণে বাধ্য হন রাস্তাঘাটে এভাবে জীবন কাটাতে। রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড শুধু নয়, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় খোলা আকাশের নিচে দেখা যায় পথবাসী বহু মানুষকে। ঢাকায় এমন কোন রাস্তা নেই, যেখানকার ফুটপাথে ভাসমান মানুষ ঘুমায় না। এমনকি রাজধানীর প্রতিটি ওভারব্রিজ ও ফ্লাইওভারেও মানুষ রাত কাটায়। ঢাকায় এখন প্রায় দুই কোটি মানুষের মধ্যে এদের সংখ্যা ২৫ থেকে ৪০ হাজারের মতো। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে এ তথ্য জানা গেছে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনকল্যাণবিমুখ রাজনীতি ও অর্থনীতির মারপ্যাঁচে অসহায় এসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষই আসছে ঢাকায়। নদীভাঙ্গন, দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি ও গ্রামে কোন কাজ না পাওয়ায় মানুষ শহরে বিশেষ করে ঢাকায় এসে ভিড় করে। সাজিদা ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যারা মূলত নদীভাঙ্গন, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে ঘরহীন হয়ে পথকে আশ্রয় করেছেনÑ প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা শুধু ঢাকাতেই ২৫ থেকে ৪০ হাজার। বিভিন্ন কারণে বাধ্য হয়ে তারা শহরে আসে এবং যেসব জায়গায় তারা জীবিকা খুঁজে পায় সেসব এলাকার পথকে তারা বেছে নেয়। এরকমও অনেকে আছে ৩০-৩৫ বছর ধরে রাস্তায় রাস্তায় আছে। রাস্তায় বিয়ে হয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে এমনও আছে। আমরাও মানুষ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ঢাকার রাস্তায় বসবাসরতদের মধ্যে বেশির ভাগই বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, রংপুর ও সিরাজগঞ্জের মানুষ। বেসরকারী সংস্থা কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ) ৩০ হাজার মানুষের ওপর এক জরিপ চালায়। সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, শতকরা ২১ ভাগ মানুষ ঢাকার খোলা আকাশের নিচে রয়েছে ১ থেকে ৪ বছর। শতকরা ১৬ ভাগ ৫ থেকে ৯ বছর, শতকরা ১৯ ভাগ ১০ থেকে ১৪ বছর, শতকরা ৪৪ ভাগ ১৫ বছরের ওপর। ঢাকায় যারা খোলা আকাশের নিচে থাকে, তাদের মধ্যে রয়েছেÑ গৃহপরিচারিকা, রিক্সাচালক ও মিস্ত্রি, ট্রাক শ্রমিক ও টোকাই। তবে এসব পথবাসীর পুনর্বাসনের জন্য ২০০৮ সাল থেকে কাজ করছে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা। বিনামূল্যে তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সাজিদা ফাউন্ডেশনের আমরাও মানুষ প্রকল্পের সমন্বয়কারী ফারুক হোসেন আরও জানান, এসব ভাসমান মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে। সাজিদা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। অন্যান্য সব সংস্থা মিলে প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষকে পুনবার্সন করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে এসব পথবাসী কোন কথা বলতে চাইত না। আবার তাদের পুনর্বাসনের কথা বললেও বিশ্বাস করত না। মূলত রাতের বেলা তারা যখন মশারি টাঙ্গিয়ে ফুটপাথে ঘুমাত তখন তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলার চেষ্টা করা হতো। অনেক কষ্টে এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ একমাস থেকে তিনমাস পর্যন্ত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে অনেকে চাকরি বা কারও ব্যবস্থার জন্য টাকা দেয়া হচ্ছে। তাদের বিনামূল্যেই এ সেবা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করা এসব মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পও নেয়া হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিসিসির বাজেটে পথবাসীর উন্নয়ন কাজের জন্য বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বস্তি উন্নয়ন বিভাগের গবেষণা কর্মকর্তারা জানান, কয়েকটি এলাকায় এদের আবাসনের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি পথবাসী কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য ঢাকার ধলপুরে পথবাসীদের জন্য দুই কাঠা জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং নির্মাণকাজ চলছে। সেখানে মতিঝিল থেকে শুরু করে কমলাপুর, বাসাবো, যাত্রাবাড়ী এই এলাকার দুই হাজারের মতো পথবাসীকে সেবা দেয়া যাবে। এছাড়া কেন্দ্র নির্মাণের জন্য আরও দুটো জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এছাড়াও পথবাসীদের জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট দিতে ডিসিসির সব আঞ্চলিক দফতর কাজ করছে। এর মাধ্যমে তারা জাতীয় পরিচয়পত্রও তৈরি করতে পারছে। ফলে ভোটও দিতে পারেন এই শ্রেণীর মানুষ। তাদের স্বাস্থ্য ও অন্যান্য বিষয়ে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হয়। পথবাসী এসব মানুষ নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, এদের জীবনমান উন্নত করতে দরকার বেশকিছু সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ।
×