ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিল এখন সুয়ারেজের ভাগাড়

ঢাকার ফুসফুসে দুর্গন্ধের ক্যান্সার

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১০ অক্টোবর ২০১৫

ঢাকার ফুসফুসে দুর্গন্ধের ক্যান্সার

আনোয়ার রোজেন ॥ ‘প্রকল্প উদ্বোধনের পরদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিলাম। রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে অমন সুন্দর ও নির্মল পরিবেশ! ভাবাই যায় না। দারুণ সময় কেটেছিল আমাদের। কিন্তু সেদিনই মনে হয়েছিল, এই নির্মলতা থাকবে তো? হয়েছেও ঠিক তাই। এখন তো দিনে যানজট ও ঝিলপাড়ের উৎকট গন্ধ আর রাতে ছিনতাইয়ের ভয়ে এদিকে আসাই হয় না। আচ্ছা, আমরা কেন সুন্দর কোন কিছু বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারি না!’ হাতিরঝিলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে এভাবেই আক্ষেপ ঝরল কলাবাগানের বাসিন্দা সোহেল আহসানের কণ্ঠে। শুধু তিনি নন, সৌন্দর্য পিপাসু রাজধানীবাসীর অনেকেই হাতিরঝিলের বর্তমান দুরাবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অথচ তিন বছর আগে এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল, হাতিরঝিল হবে রাজধানী ঢাকার ‘ফুসফুস।’ কিন্তু অযতœ আর অবহেলায় ঢাকার ‘ফুসফুসে’ বাসা বাঁধছে ময়লা-আবর্জনা আর দুর্গন্ধের ‘ক্যান্সার’। দিনে দিনে হাতিরঝিলের বিশাল একটি অংশ পরিণত হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। ঝিলের পানির দুর্গন্ধে টেকা দায়। পানিতে অক্সিজেনের মাত্রাও শূন্যের কোটায়। ঝিলের দুরাবস্থার সবটুকই দৃশ্যমান, তবুও দেখার যেন কেউ নেই! সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেখভালকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্বহীনতা ও নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই হাতিরঝিলের দুরাবস্থার জন্য দায়ী। দ্রুত সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি করা না হলে স্বপ্নের হাতিরঝিল একসময় উন্মুক্ত সেপটিক ট্যাঙ্কে পরিণত হবে। রাজধানীর বাংলামোটর থেকে মগবাজার-টঙ্গী ডাইভারশন রোড পেরিয়ে একদিকে রামপুরা ও অন্যদিকে গুলশান-বাড্ডা এলাকা পর্যন্ত হাতিরঝিল প্রকল্প বিস্তৃত। সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যমে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতা দূর করা, বৃষ্টি ও বন্যাজনিত পানি ধারণ, নগরের নান্দনিক সৌন্দর্য বাড়ানো এবং রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন করাই ছিল এ প্রকল্পের লক্ষ্য। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি জনসাধারণের জন্য হাতিরঝিল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ৩০২ একর জমির ওপর নান্দনিক নির্মাণশৈলী আর সবুজের সমারোহে গড়ে ওঠা প্রকল্পটি সে সময় সবার নজর কেড়েছিল। কিন্তু পচা দুর্গন্ধ ছড়ানো জলের কাছে গিয়ে এখন আর কেউ নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে পারছেন না। পরিবেশের দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। হাতিরঝিলের পাড়ে বসলে নাকে এসে লাগছে উৎকট ঝাঁজালো গন্ধ। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে আসা লোকজনের জন্য হাতিরঝিল পরিণত হচ্ছে অস্বস্তির বিষয়ে। বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, সোনারগাঁও হোটেলের পেছন থেকে শুরু হয়ে মধুবাগ ব্রিজের আগ পর্যন্ত পানির রং মিসমিসে কালো। দুর্গন্ধের কারণে ঝিলসংলগ্ন রাস্তার এই অংশটুকু পথচারী ও বিভিন্ন যানে আরোহীরা নাক চেপে পার হচ্ছেন। ঝিলের পাড়ঘেঁষে লম্বাভাবে অনেকটা জায়গাজুড়ে জমে আছে আবর্জনার ভাসমান স্তর। কোথাও কোথাও ভাসছে চিপসের প্যাকেট, পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল। দেখা যায়, ঝিলের পানিতে নিয়মিত পড়ছে ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য। ময়লা-আবর্জনাসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর খালি প্যাকেট, পলিথিন ফেলার জন্য ডাস্টবিন হিসেবে যেসব প্লাস্টিকের ঝুড়ি রাখা হয়েছিল সেগুলোর বেশিরভাগ এখন নেই। মধুবাগ, দক্ষিণ কোনাবাড়ি, বেগুনবাড়ি এবং রামপুরার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাসিক এলাকার বর্জ্য নিসরণের সরাসরি সংযোগ থাকায় হাতিরঝিলের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। বাড়ছে দুর্গন্ধ। বিপুল পরিমাণ ভাসমান মলমূত্র ও গৃহস্থালির বর্জ্যও মিশছে ঝিলের পানিতে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওয়াসার বর্জ্যর পাশাপাশি তেজগাঁওয়ের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিল্পবর্জ্যরেও ঠাঁই হচ্ছে হাতিরঝিলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শোধনাগার নির্মাণের কথা থাকলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শুধুমাত্র সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে একটি ইলেক্ট্রনিক ছাঁকনি বসানো হয়েছে। এর মাধ্যমে পানির সঙ্গে আসা ভারি বস্তু অপসারণ করা গেলেও পানি পরিশোধনের কোন ব্যবস্থা নেই। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মেশিনের পাশের খালি জায়গাতে জমেছে আবর্জনার বিশাল স্তূপ। শোধনের ব্যবস্থা না থাকায় ময়লা পানিই আবার ঝিলে জমা হচ্ছে। যে কারণে চারপাশে ছড়ানো দুর্গন্ধের তীব্রতাও এখানে বেশি। একই কারণে বেড়াতে আসা লোকজনের উপস্থিতিও এখানে কম। ঝিলের মধুবাগ অংশে কথা হয় বেড়াতে আসা আবদুর রউফের সঙ্গে। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় আসা কিশোরগঞ্জের এই তরুণ বলেন, বিয়াম ভবনসংলগ্ন ঝিলপাড়ে বসেছিলাম। কিন্তু তীব্র দুর্গন্ধের কারণে বেশিক্ষণ টিকতে পারিনি। এখানে দুর্গন্ধ নাই, কিন্তু পানির রংটা অস্বাভাবিক, সবুজভাব। মনে হয় রাসায়নিক মেশানো। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের কাজ এখনও ‘শেষ’ হয়নি-এই অজুহাতে এখানকার পানির মান পরীক্ষার অনুমতি দেয়নি ঝিল কর্তৃপক্ষ। হাতিঝিলের সঙ্গে গুলশান লেকেরও সংযোগ রয়েছে। গুলশান লেকের যে অংশটি হাতিরঝিলের খুব কাছে সেই অংশের পানির মান অত্যন্ত খারাপ। সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ স্থানভেদে মাত্র ০.৫ অথবা ০.৪ মিলিগ্রাম। তিনি বলেন, হাতিরঝিলের পানিতে ডিও কিছুতেই এর বেশি হবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানিতে ডিওর পরিমাণ প্রতিলিটারে ৮ মিলিগ্রামের নিচে থাকলে সে পানি ব্যবহার ও খাওয়ার অনুপযোগী। ডিওর পরিমাণ ৪ মিলিগ্রামের নিচে হলে সে পানি মাছ ও অন্যান্য জলজপ্রাণীর প্রাণ ধারণেরও অনুপযোগী। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ নয়, হাতিরঝিল এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্য ঝিল এলাকায় রয়েছে চারটি সেতু, চারটি উড়াল-সড়ক, প্রায় ১৭ কিলোমিটার সড়ক, ২৬০ মিটার ভায়াডাক্ট (সেতুপথ) এবং প্রায় ১২ কিলোমিটার হাঁটার পথ। সন্ধ্যার পর ঝিল এলাকায় লোকজনের পদচারণা ও যানবাহনের চলাচল সীমিত হয়ে আসে। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় ঝিল এলাকার রামপুরা অংশ, সিদ্দিক মাস্টার বাড়ির ঢাল, তেজগাঁও বেগুনবাড়ি এলাকা, হাজীপাড়াসহ বিভিন্ন স্পটে ছিনতাইকারীরা উঁৎ পেতে থাকে। ফলে ঝিল ব্যবহারকারী সাধারণ পথচারী ও ব্যক্তিগত যানে চলাচলকারীরা আতঙ্কে থাকেন। এমনকি দিনদুপুরেও সাধারণ মানুষকে গুলি করে, কুপিয়ে ছিনতাইয়ের নজির ঝিল এলাকায় রয়েছে। ছিনতাইকারীদের এমন দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেছেন খোদ হাতিরঝিলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসাররা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই জন্য আনসার সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, বিশাল এই ঝিলের মাত্র ৯ পয়েন্টে ৩০ জনের মতো নিরাস্ত্র আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। তাই রাতে কোথাও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে পুলিশকে জানানো ছাড়া তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি না। তাছাড়া রয়েছে জনবল সঙ্কট। এক সময় এক শ’য়ের মতো আনসার সদস্য থাকলেও বর্তমানে এ সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আনসারদের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর সার্বিক বিষয়ে জানতে হাতিরঝিল প্রকল্পের কর্মকর্তা মেজর কাজী শাকিলের মধুবাগ দফতরে বুধবার গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
×