ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ধলেশ্বরী তীর হুমকির মুখে

মুন্সীগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধে ধস

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১০ অক্টোবর ২০১৫

মুন্সীগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধে ধস

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ মুন্সীগঞ্জ ধলেশ্বরী তীরের শহর রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন স্থান ধসে গেছে। লঞ্চঘাটের পশ্চিমে পুলিশে লাইনের সামনে বড় ধস দেখা দিয়েছে। নয়াগাঁও চাঁনতারা মসজিদ থেকে মুক্তারপুর পর্যন্ত অংসখ্য স্থানে বাঁধটির ব্লক সরে গিয়ে ধসে পড়েছে। মুক্তারপুর সেতুর পশ্চিমে মালির পাথর এলাকায়ও বাঁধে বড় ধরনের ধস দেখা দিয়েছে। এই শুষ্ক মৌসুমে দ্রুত মেরামত করা না হলে আগামী বর্ষায় জেলা শহরটি পরবে হুমকির মুখে। সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁধ ছিদ্র করে মিল-কারখানার পয়ঃনিষ্কাশন পাইপ, ড্রেজারের পাইপ এবং যত্রতত্র বিভিন্ন পণ্যবাহী নৌযান ভেড়ানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাঁধ। এছাড়া বালুর স্তূপ ইটের স্তূপতো রয়েছেই। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বাঁধের ওপর করা দীর্ঘদিনের ইট-বালুর ব্যবসা সম্প্রতি বন্ধ করা হয়েছে। তবে এখানে রয়েছে সেসব ব্যবসার চিহ্ন অর্থাৎ বাল্কহেট থেকে বালু নামানোর ড্রেজারের পাইপ আর ইট-বালুর স্তূপ। তবে নিম্নমানের কাজ ও সুষ্ঠু তদারকির অভাব বাঁধ ভেঙে ধসে পরারও অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল মোস্তফা আশাফুদদৌলা বৃহস্পতিবার জনকণ্ঠকে বলেন, কোন শহরবাসী তাদের রক্ষা বেষ্টনী এভাবে নষ্ট করতে পারে এটি ভাবা যায় না। নতুন বাঁধটিতে জাহাজ ভিড়ানো, ছিদ্র করে ড্রেজারের পাইপ স্থাপন, ইট-বালুর ব্যবসা, অটো রাইস মিল মালিকেদের অপব্যবহার; যে যেভাবে পেড়েছে নষ্ট করেছে। বাঁধের সার্বিক বিষয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্টিং করা হয়েছে। তিনি বলেন, অবস্থা এতটাই নাজুক পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোক মেজারমেন্ট আনতে গিয়েও বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধটি যথাযথ মেরামতে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। তবে আপাতত ১০/১২ লাখ টাকা বরাদ্দ আসতে পারে। এদিয়ে যতটুকু সম্ভব মেরামত করা হবে। তিনি জানান, বড়দাগে ৪/৫টি স্থানে ধস রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ব্লক সরে গিয়ে গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। তবে তিনি বাঁধের নিম্নমানের কাজের অভিযোগ অস্বীকার করেন। পঞ্চসার ইউনিয়নের মুক্তারপুর সেতুর কাছে মালিপাথর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকায় বাঁধের সঙ্গে বাল্ক নোঙ্গর করে এখনও প্রতিদিন বালু উঠানো হচ্ছে। এখানে চলছে বালুর রমরমা ব্যবসা। এ ছাড়া কয়েকটি অটো রাইস মিলও বাঁধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়ের দোয়া অটো রাইস, মেসার্স শাহ আলী অটো রাইসসহ তিনটি কারখানার ধান-চালের বস্তা ওঠানো-নামানোর জন্য বাঁধের ব্লকের ফাঁকে বাঁশ পুঁতে তৈরি করা হয়েছে জেটি। সেই জেটিতে ভিড়ছে বড় বড় নৌযান। এতে ধসে পড়ছে বাঁধের ব্লক। বাঁধ ঘেঁষে তিনটি হাস্কিং (ধান ভাঙ্গার কল) মিলও রয়েছে। ধান ভাঙ্গার ছয়টি মিলের পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ বাঁধ ছিদ্র করে নদীতে টানা হয়েছে। এতে ধলেশ্বরী নদীর পানি বিনষ্টসহ পরিবেশেই নেতিবাচক প্রভাব পরছে। মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদফতরের ইনচার্জ সিনিয়র ক্যামিস্ট মিয়া মাহমুদুল হক জানান, বাঁধ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তদারকি প্রয়োজন। নদী রক্ষা কমিশনের তদারিকও বাড়াতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ২৭ কিলোমিটার মুন্সীগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধটি মুক্তারপুর সেতুর কাছ থেকে শুরু হয়ে লঞ্চঘাট, রমজানবেগ ও মুন্সিরহাট হয়ে শহর ঘুরে পুনরায় মুক্তারপুর সেতুর কাছে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু মাত্র ২ দশিকি ৬ কিলোমিটার হয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। যথাযথ মনিটরিং তথা নেতৃত্বে অভাবের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি ফসকে গেছে। ত’কালীন মেয়র এ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান এই প্রকল্প গ্রহণ এবং প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেকেন্ডারি টাউন ইনটিগ্রেটেট ফ্ল্যাট প্রটেকশন প্রজেক্ট-২ (এসটিআইএফটিপি) আওতায় ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এটি অনুমোদিত হয়। পানি উন্নয়বোর্ড এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধের কাজটি শুরু করে। একই প্রকল্পের আরেকটি অংশে আর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর শহরের ভেতরের অংশে ড্রেন, সড়ক নির্মাণসহ অন্যান্য কাজ করে। এই তথ্য দিয়ে মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার আক্তার হায়দার জানান, জমি অধিগ্রহণের টাকা যথা সময়ে জামা না হওয়ারসহ নানা দীর্ঘ সূত্রতার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, ফসকে যায় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্প। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী শামসুর রহমান জানান, জমি অধিগ্রহণের পরও বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে নানা রকম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। এতে বিদেশীরাও বিরক্ত। নদীতীরের বাধাহীন জমি পাওয়া গেলে প্রকল্পের বাকি অংশ অনায়াসে সম্পন্ন হতো। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে প্রায় ২৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে শহর রক্ষাবাঁধের নির্মাণ শুরু হয়। প্রথম ধাপে মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাটের ধানের চাতাল থেকে শহরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ শাখা নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৬ কিলোমিটার ২০১২ সালে কাজ সম্পন্ন হয় মাত্র। বর্তমানে প্রকল্পের বাকি অংশ সম্পন্ন এবং নির্মিত বাঁধের মেরামত জরুরী হয়ে পড়েছে। এর আগে মুক্তারপুর থেকে বিনোদপুর পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হয় এটির অবস্থাও নাজুক। জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল জানান, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংরক্ষণ এবং বাধের বাকি অংশ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই বাঁধের ওপরে ইট-বালুর ব্যবসা বন্ধ করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়েছে। বাঁধের ওয়াক ওয়ে পরিচ্ছন্ন করা হয়েছ। যাতে সাধারণ নির্বিগ্নে যাতায়াত করতে পারে। এছাড়া ধলেশ্বরী তীরে এখন সবুজ বেষ্টনী হয়েছে। এগুলো সুরক্ষায় সবরকম প্রচেষ্টা চলবে।
×