ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

০ অর্থের লোভে জটিল রোগের চিকিৎসা চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে অনেক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক, ঘটছে অকাল মৃত্যু ;###;০ দশ দিনের মধ্যে সেবার ধরন, ডাক্তার-নার্সসহ জনবল ও ব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রপাতির সংখ্যা জানানোর নির্দেশ

রমরমা বাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১১ অক্টোবর ২০১৫

রমরমা বাণিজ্য

নিখিল মানখিন ॥ পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও মেডিক্যাল উপকরণ ছাড়াই চলছে অনেক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ছোটখাট আকারের হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনার সাধারণ লাইসেন্স নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। সক্ষমতা না থাকলেও অর্থের লোভে জটিল জটিল রোগের চিকিৎসা চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে অনেক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ। এ ধরনের সঙ্কট নিরসনে আগামী দশ দিনের মধ্যে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসমূহের সেবার মান, জনবল ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির তালিকা পাঠাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অনুমোদন ছাড়াই চলছে কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি অভিযানে অনেক নিম্নমান ও অবৈধ বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শামিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক জরুরী বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোন কোন বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক নির্দিষ্টসংখ্যক শয্যাবিশিষ্ট সাধারণ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিনা অনুমতিতে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা (আইসিইউ, সিসিইউ, এনআইসিইউ, কিডনি ডায়ালাইসিস, ডায়াবেটিস ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র) কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, এসব সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে উপযুক্ত যন্ত্রপাতি ও জনবলের অভাবে কখনও কখনও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার উদ্ভব হচ্ছে। তাছাড়া সঠিক তথ্যের অভাবে এসব সেবা প্রদানের বিষয়ে মনিটরিং কার্যক্রমে বিঘœ ঘটছে। এ কারণে সব বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিককে ১০দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানে সেবার ধরন, চিকিৎসক ও নার্সসহ কর্মরত মোট জনবল ও ব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রপাতির সংখ্যা জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি লালমাটিয়ার এশিয়ান হাসপাতালে চিকিৎসক-নার্সের বিরুদ্ধে ছয় শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। এছাড়া ধানম-ির একটি বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগে হাসপাতালে ভাংচুর ও কর্মকর্তাদের মারধর করে রোগীর স্বজনরা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালে এ ধরনের বিশেষায়িত ও স্পর্শকাতর ইউনিট খোলার জন্য ডাক্তার, নার্সসহ প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি থাকা অত্যাবশ্যক। অভিযোগ উঠেছে, সাধারণ লাইসেন্স থাকার তথ্য গোপন করে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ছাড়া বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা প্রদানের নামে রমরমা ব্যবসা খুলে বসেছে বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। ফলে ওই সব হাসপাতালে সুচিকিৎসার অভাবে রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকর্মীরা এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করলেও তেমন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য অধিদফতর। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সুবিধা ও উপকরণ ছাড়াই চলছে রাজধানীর কিছুসংখ্যক হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)। অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মেডিক্যাল উপকরণ ও ওষুধের পরিমাণ দেখিয়ে বিল বাড়িয়ে দেয়া হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাখা হয় না। দু’তিনটি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা সব রোগের চিকিৎসা করানোর ব্যবসা চালানো হয়। অনেক হাসপাতালে আইসিইউর শতকরা ৭০ ভাগ শয্যার সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। শতকরা ৬০ ভাগ আইসিইউতে প্রতিটি শয্যার জন্য একজন করে সেবিকা নেই। আর সেবিকা যারা আছেন তাদের শতকরা ৬৪ ভাগের প্রশিক্ষণ নেই। খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনিতেই উচ্চ ফি ও সীমিত শয্যার কারণে আইসিইউ সেবা নিতে পারে না অনেক দরিদ্র রোগী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যানেসথেসিয়া, এ্যানালজেসিয়া, এ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, আইসিইউতে রোগীকে ওঠা-নামানো, কাত করাসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) ও কার্ডিয়াক মনিটর (হৃদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপক), ইনফিউশন পাম্প (স্যালাইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র) দরকার। আইসিইউতে শক মেডিশন (হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র), সিরিঞ্জ পাম্প (শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে যে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় তার মাত্রা নির্ধারণের যন্ত্র), ব্লাড ওয়ার্মার (রক্ত দেয়ার আগে শরীরের ভেতরকার তাপমাত্রার সমান করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) থাকবে। পাশাপাশি কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন (মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ) থাকতে হবে। তারা বলেন, জরুরী পরীক্ষার জন্য আইসিইউসির সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। কিন্তু অনেক বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এসব ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, জটিল রোগের চিকিৎসায় ও জরুরী প্রয়োজনে আইসিইউর সেবা নিতে হয়। চিকিৎসকরাও এই সেবার কথা ব্যবস্থাপনাপত্রে লেখেন। কিন্তু খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিযোগ করেন, বর্তমানে আইসিইউ একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আইসিইউগুলো কে কিভাবে চালাচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারিতে থাকা উচিত। রাজধানীর নামী হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর দৈনিক খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং মাঝারি হাসপাতালগুলোতে খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বলা হলেও তার দ্বিগুণ টাকা দিতে হয় রোগীকে। মানহীন ও অবৈধ বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, রাজধানীসহ সারাদেশে সরকারী হাসপাতালকে কেন্দ্র করে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে বেসরকারী অসংখ্য ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সরকারী হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে চিকিৎসাবাণিজ্য করাই ওই সব বেসরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার তাদের কেউ কেউ অনুমোদনের জন্য আবেদন করেই ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। স্থায়ী ভিত্তিতে কোন চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ করা থাকে না। হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে ওই সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রয়েছে গোপন সমঝোতা । সরকারী হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত করে দালাল চক্র। তাদের অমানবিক বাণিজ্যিক খেলার খপ্পরে পড়ে অপচিকিৎসার শিকার হয় অনেক রোগী। ভুল চিকিৎসার পাল্লায় পড়ে অকালে একের পর এক রোগীর মৃত্যু ঘটছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট কোন চার্জ নেই। তবে বিলম্বে হলেও এখন ঘুম ভেঙ্গেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের। এবার তারা প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে মুখ খুলেছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেশের সব বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক মালিকের কাছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সেবার ধরন, চিকিৎসক ও নার্সসহ কর্মরত মোট জনবল ও ব্যবহৃত চিকিৎসা যন্ত্রপাতির সংখ্যা জানতে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফর্মেশন সার্ভিসেস (এমআইএস) প্রকাশিত সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৪’র তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বৈধ লাইসেন্সধারী ২ হাজার ৯৮৩টি বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিক ও ৫ হাজার ২২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। তবে রাজধানীসহ সারাদেশে সমপরিমাণের চেয়ে বেশিসংখ্যক লাইসেন্সবিহীন বেসরকারী হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
×