ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা সফররত এপিজি প্রতিনিধি দলটি রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে ;###;দুদক কোকোর পাচার করা অর্থসহ আরও অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া তুলে ধরে

সন্তুষ্ট জাতিসংঘ

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ১২ অক্টোবর ২০১৫

সন্তুষ্ট জাতিসংঘ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশ থেকে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ঢাকা সফররত জাতিসংঘের এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের (এপিজি) প্রতিনিধি দল। ররিবার সচিবালয়ে এপিজি সেক্রেটারিয়েটের আট সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এ কথা জানান। এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থপাচার বিশেষজ্ঞ দলের কাছে নিজেদের তদন্তের সফলতার তথ্য তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অর্থপাচারে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থাটি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনার তথ্য তুলে ধরে দুদক বলছে, বিদেশে পাচার হওয়া আরও অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। দুই সপ্তাহের সফরে আসা এ বিশেষজ্ঞ দলটি রবিবার অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করে। সচিবালয়ে বৈঠক শেষে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেশ থেকে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ঢাকা সফররত এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের (এপিজি) প্রতিনিধি দলটি। বৈঠকে তারা মিউচুয়াল ইভালুয়েশনের অন সাইট ভিজিট সম্পর্কে আলোচনা করেছে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান তুলে ধরেছি। প্রাথমিকভাবে এ অবস্থান তাদের কাছে ভাল লেগেছে। তারা কোন শঙ্কার কথা জানায়নি। তবে কিছু ঘাটতি ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে, যা তারা জানে। আমরা বলেছি, তা শীঘ্রই পূরণ করতে চেষ্টা করব। প্রতিমন্ত্রী বলেন, মানিলন্ডারিং বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশের সিআইডি বিভাগের মধ্যে মাঝে মধ্যে ওভারল্যাপিং হয়ে থাকে। এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করতে দুই বিভাগকে শক্তিশালী করার বিষয়ে কাজ চলেছে বলে তাদের জানানো হয়েছে। বিদেশী নাগরিক হত্যার বিষয়ে এ বৈঠকে কোন আলোচনা হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনা আইনশৃঙ্খলার বিষয়। আর আজকের (রবিবার) বিষয় জঙ্গী অর্থায়ন। ফলে এ বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি। তাদের পক্ষ থেকেও কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি। বৈঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলমসহ মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও ডেভিড শ্যাননের নেতৃত্বে এপিজি সেক্রেটারিয়েটের আট সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন মিশেল হারউড, অনিল রামটেকি, ঝু কুইপেং, শেরিল রামাদান, দোলন সরকার, ক্রিস এনজি। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান ফেরদৌস কবির ও সালাহউদ্দিন মাহমুদ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অর্থপাচার বিশেষজ্ঞ দলের কাছে নিজেদের তদন্তের সফলতার তথ্য তুলে ধরেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রবিবার দুপুরে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে এপিজিএমএলের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে দুদকের মতবিনিময় সভায় দুদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অর্থপাচারে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি দমন সংস্থাটি স্বাধীনভাবে কাজ করছেÑ বৈঠক সূত্র এসব বিষয়ে নিশ্চিত করে জানায়। বিশেষজ্ঞ দলের কাছে দুদকের পক্ষ থেকে বিএনপি চেয়ারপার্র্সন খালেদা জিয়ার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনার তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এফএটিএফের অবশিষ্ট শর্ত পরিপালনে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ২০০৮ ও ২০১২ সালের এপিজির অনসাইট ভিজিটের পর্যবেক্ষণগুলোর আলোকে সেগুলো মূল্যায়ন ও বাস্তবায়নের দিকটি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করেছি। তিনি আরও বলেন, দুদক আইন ২০০৪, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এবং সন্ত্রাসে অর্থায়ন অধ্যাদেশ ২০১৩’র আলোকে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তি ও মানিলন্ডারিং মামলা নিবিড়ভাবে পরিচালনা করছি। আমি বিশ্বাস করি, এক্ষেত্রে আমাদের সফলতা উৎসাহব্যঞ্জক। কোকোর পাচার করা টাকা আনাকে নিজেদের বড় সফলতা দাবি করে দুদক চেয়ারম্যান এপিজিএমএলের প্রতিনিধি দলকে বলেন, আমরা সফলতার সঙ্গে পাচার করা ২১ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরত আনতে পেরেছি। বিদেশে পাচার হওয়া আরও অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি। সভায় আট সদস্যের বিশেষজ্ঞ দলটির নেতৃত্বে ছিলেন এপিজিএমএলের সেক্রেটারিয়েটের কর্মকর্তা ডেভিড শ্যানন। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন দুদক চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান। দুদক ছাড়াও এ সভায় বাংলাদেশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সিআইডি ও বিএফআইইউ’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও বৈঠকজুড়ে আলোচনায় ছিল দুদকের অর্থপাচার সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তদন্তের বিভিন্ন বিষয়। বৈঠকে ডেভিড শ্যানন ও তার দলের কর্মকর্তারা দুদকের অর্থপাচার অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম কিভাবে পরিচালনা করা হয় তা জানতে চান। দুদকের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির উর্ধতন কর্মকর্তারা অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম তুলে ধরেন। কমিশনের মহাপরিচালক ব্রিজে (অব) এম এইচ সালাহ্উদ্দিন কমিশনের কার্যক্রম ও ন্যাশনাল রিস্ক এ্যাসেসমেন্টের কার্যক্রম সংক্রান্ত লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ও কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ। দুদক সূত্র জানায়, আগামীকাল মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এপিজিএমএলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক হবে। দুদক সূত্র জানায়, এপিজির সঙ্গে বৈঠক সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি কয়েকদিন আগেই বিশদ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বৈঠকে অর্থপাচার সংক্রান্ত দুদকের অনুসন্ধান-মামলাসহ নানা বিষয় বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্সের আদলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য গঠিত এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং (এপিজিএমএল) গঠিত হয়েছে। সূত্র জানায়, এপিজির বাংলাদেশ সফর সরকারের জন্য অনেক গুরুত্ব বহন করে। কারণ, মানিলন্ডারিং ও জঙ্গী অর্থায়নে যেসব সাফল্য সরকার অর্জন করেছে তার সবকিছুই ম্লান হয়ে যেতে পারে এপিজির প্রতিবেদনে। এখানে অবস্থানের সময় এপিজি প্রতিনিধি দলটি সরকারী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যে ধারাবাহিক বৈঠক করবে তার ফল নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে এর প্রধান কার্যালয়ে। তার ওপর ভিত্তি করে সরকারকে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দেবে এপিজি। সূত্র জানায়, নেতিবাচক প্রতিবেদন বাংলাদেশকে ধূসর তালিকাভুক্ত করতে পারে, যা থেকে বের হতে সরকারকে আবারও অনেক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০১৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘ফিন্যান্সিয়াল এ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) প্ল্যানারি সভায় জঙ্গী ও সন্ত্রাসে অর্থায়নকারী দেশের ‘গ্রে লিস্ট’ (ধূসর তালিকা) থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। এখন বাংলাদেশ কোন তালিকায় নেই। কিন্তু মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেয়া হলে বাংলাদেশ আবারও ধূসর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে রবিবারের বৈঠকে প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করায় আপাতত আশার আলো দেখছে সরকার। সূত্র জানায়, মিউচুয়াল ইভালুয়েশন প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ হলেও এটি একটি জাতির মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার অপার সম্ভাবনা তৈরি করে। সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বিশ্বের কাছে আবার তুলে ধরার জন্য এ মিউচুয়াল ইভালুয়েশন অফুরন্ত সুযোগ তৈরি করছে। মিউচুয়াল ইভালুয়েশনের প্রতিবেদন আগামী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় এপিজির বার্ষিক সভায় উপস্থাপন এবং গৃহীত হবে, যা ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে। মিউচুয়াল ইভালুয়েশনে ভাে রেটিং পেলে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যয় কমবে, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের প্রবাহ বাড়বে, বিদেশে বাংলাদেশ একটি কমপ্লাইন দেশ হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। জানা গেছে, এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিংয়ের প্রতিনিধিদলটি গত ৮ অক্টোবর ঢাকায় আসে। আগামী ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করবে। এই সময়ে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড), দুর্নীতি দমন কমিশন (এসিসি), সিকিউরিটি এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন, এনবিআরের কাস্টমস বিভাগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, র‌্যাবসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ব্যবস্থা শীর্ষক বিভিন্ন ইস্যুতে বৈঠক করবে।
×