ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ : এনামুল হক

নাসেরের জামাতা ছিলেন ইসরাইলী স্পাই!

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১২ অক্টোবর ২০১৫

নাসেরের জামাতা ছিলেন ইসরাইলী স্পাই!

আশরাফ মারওয়ান। মিসরের প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ক জামাল আবদুল নাসেরের জামাতা। বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্পাই হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়। তবে মিসরের এই বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী কার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন, সেটা স্পষ্ট নয়। কেউ বলেন ইসরাইলের পক্ষে, কেউ বলেন মিসরের পক্ষে আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন ডবল এজেন্ট। তার এই গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধটি লেখেন সিমন পারকিন। আজ পড়ুন শেষ কিস্তি... ওদিকে মিসরে মারওয়ান আগের মতোই আস্থা ভোগ করতে থাকেন। ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট নাসেরের মৃত্যুর পর ধারণা করা হয় যে তিনি ইসরাইলী গোপন নথিপত্র নাসেরের উত্তরসূরি আনোয়ার সাদাতের হাতে দিতেন। এতে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও বেড়ে যায়। মারওয়ান সম্পর্কে মোসাদের তখনও যদি কোন সন্দেহ-সংশয় থেকে ছিল সেটা জোরালো হয়ে ওঠে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে। এ সময় তিনি মিসরের আসন্ন হামলা সম্পর্কে একটা হুঁশিয়ারি বার্তা ইসরাইলীদের কাছে পাঠান। ইসরাইল হাজার হাজার রিজার্ভিস্ট এবং বেশ কয়েক ব্রিগেড সৈন্য সিনাইয়ে মোতায়েন করে। কিন্তু কোন হামলা হয়নি। অথচ এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে ইসরাইলের সাড়ে তিন কোটি ডলার ব্যয় হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের ৪ অক্টোবর মারওয়ান মিসরের আসন্ন হামলা সম্পর্কে ইসরাইলকে আবারও হুঁশিয়ারি দেন। মারওয়ান সে সময়, এক মিসরীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্যারিসে ছিলেন। ওখানে তিনি ইসরাইলী এজেন্টকে ফোনে বলেন যে, তিনি বেশকিছু কেমিক্যালের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চান। আসন্ন হামলা সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দেয়ার জন্য যে সাংকেতিক শব্দ দুই পক্ষ মিলে ঠিক করেছিল তা হলো ‘বেশ কিছু কেমিক্যাল’। পরদিন সকাল ৮টায় ইসরাইলী মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠক হয়। সেখানে মারওয়ানের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইসরাইল ট্যাঙ্ক মোতায়েন করতে শুরু করে। এবার মারওয়ানের তথ্যটা ঠিক ছিল। শুধু চার ঘণ্টার হেরফের হয়েছিল। মারওয়ান জানিয়েছিলেন মিসরীয়রা সূর্যাস্তের সময় আঘাত হানবে। কিন্তু ওদের হামলা শুরু হয় ৪ ঘণ্টা আগে বেলা ২টায়। প্রশ্ন হলো মারওয়ান কেন ইসরাইলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত সেই উত্তরের মধ্যে নিহিত রয়েছে তার প্রকৃত আনুগত্য এবং তার ঘাতকদের পরিচয়। নগদ অর্থের সঙ্কট এবং শ্বশুরের ওপর রাগ থেকেই কি তিনি ধনী হওয়ার জন্য ইসরাইলের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, নাকি একজন নিখাঁদ দেশপ্রেমিক হিসেবে ডবল এজেন্টের ভূমিকা নিয়ে তিনি ইসরাইলকে এমন সব তথ্য পরিবেশন করতে চেয়েছিলেন যাতে দেশটার সর্বনাশ হয়? মারওয়ান যে ইসরাইলের সঙ্গে কাজ করতেন তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। ২০০০-এর দশকের প্রথমদিকে স্ত্রী মোনা নাসের এ নিয়ে স্বামীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। প্রথমে মারওয়ান ইসরাইলীদের কাছে তথ্য পাচারের কথাটা অস্বীকার করে বসেন। পরে অবশ্য স্বীকার করেন। তবে বলেন, সেগুলো ছিল ভুল তথ্য। আসল সত্যি কোন্টা ব্রেগম্যান বিশ্বাস করেন এই উত্তর তার জানা আছে। তবে আরেক প্রশ্ন তাকে পীড়িত করে তোলে : মারওয়ানের মৃত্যুর জন্য কি তিনি দায়ী? এখানে প্রশ্ন আসে, কে এই ব্রেগম্যান? মারওয়ানের সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিল তার? এহরন ব্রেগম্যান একজন ব্রিটিশ-ইসরাইলী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, লেখক ও সাংবাদিক। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অধিকারী। এর ওপর দশটিরও বেশি বই লিখেছিলেন। তার মধ্যে সর্বদা একটা তথ্যানুসন্ধানী মন কাজ করে চলে। মোসাদের বিখ্যাত ‘এঞ্জেল’ নামক এজেন্টটি যে আসলে মারওয়ান তা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি বের করেছিলেন এবং ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ওপর লেখা তার একটি বইতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। ‘এঞ্জেলের’ পরিচয় বের করার জন্য প্রথমে তিনি ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধের ওপর যত বই বা লেখালেখি বেরিয়েছিল সব ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেন। গোড়াতে তার মারওয়ানের ওপর সন্দেহ গিয়ে পড়ে। এ নিয়ে যত বেশি ঘেঁটে দেখেছেন ততই তার সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। মারওয়ান তার সেই পরম আকাক্সিক্ষত জন হয়ে দাঁড়ান যার পরিচয় সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার নিজের কাছে নিস্তার নেই। সন্দেহটা যখন বদ্ধমূল হলো তখন থেকে ব্রেগম্যান এ প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালিখি শুরু করলেন। কিন্তু মারওয়ানের নাম সরাসরি কোথাও উল্লেখ না করে আভাসে-ইঙ্গিতে বললেন ১৯৯৯ সাল থেকে ব্রেগম্যান মারওয়ানকে তার লেখা নিবন্ধগুলো পাঠাতে শুরু করেন এই আশায় যে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আসবে। কিন্তু কিছুই আসেনি। শেষে ব্রেগম্যান এক কৌশল বের করেন। ইসরাইলে গিয়ে সেখানকার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল এলি জেইরার সঙ্গে দেখা করার আয়োজন করেন। কেন? জেনারেলের একটা স্মৃতিকথা বেরিয়েছিল যেখানে ‘এঞ্জেলের’ প্রসঙ্গ অসংখ্যবার উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে এঞ্জেলের (মারওয়ান) দেয়া ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য এই জেনারেল চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। ব্রেগম্যানের ধারণা ছিল, জেইরা যদি কিছুতেই মারওয়ানের নাম কনফার্ম না করেন তা হলে তিনি তার স্মৃতিকথার সম্পাদনা ও প্রকাশনার কাজটা যিনি করেছিলেন তার দ্বারস্থ হবেন। তিনি হয়ত কনফার্ম করবেন। ২০০০ সালে ব্রেগম্যান সেই সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করেন। তেল আবিরের এক কাফেতে দু’জনে বসেন। অন্তরঙ্গ আলাপ হয়। এক পর্যায়ে ব্রেগম্যান সরাসরিই জিজ্ঞাস করে বসেন ‘মারওয়ান কি স্পাই?’ সম্পাদক অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মৃদু হাসলেন। ব্রেগম্যান বলেন, ‘আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম। মারওয়ানই এঞ্জেল।’ লন্ডনে ফিরে বই লেখার কাজে মনোনিবেশ করলেন ব্রেগম্যান। এ বিষয়ের ওপর তার প্রথম বই ‘ইসরাইলস্ ওয়ারস্’ ২০০০ সালের শেষদিকে ছাপা হয়; যেখানে তিনি মারওয়ানের নামটা উহ্য রেখে ‘এঞ্জেল’কে নাসেরের ডানহাত বলে উল্লেখ করেন। ব্রেগম্যান বইয়ের একটা কপি মারওয়ানকে পাঠিয়ে দেন। মারওয়ান কোন জবাব দেননি। ২০০২ সালে ব্রেগম্যানের দ্বিতীয় বই বের হয় ‘হিস্ট্রি অব ইসরাইল’। সেখানে তিনি লেখেন ‘এঞ্জেল ছিলেন নাসেরের এক আত্মীয়। অনেক সময় তাকে ‘জামাই’ এই সাঙ্কেতিক নাম উল্লেখ করা হতো।’ তার এই শেষের কথাটা ছিল নির্জলা মিথ্যা যা তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে লিখেছিলেন মারওয়ানকে উস্কানি দেয়ার জন্য। বইয়ের একটি কপিও তিনি মারওয়ানকে পাঠিয়ে দেন। উপহার হিসেবে লেখেন ‘টু মারওয়ান, হিরো অব ইজিপ্ট।’ এবারও মারওয়ান কোন সাড়া দেননি। কিন্তু সাংবাদিকরা তার ঐ বই থেকে যা পাবার পেয়ে গিয়েছিল। মিসরে এক সাংবাদিক মারওয়ানের এক সাক্ষাতকার নিয়ে তাকে সরাসরি বইয়ের এসব বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে মারওয়ানের জবাব ছিল : ‘বইটা একটা অর্থহীন ডিটেকটিভ কাহিনী।’ ব্রেগম্যান তার এই মন্তব্য থেকে আরও নিশ্চিত হলেন যে এঞ্জেল আর মারওয়ান একই ব্যক্তি। কারণ, মিথ্যা হলে মারওয়ান মানহানির মামলা দায়েরের হুমকি দিতে পারতেন। তা না করে ওটাকে তিনি কল্পকাহিনী বলে উড়িয়ে দিলেন। ব্রেগম্যানের জেদ চেপে গেল। পরের সপ্তাহে মিসরের সাপ্তাহিক আল আহরাম আল-আরাবিক-এর কাছে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ‘ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজের সুনাম রক্ষা করার জন্য আমাকে বলতেই হচ্ছে মারওয়ান একজন গুপ্তচর।’ এভাবেই মারওয়ানের নামটা প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে ও সুস্পষ্টভাবে গুপ্তচর হিসেবে উঠে আসে। সাক্ষাতকারটি ছাপা হওয়ার এক সপ্তাহ পর ব্রেগম্যান এক ফোনকল পান। আরবী একসেপ্টে মোটা গলায় অপরপ্রান্ত থেকে একজন বলে ওঠে : ‘আমিই সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে আপনি বইয়ে লিখেছেন’। ব্রেগম্যান বলেন ‘প্রমাণ কি?’ উত্তর আসে ‘আপনি আমাকে বই পাঠিয়েছেন...লিখেছেন...’ তখন থেকেই দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার শুরু। অসংখ্যবার ফোনে কথা হয়েছে, দেখা হয়েছে কেবল একবারই, ২০০৩ সালের অক্টোবর। মারওয়ান তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে তার সমস্ত কল মিসরীয় ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সার্ভিস রেকর্ড করে থাকে। ব্রেগম্যান উল্লেখ করেছেন যে, ২০০৭ সালে তাদের সম্পর্ক আরও বেশি নাটকীয় রূপ নেয়। মারওয়ানের আনসার ফোন বার্তাগুলোতে আতঙ্কের ছাপ থাকত। মারওয়ানই যে এঞ্জেল তা উন্মোচন করে ব্রেগম্যান তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন সত্য। কিন্তু ওটা ছিল একজন ইতিহাসবিদের উক্তি। এমন বক্তব্য কোন সরকারের উচ্চতর পর্যায় থেকে কখনও আসেনি। তবে মারওয়ান ইসরাইলের একটি আদালতে এক হাই প্রোফাইল মামলার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। মামলাটি ছিল দুই সিনিয়র ইসরাইলী অফিসারের- জেনারেল জেইরা এবং মোসাদের সাবেক প্রধান জামিরের মধ্যকার বিরোধ থেকে যার উৎপত্তি। জামির অভিযোগ করেছিলেন, জেইরা মারওয়ানের পরিচয় সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করেছিলেন। জেইরা জামিরের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। মামলা বেশ কিছুদিন ধরে চলার পর ২০০৭ সালের ২৫ মার্চ বিচারক রায় দেন যে জাইরাই দোষী। কারণ, তিনি এঞ্জেলের পরিচয় অনুমোদিত ব্যক্তিদের কাছে ফাঁস করেছিলেন। তিন মাস পর রায়টা প্রকাশ করা হয়। সেখানে বিচারক প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে এঞ্জেল হিসেবে মারওয়ানের নাম উল্লেখ করেন। ব্রেগম্যান রায়ের রিপোর্ট দেখার সঙ্গে সঙ্গে মারওয়ানকে চিঠি লিখে জানান যে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। ১৪ জুন এই রায় বেরোনোর ১৩ দিনের মধ্যে মারওয়ান মারা যান। সূত্র : গার্ডিয়ান
×