ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১২ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

শৈশবের স্মৃতি (১১ অক্টোবরের পর) বিশ্বযুদ্ধ এ পর্যন্ত মাত্র দুটিই হয়েছে। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ পর্যন্ত প্রথম মহাযুদ্ধ এবং ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। তৃতীয় মহাযুদ্ধ মানবজাতি নানাভাবে আটকে রেখেছে যদিও দেশে দেশে অঞ্চলভিত্তিক ছোটখাটো যুদ্ধ অনেকগুলো হয়েছে। কোন্ যুদ্ধকে আমরা বিশ্বযুদ্ধ বলবো? আমার মনে হয় এ ব্যাপারে বেশকিছু মানদ- ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রথমেই বলা যায় যে, বিশ্বযুদ্ধ কোন নির্দিষ্ট এলাকায় হয় না, যুদ্ধে লিপ্ত দুটি দলের যে কোন দেশে যে কোন এলাকায় এই যুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে। সব সময় দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধও হয় না। রাতের অন্ধকারে বোমাবর্ষণ অথবা অদৃশ্য থেকে অস্ত্রের সাহায্যে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া বা কোন জনপদ বা কারখানা ছারখার করে দেয়া বিশ্বযুদ্ধের কৌশলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বযুদ্ধে শুধু সৈন্যরা হতাহত হয় না। বিবদমান পক্ষের যে কোন ব্যক্তি বা এলাকা আক্রমণের শিকার হতে পারে। একদিকে যেমন কাচ্চা-পাচ্চা, চাষী-শ্রমিক, সরকারি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারী মারা যেতে পারে, অন্যদিকে তেমনি খেলার মাঠ, পড়াশোনার কোন প্রতিষ্ঠান, পণ্যদ্রব্যের কোন বাজার, সুরম্য প্রাসাদ বা বস্তি এলাকা, জলাশয় বা কৃষিক্ষেত্র যে কোন জায়গায় অথবা যে কোন সমাবেশে হত্যাযজ্ঞ সাধিত হতে পারে। তৃতীয়ত, এ রকম যুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ বা এলাকা বিবদমান দলের আক্রমণ থেকে সব সময় রেহাই পায় না। চতুর্থত, এ রকম যুদ্ধ ব্যাপকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর। কোন বিশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার বা কৌশলের প্রয়োগ যুদ্ধের গতি রাতারাতি বদলে দিতে পারে। পঞ্চমত, বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং তাতে এক হিসেবে পৃথিবীর সব দেশ এবং সব গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি বিশ্বযুদ্ধ পরিহারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে। সে কারণেই হয়তো শেষ বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে ৭০ বছর আগে, যদিও দুটি মহাযুদ্ধের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ২১ বছর। আমার শৈশবে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লাগে সেখানে মিত্রশক্তি বলে আমাদের কাছে পরিচিত ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে তুর্কীসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ। অক্ষশক্তির সদস্য ছিল জার্মানি এবং ইতালি। মিত্রশক্তির সঙ্গে চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও যোগ দেয়। অক্ষশক্তিতে অবশেষে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে জাপান যোগ দেয়। এই মহাযুদ্ধ ৬ বছর ১ দিন স্থায়ী হয়। শুরু হয় ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে এবং শেষ হয় ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে। মিত্রশক্তির নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ঋ. উ. জড়ড়ংবাবষঃ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডরহংঃড়হ ঈযঁৎপযরষষ, রাশিয়ার নেতা ঔড়ংবঢ়য ঝঃধষরহ এবং চীনের জাতীয়বাদী নেতা ঈযরধহম কধর-ংযবশ। অক্ষশক্তির নেতৃত্বে ছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর অফষড়ভ ঐরঃষবৎ, ইতালির রাষ্ট্রপ্রধান ইবহরঃড় গঁংংড়ষরহর এবং জাপানের সম্রাট ঐরৎড়যরঃড়। ঋৎধহশষরহ জড়ড়ংবাবষঃ যুদ্ধাবসানের সামান্য আগে দেহত্যাগ করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ঐধৎৎু ঞৎঁসধহ। এই যুদ্ধে ২ কোটি ৪০ লাখ সৈন্য নিহত হয়। আর সাধারণ জনগণ নিহত হয় প্রায় ৫ কোটি। প্রথম মহাযুদ্ধে ৪টি সামাজ্য বিলুপ্ত হ“ কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সে রকম কোন বিলুপ্তি সাধন হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বেশ কিছুদিন একটি অনিশ্চিত বিষয় ছিল যে, রাশিয়া কোন্ দলে থাকবে। এই যুদ্ধের আসল হোতা জার্মানি যদিও ১৯৪৫ সালের ৮ মে’তে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে, জাপান কিন্তু তার পরেও ৩ মাসের বেশি সময় যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। ১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ আগস্টে হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে দুটি আণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরেই জাপান ১৫ আগস্ট আত্মসমর্পণ করে। অনেকে বলেন যে, আণবিক বোমা বিস্ফোরণের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ঞৎঁসধহ আর অপেক্ষা করতে রাজি ছিলেন না। আমরা দুই ভাই হেঁটে স্কুলে যাই। আমাদের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব আধা মাইলের কিছু বেশি। প্রায় সব ছাত্রই তখন পায়ে হেঁটে স্কুলে আসত। কিছু ছাত্র ২/৩ মাইল হেঁটে স্কুলে আসত। আমার বড় বোন প্রতিদিন আমাদের দুই ভাইকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে এবং বইপত্র গুছিয়ে দিয়ে স্কুলে পাঠাতেন। স্কুলে আমাকে সহপাঠীরা প্রায়ই হেনস্তা করত। আমি কোন পাঠশালায় পড়িনি এবং বয়সে বেশ ছোট ছিলাম; সেই সুযোগটা তারা গ্রহণ করত। আমি লেখালেখিতেও তেমন দুরস্ত ছিলাম না। খাগড়ার কলমের কালিতে আমার কাপড়-চোপড় মাঝে-মধ্যে নষ্ট হতো। আমাকে হেনস্তা করার জন্য সহপাঠীরা ইচ্ছা করে আমার কাপড়ে কালি মেখে দিত। আমিও তেড়ে উঠে তাদের মারতে যেতাম। কিন্তু একা ৪/৫ জনের সঙ্গে কোনমতেই পেরে উঠতাম না। তারা মাঝে মাঝে ধরে আমার জুতো খুলে নিত এবং আমাকে জুতোটা খুঁজে নিতে হতো। দেখতে দেখতে ৬ মাস চলে গেল। মধ্যবার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। আমার ভাই পরীক্ষায় বেশ ভাল করলেন। আমি তেমন কিছু কৃতিত্ব দেখাতে পারলাম না। যাহোক, আস্তে আস্তে বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকল এবং আমরা অন্য ছেলেদের মতোই ব্যবহার করতে শুরু করলাম। এই ব্যবহারের ফলে আমরা জুতো বাদ দিয়ে খালি পায়েই স্কুলে যেতে শুরু করলাম। খাগড়ার কলম দিয়ে লেখার সময় একটু সাবধানতা অবলম্বন করতে শিখলাম। প্রথম দিকে অন্যদের সঙ্গে যে রকম ঝগড়াঝাটি হতো তার প্রশমন হলো। তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে আমরা উন্নীত হলাম। আমার ভাই মেধা তালিকায় ৯ম স্থান দখল করলেন। আমি ১৬তম স্থানে পাস করলাম। আমার আব্বা এতে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন এবং আমাকে পরীক্ষায় ভাল না করার জন্য ধমকালেন। আমি তাতে বেশ বিচলিত হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো যে, আমি তো খুব খারাপ করিনি। ৭০-এর বেশি নম্বর প্রায় প্রতিটি বিষয়ে পেয়েছি এবং ৮০/৯০ও কোন কোন বিষয়ে পেয়েছি। আমার প্রশ্ন হলো যে, আমি তো মন্দ করিনি, তাহলে আমার ওপর এত চোটপাট কেন। এখন মনে হয় যে, আসলেই আমার প্রতিযোগিতার স্পিরিট ছিল না এবং সেইটিই বোধ হয় আমার আব্বা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আমি এত ক্ষুব্ধ হলাম যে, একটি ব্যাগে কাপড়-চোপড় নিয়ে গৃহত্যাগের পরিকল্পনা করলাম। তার সুযোগ অবশ্য আমি পেলাম না। সম্ভবত আমার ভাইবোনদের কারণে। কারণ ততদিনে আমরা ৭ জন ভাইবোন হয়ে গেছি। আমি কোনমতেই পালাবার ফাঁক পেলাম না। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় সুরমা নদীর অপর পারের এক বছরের কনিষ্ঠ এক ছাত্রের সঙ্গে একদিন আমার ঝগড়া হয় এবং আমি তাকে “ক্ষিত্তার গু-া” বলে গালি দিই। ক্ষিত্তা ছিল সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে এবং সেখানকার বেশকিছু লোক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বা গুণ্ডামিতে বিখ্যাত ছিল। সেই ছাত্র এতে খুবই ক্ষুব্ধ হয় এবং ২/১ দিন পর আমাকে একা পেয়ে বুকে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। তার হাতে একটি ছোট ছুরি ছিল। সেটা দিয়ে সে আমাকে মারেনি; কিন্তু ভয় দেখায়। আমি এই ঘটনায় দারুণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যাই। আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে এ ব্যাপারে আমার ভীতির কথা তুলে ধরি। এই খবরটি নাইওরপুলের আমার নিম্নশ্রেণীর একজন ছাত্র জানতে পারে এবং সে এসে আমাকে বলে যে, কে আমাকে আক্রমণ করেছে সেই তথ্যটি তাকে দিতে হবে। এই ছাত্রটি মোঃ ইসহাক। এই ছাত্রটি আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল এবং সম্ভবত আমাকে শ্রদ্ধা করত। আমি তাকে আক্রমণকারীর নাম বললাম না, কোনমতে তার পরিচয়টি দিলাম। পরের দিন সে ঐ ছেলেকে ধরে নিয়ে আমার কাছে এলো এবং বলল আমার এই সহপাঠী কোন দিন তোমার জন্য কোন অসুবিধা সৃষ্টি করবে না। আমাকে বলতে হবে যে, পরবর্তীকালে শিক্ষাজীবনে এবং তার পরেও এই ছেলেটির সঙ্গে আমার একটি সুসম্পর্ক বজায় থাকে। সে আমাকে বেশ শ্রদ্ধা করত এবং তার অনেক বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই ছাত্রটি ছিল নদীর দক্ষিণ পারের অধিবাসী মোহাম্মদ তৈমুস। চলবে...
×