ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বরং মানুষই হব

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১২ অক্টোবর ২০১৫

বরং মানুষই হব

আমি বেড়ে উঠেছি গাঁও গ্রামে। দুরন্ত কৈশরের কত বেলা কেটেছে গাঁয়ের মেঠো পথে। দেখেছি কাঁচা সবুজে বেষ্টিত গ্রামের পর গ্রাম। গ্রামের ওপর ঝুলে থাকা ঘন নিলাভ আকাশ। যে আকাশে ছিল তুলার মতো দানা বাঁধা উরন্ত মেঘমালা। দেখেছি রাতের পর রাত। নহ্মত্র খচিত রাত। জোনাকি রাত। কত রাত মাখামাখি হয়ে থাকত জোছনা আর হাস্নাহেনায়। কতবার দেখেছি বর্ষা, আষাড়ে ভরা নদী, খাল, বিল। হেমন্তের শিশির, শীতের কুয়াশা, বসন্তের উদাস করা ফাগুন। জেগে উঠেছি আধো শিহরণে ডাহুক ডাকা মধ্যরাতে। এভাবে রূপে, রসে, গন্ধে জড়িয়েছি বাংলাকে। পাশাপাশি এই সুখ ও সৌন্দর্যের বাইরে যে জীবন দেখেছি, তা ছিল পীড়নের, দহনের। বৈষয়িক সামাজিক, পারিবারিক জীবন ছিল নানা জঞ্জালতায় পরিপূর্ণ। যেখানে দেখেছি সামাজিক ও ধার্মিক মানুষ। দেখেছি, সামাজিক ও ধার্মীয় মর্যাদা বঞ্চিত শুদ্ধ মানুষ, যারা ছিলেন প্রকৃতির মতো শুদ্ধ, উদার এবং তারা সামাজিক ও ধার্মিকদের কপটতা স্বার্থপরতা, অন্যায়, অন্যায্যতা দেখে দেখে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছেন ধর্মীয় বিধি বিধান ও সামাজিক প্রথা পদ্ধতি থেকে। বেছে নিয়েছেন বৈপ্লবিক শাশ্বত সত্যের চিরন্তন মানবিক জীবন। সরল সুষমাম-িত জীবন। কত সুধী-সাধুজন সুবিধা মতো নিজেদের তৈরি মনগড়া ধর্মীয় ও সামাজিক নীতিমালা করে হয়েছেন এক ঈশ্বরে বিশ্বসী আস্তিক। বিষয় সম্পত্তি যক্ষের ধনের মতো অগলে রাখেছেন ধর্মীয় আইনের দোহাই দিয়ে। মানুষে মানুষে, জীবনে জীবিকায়, ভোগে, বিলাসে করেছেন বিভাজন। বিত্ত-বেসাতে দেয়নি এক ইঞ্চি ছাড়। ধর্মীয় অজ্ঞতা, অন্ধত্ব আর দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা নিয়ে মানবিক গুণাবলী থেকে চেতনে অবচেতনে হয়েছেন উংকর্ষচ্যুত। এরা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখতেই সচেষ্ট এবং নিয়তি নিয়ন্ত্রিত জন্ম মৃত্যুর পরিসর ও বিধি বিধানের দুর্গের মধ্যে বসবাস করতে অভ্যস্ত। যে বিধি-বিধান তাদের মননে প্রবেশ পথ পায় না। অদৃশ্য শক্তির অভেদ্য দুর্গে মানুষে মানুষে, জাতে জন্মে, ধর্মে বর্ণে, চলে দ্বেষ-দ্বন্দ্ব-সঙ্কট-সংঘাত- দাঙ্গা-লড়াই- শোষণ-পীড়ন। আর এই জাত-ধর্ম-বর্ণ বিভাজনের কারণে স্বতন্ত্র চেতনা তাদের আদি ও আদিম প্রাণীর মতোই প্রতিহিংসাপরায়ণ অযৌক্তিক জীবনাদর্শের বলয়ে রেখে দিয়েছে। মানবিক মানে মুক্তির সন্ধ্যানে ব্যাপৃত সত্তা। যারা শ্রম সহিষ্ণু দিয়ে গড়ে তোলে ছোট ছোট নীড়, শোচনীয় সর্বনাশের মধ্যে খুঁজে সমৃদ্ধি, সরল সত্যের সুষমা দিয়ে কলুষিত অন্তঃবৃত্তে জ্বেলে দেয় আলোর দীপ। পতনের গভীরতর স্তর থেকে নির্বাক নীরবতার স্তব্ধ থেকে অধঃপতিতদের মনে আশার বীজ বপন করে। দিনময় আড্ডা দেয় নিজের সঙ্গে সোজা পথে, ডুবে যায় লাল-নীল দীপাবলী আর কতনদী সরোবরে। গলে যায় সুরের মূর্ছনায়। উজ্জীবিত হয় সফলদের স্বপ্ন গাঁথা নিয়ে। ধীরলয় চকিত কদম রাখে সারি সারি গাছের ফাঁকে। সুখী হয় ডাহুক ডাকা আধো সকাল আর ঝলমলে উজ্জ্বল দুপুর দেখে। পরন্ত বিকেলে আড়ি পেতে শুনে গোধূলির কথোপকথন। রঙিন খড়ির পেনসিলে আঁকা অনিপুণ হাতের শিল্প কলা, আর হেলেঞ্চা সুষণি শাকের দৃশ্যপটে খুঁজে পায় জীবনের তৃপ্ত ছোঁয়া। আর ধার্মিক ও সামাজিকদের গৎবাঁধা দায়বদ্ধতা থেকে উৎপত্তি অন্যায় অবিচার থেকে চায় মুক্তি। খুঁজে প্রকৃত শিক্ষার মাঝে সফলতার সম্ভাবনা। জীবদ্দশায় স্বাক্ষর রেখে চলার চেষ্টা করে সাম্যবাদের। মনন চর্চায় সফল যারা, তারা নির্বিঘেœ, নিভৃত্যে সর্বমানবিক জীবন যাপনের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বিশ্ব সমাজ সংসারে। বিশ্ব বরেণ্য চিত্র শিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রকর্মে বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক দিনমজুরের প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে। তিনি তার জীবদ্দশায় প্রাসাদ প্রাচুর্যের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেননি। মাটি আর মানুষের সঙ্গে একান্ত আপন হয়ে থেকেছেন। পপ সম্রাটখ্যাত আজম খান, চিরন্তন সাদামাটা মানুষটি ব্যক্তিগত ও বাহ্যিক জীবনে অতি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করে গেছেন। পার্থিব প্রলোভন-বিত্ত বৈভাব তার মানবিক সত্তাকে গ্রাস করতে পারেনি। সাহিত্য মনস্ক আরজ আলী মাতুব্বর, ক্ষুধা-দারিদ্র্যতা যাকে সাহিত্য চর্চা থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি। দারিদ্র্যতার কারণে একাডেমিক শিক্ষার সুযোগ তার হয়নি। আজ তার রচনাসমগ্র জাতীয় লাইব্রেরিতে অবস্থান করে নিয়েছে। তার সাহিত্য সাধনা ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিল প্রতিবাদ স্বরূপ। নিতাইগঞ্জের লোক শিল্পী আব্দুল করিম, যার স্বরচিত গানে, সুরে ও গায়কিওতে মেতে থাকতো গাঁও গ্রামের জনপদ। যিনি জন্ম থেকে মৃত্যু অব্দি এই বাংলার কাদা জলের সঙ্গেই মিশে ছিলেন। এরা ছিলেন আধুনিক সাম্যের অনন্য রূপকার। বিত্ত-বিলাসের সঙ্গে অভ্যস্ত না হয়ে সাম্যের রাজ্যে করেছিলেন রাজত্ব। মনের গভীরে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সসীম আর অসীমের সঙ্গে করেছিলেন বাস। বিজ্ঞতা, সাহস আর মিতাচারিতার সমন্বয়ে আদর্শের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন পৃথিবীতে। তাই ভাবি বরং মানুষই হব। আর ধার্মিক দেখে পণ করি ভয় নয়, ভালবাসা দিয়ে জয় করবে ঈশ্বরকে। সামাজিক দেখে আঁৎকে উঠি, ঐশ্বরিক বেদীতে শুধু পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে দায়সারা নয় ধর্মীয় -সামাজিকতার সকল দায়। দীপ্তি ইসলাম মডেল : লিরা
×