ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এফবিসিসিআই দেয়া সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী

দেশের ক্ষতি করতে কারা কী করছে তার সকল তথ্য আমাদের কাছে আছে

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

দেশের ক্ষতি করতে কারা কী করছে তার সকল তথ্য আমাদের কাছে আছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, দেশের ক্ষতি করতে কারা কী কী করছে সে ব্যাপারে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। দুই বিদেশী হত্যার সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের খুঁজে বের করে অবশ্যই বিচার করা হবে। আর যারা বিদেশে বসে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে, বিদেশীদের হত্যা করাচ্ছে সে যেই-ই হোক কোন ছাড় দেয়া হবে না। বাংলাদেশের মাটিতে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের স্থান হবে না। যারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং নেবে। আমরা নিরলসভাবে কষ্ট করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করব, আর কেউ তা ধ্বংস করবে- তা হতে দেব না। জড়িত কাউকে কোনরূপ ছাড় দেয়া হবে না। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই কর্তৃক তাঁকে দেয়া সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার যোগসাজশের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখনই বাধাবিঘœ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে চায়, বাংলার মানুষ যখনই মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, তখনই দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সময় আমাদের কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে পুরস্কৃত করছে, টিক তখনই বাংলাদেশে অবস্থানরত দু’জন বিদেশীকে হত্যা করা হলো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে অনেকেরই ভাল লাগে না। দেশে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পর এখন বিদেশে বসে বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীদের হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে যাচ্ছেন। আমরা সৃষ্টি করি, আর বিএনপি-জামায়াত জোট তা ধ্বংস করে। তিনি বলেন, এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা খুনীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসবই। তাদের আমরা ছেড়ে দেব, এটা যেন কেউ না ভাবে। বিদেশী হত্যা করে ভাবমূর্তি নষ্ট করবে তাদের ছেড়ে দেব তা হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশ ও জাতির ক্ষতি করে তাদের কী লাভ? আমরা দিনরাত পরিশ্রম করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছি, সেটাকে ছোট করতে হবে কেন? দেশ ও জাতির সঙ্গে এই শত্রুতা কেন? দেশ যখন উন্নত হয়, তখন অনেকেরই তা পছন্দ হয় না। সারাবিশ্বে বাংলাদেশ যখন প্রশংসিত হচ্ছে, তখনই নানা কর্মকা- ঘটিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি বলেন, তিন মাস নিজে দলীয় কার্যালয়ে স্বেচ্ছায় বসে থেকে ২৮২ দিন হরতাল-অবরোধের নামে জ্বালাও-পোড়াও ও নির্বিচারে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেও উনি (খালেদা জিয়া) ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেই হরতাল-অবরোধ উনি প্রত্যাহার করেননি। যদিও তিনি এর কার্যকারিতা ধরে রাখতে পারেননি। জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি বলেন, ঘরে বসে থেকে বিএনপি নেত্রী মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা করে, এক হাজার যানবাহন পুড়িয়ে দিয়ে, ট্রেন-লঞ্চ-বিদ্যুত কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পর ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেত্রী এখন বিদেশে বসে বাংলাদেশে থাকা বিদেশীদের হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাচ্ছেন। কিন্তু এসব করে কোন কিছু লাভ হবে না। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ এবং আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়ন কর্র্তৃক ‘আইসিটি টেকসই উন্নয়ন’ পুরস্কার অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রীকে এই সংবর্ধনা দেয় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ড্রাস্টিজ (এফবিসিসিআই)। জমকালো ও দৃষ্টিনন্দন এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংগঠনের আওতাভুক্ত সারাদেশের চেম্বার ও এ্যাসোসিয়েশনের ব্যবসায়িক নেতৃবন্দ যোগ দেন। ফুলেল শুভেচ্ছায় স্নাত করা ছাড়াও অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সকল ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ তুমুল কারতালির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর নিজ আসনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সবার অভিনন্দনের জবাব দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছায় স্নাত করেন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মানপত্র পাঠ করেন বিশিষ্ট নাট্যাভিনেত্রী শমি কায়সার। এরপর এফবিসিসিআই-এর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। এরপর ‘অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের বিভিন্ন সাফল্যে ও অর্জনগুলো নিয়ে নির্মিত একটি ভিডিও প্রদর্শনী উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সদ্য বিদায়ী এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান কমিটির প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন ও সহ-সভাপতি মাহবুব আলম। অনুষ্ঠানে সারাদেশ থেকে আগত ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্য এবং বেশ ক’জন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনা পর্ব শেষে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শিল্প কারখানা গড়ে তোলার সময় পরিবেশের দিকে বিশেষ নজর রাখার জন্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেখানে জায়গা পছন্দ হবে সেখানেই শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন, এটা কিন্তু ঠিক নয়। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগে কৃষি জমি ও জলাধার যাতে নষ্ট না হয়, পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। অপরিকল্পিত অনেক শিল্প কারখানা গড়ে তোলার ফলে তাদের বর্জে নদী দূর্ষণ হচ্ছে, পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আরও কোন কোন পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পারি গবেষণা করে তা বের করুন। এর মধ্য দিয়ে শিল্প উৎপাদন করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য দেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করতে হবে। দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এতে লাভবান কিন্তু ব্যবসায়ীরাই হবেন। তিনি বলেন, ভৌগোলিক পরিবেশ বিবেচনা করে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। বাজেটের আগের চেয়ে চার গুণ বৃদ্ধি করেছি। গ্রামীণ পর্যায়ে উন্নয়ন করছি। আয় বৈষম্য কমে এসেছে। ৫৭ থেকে কমে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ দারিদ্র্যের হার এখন। বৈদেশিক রিজার্ভ এখন অনেকে বেড়েছে। তিনি বলেন, বেসরকারী খাতে ব্যাপকভাবে উন্নত করে দিয়েছি আমরা। সব কিছুতেই বেসরকারী খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এতে বিস্তৃতিও বাড়ছে। তিনি বলেন, আমি ব্যবসা বুঝি না, ব্যবসাও করিও না। একটাই বুঝি দেশের মানুষের আয়-উন্নতি। প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগ হয়েছে, আগামীতে ৭ ভাগ করব আরও এগিয়ে যাব। এ সময় দেশে আরও বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়াতে ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের স্থান হবে না। বাংলাদেশে আমরা শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থা বিরাজমান রাখতে চাই, যেখানে দেশের নাগরিকরা নিরাপদে থাকবে। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই। এক্ষেত্রেও ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। “নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি/দেওয়ার কিছু নাই/আছে শুধু ভালবাসা/দিয়ে গেলাম তাই...” বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এই কবিতা আবৃত্তি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার নেয়ার কিছু নেই, আমি সব হারিয়েই এসেছি বাংলায়। শুধু বাংলার মানুষকে এগিয়ে নিতে, কিছু দিতে। শুধু একটা কথাই মনে রাখবেন- মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয়ী জাতি হিসেবে বাংলাদেশে মানুষ নিম্ন থাকবে না, উচ্চ হবেই। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দির উপযুক্ত করে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলবই। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ২০২১ সালের রূপকল্পে প্রতিস্থাপিত ও হালনাগাদ করেছেন। বাংলাদেশ আজ নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আগে দেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের খাদ্য সঙ্কট ছিল। এখন ১৬ কোটি জনগণের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বিদেশে খাদ্য রফতানি করছে। তিনি বলেন, যখন বাংলাদেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, সারাবিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে- ঠিক তখনই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে দুই বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হলো। তবে এসব ষড়যন্ত্র করে কোন লাভ হবে না। আন্তর্জাতিক দুটি সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ তাঁর স্বাগত বক্তৃতায় বলেন, এ অর্জনে আমরাও গর্বিত ও আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রীর সরকারের ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপের ফলে দেশে আজ বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
×