ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নভেরা আবিষ্কারে গতি

সন্ধান মিলল আরও এক ভাস্কর্যের, জাদুঘরে ঠাঁই

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

সন্ধান মিলল আরও এক ভাস্কর্যের, জাদুঘরে ঠাঁই

মোরসালিন মিজান ॥ নভেরা এই দেশে যেটুকু ছিলেন, না থাকার মতোই। খুব প্রতিকূল ষাটের দশকে আবির্ভাব ঘটে মহান এই শিল্পীর। আপন মনে ভাস্কর্য গড়ছিলেন। এর পর কী জানি কী হয়ে যাওয়ার বেদনা বিধুর গল্পটি। এ গল্পের অভিমানী চরিত্র নভেরা। হঠাৎ করেই হাত গুটিয়ে নেন। এমনকি স্বদেশ ছেড়ে যান। তবে অল্প সময়েও অনেক কাজ করে যান তিনি। শিল্পের প্রতি তাঁর অঙ্গিকার স্পষ্ট করেন। ভাস্কর্যের দিকে তাকিয়ে শিল্পীর নিবেদনটুকু অনুমান করা যায়। তবে এগুলো আজকের কথা। বিগত দিনে যথেষ্টই অযতœ হয়েছে ভাস্কর্যগুলোর। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ক্ষয় হয়েছে। মলিন হয়েছে। কিন্তু নিঃশেষ হয়নি। অনেকেরই জানা, ঠিক এই মুহূর্তে নতুন ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয়েছে নভেরার ভাস্কর্য। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। প্রশংসনীয় উদ্যোগটি জাতীয় জাদুঘরের। সরকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে দীর্ঘ ১৭ বছর পর নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে শুরু হয়েছে নভেরার ভাস্কর্যের বিশেষ প্রদর্শনী। শুধু বর্ণাঢ্য আয়োজন নয়, এর মাধ্যমে নভেরাকে আবিষ্কারের একটি তাগিদ দেয়া হয়। নভেরাকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হয়। না, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন বিসিআইসি’র কেউ সেদিন উপস্থিত ছিলেন না। মঙ্গলবার চেয়ারম্যানসহ বড় বড় কর্মকর্তারা এসে হাজির। নভেরার আরও একটি ভাস্কর্যের সন্ধান দিলেন তাঁরা। জাতীয় জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর করলেন। এর ফলে নভেরার আরও একটি ভাস্কর্য আবিষ্কারের ঘটনা ঘটল। আরও একটি কাজ সম্পর্কে জানার সুযোগ হলো। দিবসটি তাই বেশ আনন্দঘন হয়ে উঠেছিল। এ উপলক্ষে একটি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর কাছে বিসিআইসির ভাস্কর্যটি হস্তান্তর করেন বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল। উপস্থিত সকলে করতালির মাধ্যমে এই আদান প্রদানকে অভিনন্দিত করেন। ভাস্কর্যটি কোথায় ছিল? কী ভাবে সংরক্ষিত হয়েছে? কেন এর সম্পর্কে কেউ জানতেন না? আজ জাদুঘর অবধি চলে আসল, কোন্ প্রক্রিয়ায়? নানা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছিল মিলনায়তনের পুরোটাজুড়ে। উত্তর দেয়ার মূল ব্যক্তিটি ছিলেন বিসিআইসি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ভাস্কর্যটি বিসিআইসির দিলকুশা কার্যালয়ে ছিল। বহুকাল। আমার কক্ষের সামনেই স্থাপন করা হয়েছিল। প্রথমে চোখে সেভাবে পড়েনি। হঠাৎ একটি বিশেষ কারণে সেদিকে চোখে যায়। তখনই নামফলক দেখে জানা হয়, এটি পথিকৃৎ শিল্পী নভেরার কাজ! এটুকু বলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফিরে চান তিনি। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। লাইব্রেরীতে নিয়মিত আসা-যাওয়া। মনে পড়ে, আসা-যাওয়ার পথে আমি নভেরার ভাস্কর্য দেখেছি। হাসনাত আবদুল হাইয়ের ‘নভেরা’ বইটি পড়েছি। আর অতি সম্প্রতি পত্রিকায় পড়েছি নভেরার শেষ সময়ের সঙ্গী আনা ইসলামের একটি লেখা। এভাবে বক্তৃতায় নভেরাকে নিয়ে বিগত দিন ও আজকের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনার চেষ্টা করেন তিনি। এ-ও জানান, ভাস্কর্যের কোন অযতœ তিনি করেননি। বরং আগ্রহ নিয়ে দেখতেন। অতিথিদের কাছে নিয়ে দেখাতেন। তাহলে জাদুঘরে কেন দিয়ে দেয়া? এমন প্রশ্নটির খুব যৌক্তিক উত্তর দেন চেয়ারম্যান। বলেন, জাদুঘর বাঙালীর ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। নভেরা এখানে সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত হবে। হস্তান্তরটি সাময়িক সময়ের জন্য জানালেও তিনি বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দুই মন্ত্রীর সম্মতি ও উপস্থিতিতে ভবিষ্যতে এটি স্থায়ীভাবে জাদুঘরকে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেয়া হবে। ভাস্কর্যটি গ্রহণে জাতীয় জাদুঘরও বিশেষ আন্তরিক ছিল। তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালকের কণ্ঠে সে কথার কিছু উচ্চারিত হয়। তিনি বলেন, বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগেই জাদুঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরাও কাল বিলম্ব না করে ভাস্কর্যটি প্রদর্শনীর জন্য সংগ্রহে নেমে পড়ি। বিসিআইসির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, শিল্পকর্মের প্রতি সংস্থার চেয়ারম্যানের ভালবাসা আছে। জাদুঘরের প্রতি আস্থা রেখে ভাস্কর্যটি তিনি জাদুঘরে দিয়েছেন। চলমান প্রদর্শনীতে ভাস্কর্যটি প্রদর্শন করা হবে বলে জানান তিনি। অনুষ্ঠানে শিল্পীর দৃষ্টিকোণ থেকে নভেরাকে নিয়ে বলেন হাশেম খান। বরেণ্য শিল্পী বলেন, পাকিস্তান আমলে একটি বৈরী সময়ে কাজ করেছিলেন নভেরা। তখন ভাস্কর্যের আবেদন বা চর্চা অনেক বড় ঘটনা। ভাস্কর্য গড়ার মধ্য দিয়ে শিল্পী এক ধরনের বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। এবার ভাস্কর্যটির কথা। অনুষ্ঠান মঞ্চের এককোণে স্থাপন করা হয়েছিল ভাস্কর্যটি। এর সম্পর্কে একটু বলে নেয়া যাক। মিলনায়তনে প্রবেশ করেই সেদিকে ছুটছিলেন শিল্পীরা। নভেরা প্রেমী সাধারণ মানুষও দেখছিলেন কৌতূহল নিয়ে। ভাস্কর্যটি শিরোনামহীন। তবে গুত্রটি দেখে বোঝা যায়। শিল্পীর ‘সিটেট ওমেন’ সিরিজের কাজ। সিমেন্ট কংক্রিটে গড়া। বড়সরো গড়ন। বেইসসহ ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। সংশ্লিষ্টদের জানা, নভেরা উপবিষ্ট নারী ফর্মটাকে নানাভাবে গড়েছেন। ১৯৬০ সালের আগস্টে যে প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয় সেখানে তাঁর মোট ৭৫টি ভাস্কর্য স্থান পায়। কিন্তু ক্যাটালগে সব শিল্পকর্মের ছবি সংযুক্ত করা হয়নি। তবে এ পর্যায়ের একাধিক কাজ ছিল বলে জানা যায়। ভাস্কর্যটি ঠিক কবে গড়া? এই প্রশ্ন বার বার উঠেছে। উত্তরটা নিয়েও আছে রহস্য। নাম ফলকে লেখা রয়েছে ১৯৫৪-১৯৫৮। ১৯৫৪ সালে নভেরা বাংলাদেশে ছিলেন না। এর ফলে গবেষকরা ১৯৫৪ সালে ভাস্কর্যটি গড়া হয়েছে বলে মনে করছেন না। তাদের মতে, ভাস্কর্যটি গড়া ১৯৫৮ সালে গড়া হয়ে থাকতে পারে। নভেরার ওপর পিএইচডি করছেন তরুণ গবেষক সুমন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালের কথা উল্লেখের কারণ থাকতে পারে। হতে পারে, এ সময় থেকে ফর্মটি নিয়ে শিল্পী নীরিক্ষা শুরু করেছিলেন। তা হলে এই ভাস্কর্য নভেরা সম্পর্কে একটি নতুন তথ্য দিতে সক্ষম হয়েছে। বহুকাল পর একক প্রদর্শনী ও নতুন আরও একটি ভাস্কর্য জাদুঘরে আসার মধ্য দিয়ে নভেরা আবিষ্কারে গতি এসেছে- এ কথা বলাই যায়। আবিষ্কারের এই গতি অটুট থাকুক। আমাদের তাই প্রত্যাশা।
×