ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মধুশ্রী ভদ্র

গগনবিলাসী

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৫ অক্টোবর ২০১৫

গগনবিলাসী

কবিগুরু লিখেছেন : ‘মানুষের লোকালয় যদি কেবলই একান্ত মানবময় হয়ে ওঠে, এর ফাঁকে ফাঁকে যদি প্রকৃতি কোনমতে প্রবেশাধিকার না পায়, তাহলে চিন্তা ও কর্ম ক্রমশ কলুষিত ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতলস্পর্শ আবর্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে।’ চারপাশে আজ যখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করেও দেখতে পাই না খোলা নীল আকাশ, শুনতে পাই না বৃক্ষশাখে শত পাখির কলকাকলি, দেখতে পাই না সবুজের সমারোহ কিংবা সবুজকা-ে জড়িয়ে থাকা বুনোলতার পুষ্পের উজ্জ্বল প্রস্ফুটন; তখন মনে হয়, রবিঠাকুর কত যুগ আগে এই সত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন! প্রকৃতির সম্পদ আজ লুণ্ঠিত, হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের শিকড়! আমরা আজ ফ্ল্যাট-কালচারে নিমজ্জিত! আমরা আজ গগনবিলাসী উঁচু ভবনের বাসিন্দা! চারপাশে শুধু কংক্রিটের জঞ্জাল আর সারি সারি সুউচ্চ ইমারত, যেন ইট-পাথরের খাঁচা! ইট-পাথরের খাঁচায় সবুজ-প্রকৃতি আজ অবরুদ্ধ। নগরজীবনের যান্ত্রিকতা ও চাহিদার কারণে সবুজের চিত্রতল আর নেই, নেই সবুজ দৃশ্যপট, নেই প্রকৃতির সান্নিধ্য; আছে শুধু ‘ইটের পাঁজরে, লোহার খাঁচায় দারুণ মর্মব্যথা...।’ নগর সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করতে ভরাট হচ্ছে নদী, ভরাট হচ্ছে পুকুর-দীঘি, খাল-বিল-নালা। নেই খেলার মাঠ। নগরজীবনের ব্যস্ততার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যানজট ও জলজট। সময়ের বড়ই অভাব। ফ্ল্যাটবাড়ি কালচারে ভেঙ্গে পড়েছে যৌথ পরিবারের কাঠামোও। সুউচ্চ বহুতল ইটের ইমারতে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে অবস্থান করেও কয়েকটি পরিবার যেন একে অন্যের অপরিচিত, অচেনা। ফ্ল্যাটনির্ভর যান্ত্রিক জীবনে আমরা যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। চরম মূল্যবোধের অবক্ষয়ও দেখা যাচ্ছে ক্ষেত্রবিশেষে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটের কোনটিতে বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটলেও অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দা টের পান না; অনেক সময় টের পেলেও ঝামেলায় জড়াতে চান না। অনেক ফ্ল্যাটের ছাদে হাঁটাহাঁটি করারও কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। অর্থলোভী অনেক মালিক তার হাইরাইজ ভবনের ছাদে ‘মোবাইল টাওয়ার’ বসানোর অনুমতি দিয়েছেন (যা লোকালয়ে থাকা নিষিদ্ধ)। এই ক্ষতিকারক ‘মোবাইল টাওয়ার’ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ভঙ্ককর তেজস্ক্রিয় রশ্মি, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আর টাওয়ার না থাকলেও রক্ষা নেই; ছাদে আছে শত শত পাইপলাইন, যা টপকে হাঁটাহাঁটি করা আর ‘অবস্ট্যাকল রেস’ দেয়া একই কথার নামান্তর। এতে সমূহ বিপদেরও আশঙ্কা! আমাদের সরল নিষ্পাপ শিশুরা যেন ‘ফ্ল্যাট শিশু’! তাদের খেলার জন্য এক চিলতে খেলার মাঠ নেই। দিগন্তবিস্তৃত আকাশে চাঁদ ওঠা দেখার মনোরম দৃশ্য থেকেও ওরা বঞ্চিত। সন্ধ্যাকাশে বা রাতে সপ্তর্ষির খেলাও ওরা দেখতে পায় না; জানে না অরুন্ধতী, স্বাতী ও মৃগশিরা নক্ষত্রের কথা। তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সুকুমারবৃত্তি। আশপাশের পরিবেশ সম্পর্কেও তারা নির্লিপ্ত, উদাসীন। প্রকৃতির উদারতার কাছে শিক্ষা পায়নি যে তারা! স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে তিন-চার বছর বয়স থেকেই শিশুরা ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে কোচিং, পড়া ও বইয়ের চাপে পিষ্ট হতে থাকে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বইয়ের বোঝা টানতে টানতে পৃষ্ঠ বেঁকে যাওয়ার উপক্রম! বাড়ি ফিরে অর্থাৎ ফ্ল্যাটবাড়ির ইটের খাঁচায় প্রবেশ করে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা, গেম খেলা বা রিমোট হাতে টিভির চ্যানেল ঘোরানো। তার ফলে অধিকাংশ শিশু ‘ওবেসিটি রোগে’ আক্রান্ত কিংবা মেদবহুল শরীরের অধিকারী হওয়ায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্ত ইদানীং হয়েছে ফাস্টফুড ও ভেজাল খাবার। শিশুদের এই অবস্থার জন্য আমরা অভিভাবকরা অনেকাংশে দায়ী। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বৃক্ষহীন, সৌন্দর্যহীন পরিবেশ জীবনকে করেছে খ-িত। অনেক সাধের ঐতিহ্যবাহী বলধা গার্ডেনও আজ চারপাশে বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে হারাতে বসেছে তার নিজস্ব তরুরাজি ও সম্পদ; জমি হারাচ্ছে তার সঞ্জীবনী ক্ষমতা! বৃক্ষরাজি, তরুগুল্ম-লতাও আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে; কারণ আধুনিক নগরায়ন ও যান্ত্রিকতার চাপে নিরাপদ আশ্রয়ে যে থাকতে পারছে না। জানি, ইট-কাঠ-এ্যালুমিনিয়ামে নির্মিত বহুতল ভবনে বাগান করার সুযোগ কম। তবুও যাদের সুযোগ আছে, তারা একচিলতে বারান্দায়, ছাদে বা গৃহকোণে সবুজের আচ্ছাদন গড়ে তুলতে পারেন, যা আপনার মনে এনে দেবে অন্যরকম এক ভাল লাগা ও স্নিগ্ধ প্রশান্তি। আমার আছে এক চিলতে ছাদ বাগান। প্রত্যুষে উঠেই আমি বাগানে আসি। মুগ্ধ নয়নে দেখি জবা, টগর, বাগানবিলাস, রঙন, অর্কিড, পর্তুলাকা, রেইন লিলি ও সর্বজয়ার প্রস্ফুটনের উচ্ছ্বাস। সর্বজয়ার আরেক নাম কলাবতী। কিন্তু সর্বজয়া নামটি আমার প্রিয়; সেই ছোটবেলা থেকে, যবে আমি ‘পথের পাঁচালী’ পড়েছি। অপু-দুর্গার মা সর্বজয়ার জীবন-সংগ্রাম আর দুটি ভাই-বোনের সারাদিনমান প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করা; রেললাইন ধরে কাশবনে ছুটে চলাÑ এসবই ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যকে মনে করিয়ে দেয়। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য আমরা কি পারি না আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নান্দনিক প্রকৃতি উপহার দিতে? আবারও কবিগুরুকে দিয়ে শেষ করিÑ ‘প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, চাই বল, চাই স্বাস্থ্য আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু।’ মিরপুর, ঢাকা থেকে
×