ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কংক্রিটের এ জঙ্গলে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৫ অক্টোবর ২০১৫

কংক্রিটের এ জঙ্গলে

কবিগুরু প্রায় শত বছর আগেই বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লহ এ নগর’। তখন নগরীগুলো ছিল অনেক প্রকৃতিসমৃদ্ধ, তারপরেও নগরজীবনের সমস্যা, মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখেই হয়ত তিনি এ কথা বলেছিলেন। ভেবে আশ্চর্য হই, আজ ঢাকার মতো প্রকৃতিহারা নগরীগুলোর দুরবস্থা দেখে তিনি কী বলতেন! আমরা জানি, নগরায়ন হচ্ছে একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম সূচক। মানুষ উন্নত জীবনযাপন, বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা ও কর্মসংস্থানের আশায় ক্রমেই শহরমুখী হচ্ছে। ১৪.৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার ঢাকায় জনসংখ্যা প্রতিবছর প্রায় ১০% হারে বাড়ছে। এ জন্য প্রতিবছর বিদ্যমান আবাসনের অতিরিক্ত প্রায় ১ লাখ ফ্ল্যাট তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আশির দশক থেকে শুরু হওয়া ক্রমবর্ধমান ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দারা বাস্তবে কতটুকু সুখে আছে সেটাই বড় প্রশ্ন। সর্বত্র অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটভবনগুলোর বাসিন্দাদের জীবনযাপন ও নগরীর বিরাজমান সমস্যাগুলো দেখলেই তা আঁচ করা যায়। মানুষের মনোদৈহিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য যে আবাসন-পরিবেশ ও ব্যবস্থা দরকার তা অনেকাংশেই এখানে অনুপস্থিত। সারিসারি সুরম্য অট্টালিকার পাশে সরকারী রাস্তা ছাড়া প্রয়োজনীয় খোলা জায়গা নেই, নেই গাছ-গাছালি তরু-লতা, পৌঁছোয় না পর্যাপ্ত সূর্যের আলো, বিদ্যুত চলে গেলে বিরাজ করে ঘুটঘুটে অন্ধকার, প্রাকৃতিক বাতাসের প্রবাহ এখানে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত। শীতের দিনেও এসব ফ্ল্যাটবাড়িতে একটু শীতল পরশের জন্য চালিয়ে রাখতে হয় ফ্যান বা এসি। কংক্রিটের এ জঙ্গলের বাসিন্দাদের প্রাণ প্রায়শ কেঁদে উঠে একটু সবুজ, খোলা হাওয়া, খোলা আকাশ, বৃষ্টি বা রোদের জন্য। এ যেন শুধু পাখির খাঁচা নয়,এ যেন আবদ্ধ সিন্দুক। কর্মব্যন্ত নাগরিক জীবনে বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট প্যাসেজ বা করিডর বা লিফট দিয়ে শুধুই কাজের উদ্দেশে বের হয় আর ফিরে আসে, অনেকের সঙ্গে হয়তো হয় শুধু চোখাচোখি দেখাদেখি, আন্তরিকতা আর পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার সময়-সুযোগ আর ক্ষেত্র কোথায় ? যা মানুষের মনো-দৈহিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। এখানে অধিকাংশ ফ্ল্যাটবাড়িকেন্দ্রিক নেই বিনোদন ও কমিউনিটি সেন্টার, প্রেয়ার-রুম, লাইব্রেরি, খেলাধুলা বা ব্যায়ামাগার, পার্ক এবং শিশু-বিনোদন ক্ষেত্র। ফলে এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে বিভিন্ন মনো-দৈহিক রোগ ও সমস্যা। অধিকাংশ একক পরিবারগুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়ে পড়ছে আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও সংকীর্ণমনা। সামাজিকতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার পথ এখানে রুদ্ধপ্রায়। বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি নির্মাণের কারণে স্বাভাবিক আবাসনের চেয়ে বিশগুণ বেশি মানুষ বসবাস করছে সমপরিমাণ জায়গায়, কিন্তু সে পরিমাণ মানুষের প্রয়োজনীয় ভৌত ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা অনুপস্থিত। ফলে পানি, গ্যাস, বিদ্যুত, পয়ঃনিষ্কাশন, যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ ও জলাবদ্ধতা সমস্যা দানা বেঁধেছে। অথচ, উন্নত নগরী টোকিও ও হংকং-এর জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকার চেয়েও বেশি। উন্নয়নের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হয়ে পড়ছে দ্বান্দ্বিক, উন্নয়ন বাড়ছে কিন্তু অচল হয়ে পড়ছে কাক্সিক্ষত নগরজীবন। কিন্তু আশাকরি, বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণশীল সর্বাধুনিক নগর সভ্যতায় কবিকে আর যেন আক্ষেপ করে বলতে না হয়, “ইটের পর ইট, মাঝে মানুষ কীট; নেইকো ভালবাসা, নেইকো মায়া”। দুর্গাপুর, নেত্রকোনা থেকে
×