ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেলের জমি নদীর পার

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

রেলের জমি নদীর পার

যেখানে দেখিবে যা, দখল করিবে তা এই নীতিতে আচ্ছন্ন যারা, তারা যা পায়, তাই কুড়ায় কিংবা মালিক বনে যায়। যুগের পর যুগ ধরে চলছে এমনই দখল-বেদখলের অনিয়ন্ত্রিত খেলা। মগের মুল্লুকের যুগ না থাকলেও মুল্লুকজুড়ে তাল্লুক বানিয়ে বেশ বহাল তবিয়তে আছেন তাঁরা, যাদের দখলে নদীর তীর শুধু নয়, পুরো নদী, রেলের জমিজমাও। দখল করার মধ্যে সম্ভবত এক ধরনের সুখ এবং সমৃদ্ধি তো কাজ করতেই পারে। কিন্তু গণমানুষের অতীত বর্তমান ভবিষ্যতকে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলা হচ্ছে, সে নিয়ে ভাবার সামান্য আগ্রহ মেলে না। বরং আরও কত জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা দখলীভূত করা যায়, আরও কত বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী জায়গা জমি কবলে রাখা যায় তার নানা কৌশল প্রয়োগ করার মানসে কত কিসিমের তৎপরতা যে চলছে বছরের পর বছর, তা হিসাব করাও দুরূহ। এই যে নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলে বাঙালীর কত গৌরব, অহঙ্কার আর ভাববিলাস তা ধরে রাখা আর যাচ্ছে না। প্রমত্তা নদীগুলো দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র, বিশাল বিশাল ইমারত। আবার এই নদীগুলোর যা আছে অবশিষ্টাংশ, তাতে বর্জ্য ফেলে নদীকে দূষিত করে ফেলা হচ্ছে। শুধু নদী নয়, খাল-বিলও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে আর তাতে ঠাঁই নিচ্ছে নানান ধাঁচের স্থাপনা। মৃতপ্রায় কমবেশি পাঁচ শ’ নদীকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ দূরঅস্ত। যদিও বর্তমান আইনে নদী, জলাশয়ে স্থাপনা থাকার কথা নয়, কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় পুরনো স্থাপনা উচ্ছেদ দূরে থাক নতুন করে দখলের প্রচেষ্টা বন্ধেও নেই উদ্যোগ। বিধান না থাকলেও দেখা যাচ্ছে, নদীর অংশ সরকারীভাবে ইজারা দেয়া হচ্ছে। অবৈধ কাগজপত্র দিয়ে মামলা ঠুকে সরকারী উচ্ছেদ অভিযানকে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। আবার নদী শুকিয়ে গেলে বা মরে গেলে দু’কূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ব্যাহত হয় চাষাবাদ। মরে যায় বৃক্ষরাজি, অর্থাৎ দেখা দেয় পরিবেশ বিপর্যয়। খোদ রাজধানী ঢাকায় সড়ক ডুবে যায়; ঘরবাড়িও, একটু উপচেপড়া বৃষ্টিতে। নদী যদি হয় শিরা, তবে খাল-বিল হচ্ছে তার ধমনী। খাল ভরাট করে দোকানপাট, ঘরবাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনাও নির্মাণ করা হয়েছে, যা বর্ষাকালে দুর্ভোগ বাড়ায়। এসব খাল দিয়ে এক সময় যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌকাও চলাচল করত। বাংলাদেশের বহু ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র এই খালগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। এসব খাল আজ আর নেই। জলাভূমি ভরাট থাকায় পানি ধারণের মতো সামান্য জলাধারের অস্তিত্বও রাখা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেও খাল-বিল পুকুর ভরাট কিংবা মুক্ত প্রান্তরে স্থাপনা নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন ভঙ্গে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও দখল উচ্ছেদ আর সম্ভব হচ্ছে না। খোদ অনেক সরকারী সংস্থাও মানছে না জলাধার আইনের নিষেধাজ্ঞা। এমকি দফায় দফায় মামলা করেও জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। নদীর পাশাপাশি চলছে রেলওয়ের বিপুল পরিমাণ জমি দখল এবং তা দীর্ঘদিন ধরেই। রাজনৈতিক প্রভাব, সংশ্লিষ্ট মহলের অবহেলা ও দুর্নীতির কারণেই এসব হচ্ছে। বর্তমানে রেলের ৪ হাজার ৬৩৫ দশমিক ৫৬ একর জমি রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের দখলে। আর বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানের দখলে রয়েছে ১ হাজার ২৫৪ দশমিক ৯৫ একর জমি। এ পরিস্থিতিতে রেলের জমি উদ্ধারে শত শত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তদুপরি রেল তার উদ্ধার করা জমিতে প্রকল্প স্থাপন করতে যাচ্ছে। কিন্তু রেল ব্যবস্থার কোন উন্নয়ন করতে না পারা মন্ত্রণালয়, জমি নিয়ে যত ভাবছে তত রেল সার্ভিস নিয়ে নয়। রেলের জমি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না, পাশাপাশি রেল চলাচলের উন্নয়নের কাজটাও করতে পারছে না। নদীর গতি রুদ্ধ। রেলের কুঝিক ঝিকও স্তব্ধÑ এই দশা থেকে কে উদ্ধার করবে, কেউ জানে না। লৌকিকভাবে যদি না হয়, অলৌকিকভাবে যে হবে, তার নিশ্চয়তাও নেই। টাস্কফোর্স গঠন করে যখন লাভ হচ্ছে না, তখন বিকল্প পন্থা নেয়া বাঞ্ছনীয়।
×