ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাঈম সিনহা

দুনিয়া কাঁপানো রাজনৈতিক স্লোগান

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

দুনিয়া কাঁপানো রাজনৈতিক স্লোগান

জয় বাংলা ‘জয় বাংলা’! পৃথিবী কাঁপানো এক সেøাগান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জয়ধ্বনি ‘জয় বাংলা’র সেøাগানের শক্তিতেই বলীয়ান হয়ে বাঙালী জাতি দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য সংবলিত নতুন এক মানচিত্র। ‘জয় বাংলা’ সেøাগানের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি মানচিত্র, একটি লাল-সবুজ পতাকা, একটি জাতীয় সঙ্গীত, একটি স্বাধীন দেশ অর্থাৎ ‘জয় বাংলা’ আমাদের আত্মপরিচয়, জাতীয় ঐক্যের প্রতীক- মোট কথা বাংলাদেশের পরিচয়ই হলো ‘জয় বাংলা’। স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ফরাসী বিপ্লবের দুই মহান দার্শনিক রুশো এবং ভলতেয়ারের ‘স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব’ এই সেøাগানটি আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। বুর্জোয়া বিপ্লবের এই সেøাগানটি বিশ্বজুড়ে এখনও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব্যবহার করছে। কখনও নির্বাচনে জয়ী হতে কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে এই সেøাগানটির কখনও চাহিদার কমতি হয়নি। ধনীদের খাও ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা দার্শনিক রুশো ধনী ও গরিবের বৈষম্যের বিরোধিতা করে একটি বিখ্যাত সেøাগানের প্রবর্তন করেন। সেøাগানটি হলো, ‘ইট দ্য রিচ’, যার ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘ধনীদের খাও।’ পুঁজিবাদী সমাজে ধনীরা গরিবের সম্পদ আত্মসাত করে আরও ধনী হতে থাকে। রুশো এই প্রথার বিলুপ্তির জন্যই তার এই জনপ্রিয় সেøাগানটি প্রবর্তন করেন। ব্রেড এ্যান্ড রোজেস একটা সময় শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রায়ই তাদের বেতন-ভাতা, খাবার, বাসস্থান এ রকম মৌলিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনেই ব্যস্ত থাকত। কিন্তু এর বাইরেও যে মানুষ হিসেবে তাদের আরও সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে, শ্রমিকদের মধ্যে সেই সচেতনতা তৈরির প্রয়োজন দেখা দেয়। বেতন-ভাতাই শুধু নয়, তাদের যে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও ভোগ বিলাসিতারও অধিকার আছে, তা বোঝানো হয়। তাই সেই সময় ‘ব্রেড এ্যান্ড রোজেস’ সেøাগানটির প্রচলন করা হয়। ‘ব্রেড’ দিয়ে মৌলিক অধিকার এবং ‘রোজ’ দিয়ে বিলাসী সুবিধাগুলোকে বোঝানো হয়। লালের চেয়ে লাশই ভাল ‘ডেড ইজ বেটার দেন রেড’ বাংলায় এর ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘লালের চেয়ে লাশই ভাল’। এই সেøাগানের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সদস্য জোসেফ ম্যাকাথি। তিনি ছিলেন চরম কমিউনিস্টবিরোধী। রাশিয়ায় লেলিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা দখলের পর সারাবিশ্ব তখন কমিউনিজমের ভূত দেখেছে। তখন তিনি একটি এ্যান্টি-কমিউনিস্ট সেøাগানকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তৎকালীন পুঁজিবাদী দেশগুলো তাকে এ ব্যাপারে ব্যাপক সমর্থন দেয়। প্রকৃত গণতন্ত্র এখনই! সরকারের ব্যয় সঙ্কোচন নীতির প্রতিবাদে ও আমূল সংস্কারের দাবিতে স্পেনের সামাজিক আন্দোলনে সেøাগান গর্জে উঠেছিল ‘দেমোক্রাসিয়া রিয়াল ইয়া।’ সেই সেøাগানটির ভাষান্তর করলে দাঁড়ায় ‘প্রকৃত গণতন্ত্র এখনই!’ ২০১১ সালের সেই আন্দোলন বিশ্ববাসীর কাছে ১৫ মে আন্দোলন নামেই বেশি পরিচিত। এক জাতি, এক দেশ, এক শাসক বিশ্ববাসীর কাছে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবেই পরিচিত এ্যাডলফ হিটলার। তবে ‘ফ্যাসিজম’-এর সংজ্ঞাই বলে দেয় জনগণের ওপর ভিত্তি করেই এটি আধিপত্য কায়েম করে। হিটলারের সেই আধিপত্য কায়েমের যুগে ‘নাৎসিদের’ সবচেয়ে জনপ্রিয় সেøাগান ছিল, ‘আন ভলক, আন রাইস, আন ফুয়েগো’। জার্মান ভাষা থেকে এর ভাষান্তর করলে দাঁড়ায় ‘এক জাতি, এক দেশ, এক শাসক।’ জয় জাওয়ান, জয় কৃষাণ স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ক্ষমতায় থাকার সময় একটি জনপ্রিয় সেøাগানের প্রবর্তন করেন। ১৯৬৫ সালে প্রবর্তিত সেøাগানটি হলোÑ ‘জয় জাওয়ান (সৈনিক), জয় কৃষাণ (কৃষক)।’ সেøাগানটিতে সৈনিক ও কৃষক এই দুটি শ্রেণীর বন্দনা করা হয় এবং এটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীতে এই নামে একটি সিনেমাও মুক্তি পায়। সব ক্ষমতা কল্পনার রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের সেøাগান ছিল ‘অল পাওয়ার টু দ্য সোভিয়েত’ অর্থ ‘সব ক্ষমতা সোভিয়েতের।’ আর সেই সেøাগানকে ব্যঙ্গ করে শিল্পীদের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী প্রবণতার বিরোধিতা করে ‘দ্য সিচুয়েসনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ এর গায় ডিবোরট আরেকটি সেøাগানের প্রচলন করেন। সেই সেøাগানটি হলো ‘অল পাওয়ার টু দ্য ইমাজিনেশন’ অর্থাৎ ‘সব ক্ষমতা কল্পনার।’ তারা সুররিয়ালিজম (পরাবাস্তববাদ) দ্বারা প্রভাবিত এবং একইসঙ্গে বলশেভিক ও স্বৈরাচারীবিরোধী ছিলেন। তারা শিল্পীদের মুক্ত চিন্তাকে সবার ওপরে অবস্থান দেয়ার পক্ষে ছিলেন। শাভেজের জয়, পিতৃভূমির জয় ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর দেশটির রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। সেই সময় শাভেজপন্থীরা সেই বিভ্রান্তি দূর করতে ‘শাভেজ বিবে, লা পাত্রিয়া সিগে’ অর্থাৎ ‘শাভেজের জয়, পিতৃভূমির জয়’ এই সেøাগানটি প্রচার দিতে থাকে। অনেকেই ধারণা করেছিল শাভেজের মৃত্যুর পর পরই দেশটিতে বাম শাসনামলের অবসান ঘটবে। এই সেøাগান সেই সময় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। লাঙল যাদের, জমিও তাদের চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নেতা ‘চেয়ারম্যান মাও’ এর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ’৭০-এর দশকে ভারতে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূচনা হয়। মূলত তরুণ ছাত্রদের পরিচালিত সেই কৃষক আন্দোলনের একটি জনপ্রিয় সেøাগান ছিল- ‘লাঙল যাদের, জমিও তাদের’। অর্থাৎ খোদ কৃষকের হাতে জমির মালিকানা তুলে দেয়ার দাবি। সে সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্ধ্র প্রদেশে মাওবাদীরা স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে জমির মালিকানা ছিনিয়ে নিতে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এটি ছিল তাদের অন্যতম ট্রেড মার্ক সেøাগান।
×