ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরার কড়া নির্দেশ

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৭ অক্টোবর ২০১৫

সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফেরার কড়া নির্দেশ

কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। চায়ে মুড়ি মিশিয়ে খাওয়া। গোয়ালে গরুর দুধ দোহনে সঙ্গ দেয়া। হাইলা-কামলার কাজ। আবার তাদের সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করতে যাওয়া। পেট পুরে পান্তা খাওয়া। উদোম গায়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালে কিংবা সংলগ্ন নদীতে ডুবানো। বাবা-মায়ের বকুনি- ধোলাই খাওয়ার পর ক্ষান্ত দেয়া। ধরে এনে পরিষ্কার পানি দিয়ে গা-গতর কচলে সাবান মেখে মায়ের হাতে ফের গোসল করানো। তারপরে সরষের তেল মেখে প্যান্ট পরিয়ে দেয়া হতো। দিনভর মাঠে নিজের গরু চড়ানো। ঢ্যাং খেলা, মার্বেল খেলা। বিকেলে ফুটবল, হা-ডু-ডু খেলা উপভোগ করা। এসবের সঙ্গে নিত্যদিন মাছ ধরা ছিল রেওয়াজ। খাল-বিল পেরিয়ে কিংবা এক বৈঠার নৌকায় চড়ে বাবার সঙ্গে হাট-বাজারে যাওয়া ছিল জীবনে পাওয়ার বড় প্রত্যাশা। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরের হাট-বাজারে যেতে পারাই ছিল কাক্সিক্ষত স্বপ্ন পূরণ। এসব ছিল ছেলে-মেয়ের কৈশোর জীবন। স্কুলে যেতে খালি পায়ে, হাতে বই। হাঁটু সমান কাদা পেরিয়ে চলতে হতো। শৈশব পার না হতেই ১৩ কি ১৪ বছর বয়সে বিয়ের আসরে বসে ঘাড়ে তুলে দেয়া হয়েছে সংসারের বোঝা। এর বাইরে কিছু ভাবনায় আনা ছিল অবান্তর। দখিনের সাগরপারের জনপদ উপকূলীয় কলাপাড়ার জনপদে ষাট থেকে সত্তর দশকের শৈশব ছিল এমনটাই। ছিল সীমাহীন খালি জনপদ। খাল-বিল, জঙ্গলে ঘেরা। বিল আর জলাভূমিতে ছিল পরিপূর্ণ। যোগাযোগ ছিল নৌকা কিংবা পায়ে হেঁটে। গামছা গায়ে জড়িয়ে চলাফেরাই ছিল গ্রামের চলন। এদেরই একজন সোনা মিয়া। জীবনের শেষ বেলায় তার জীবনতরী ভিড়েছে গঙ্গামতির নতুনপাড়ায় বেড়িবাঁধের ঢালে। একটু খানি ঝুপড়িঘরে বসবাস একযুগ। ওই ঘরেই তার ছোট্ট দোকান। শৈশব-কৈশোর-যৌবন সবই কেটেছে নৌকায়। নৌকা বাইতেন। এঘাট থেকে ওঘাট যেতেন। মুক্তিযুদ্ধে ছিল মানুষটির সাহসী অবদান। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র টেনেছেন। শৈশব বলতে গোষ্ঠীর সবাই একসঙ্গে বসবাসের সুখস্মৃতি এখনও হৃদয়ে নাড়া দেয়। তার ভাষায়, ‘এহন তো শিশুকাল নাই। সবাই ভাল থাকতে চায়। ল্যাদা-গ্যাদা সকলের ধান্ধা টাহা কামানো। আর খেলাধুলা তো দূরের কথা কাম লইয়া সবাই ব্যস্ত। কি ছোডকাল, আর কি বড়কাল। কেউ তার নিজের পোলাপান শাসন করে না।’ তার দাবি সুস্থ জীবন গড়তে তাদের শৈশব ছিল শতভাগ ঠিকঠাক। বাগেরহাট জেলার এ মানুষটির এখন ঠিকানা গঙ্গামতি। আফসোস মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়ার সঙ্গে কাজ করেও স্বীকৃতি মেলেনি। এখন জীবন-জীবিকা মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রবীণ মানুষটির। পশুর বুনিয়া গ্রামের চল্লিশোর্ধ পাঁচ সন্তানের জননী রাজিয়া বেগম জানালেন, শৈশব থেকেই তাদের ওপর বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর। তারপরও সুযোগ পেলেই খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে মাঠে গিয়ে সমসাময়িক বয়সীদের সঙ্গে ছি-ছি খেলা। এক্কা-দোক্কা খেলা। খালে ডুব দেয়া। তবে এসব ছাড়াও মায়ের সঙ্গে সন্ধ্যায় হ্যারিকেন জ¦ালানোর জন্য চিমনি পরিষ্কার করতেন। মায়ের সঙ্গে ঢেঁকিতে পার দিতেন। আর শৈশব পার না হতেই কৈশোরে বিয়ে-সংসারের বোঝা তুলে দেয়া হয়। শৈশব বোঝে না আশি বছর বয়সের মুনসুর আলী। চাকামইয়ায় বাড়ি। তবে এটুকুই বললেন, ‘ওই সময়ডা ল্যাংডা কাডাইছি। তয় খাইছি ইচ্ছামতো। বাব-মা, চাচা-চাচি হগলে একলগে থাকতাম।’ এই সুখ এখন আর কোন সংসারেই নেই। Ñমেজবাহউদ্দিন মাননু কলাপাড়া থেকে
×