ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘হেই দিনগুলাই ভালো আছিল ॥ তয় একটা দুঃখ আছে’

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৭ অক্টোবর ২০১৫

‘হেই দিনগুলাই ভালো  আছিল ॥ তয় একটা দুঃখ আছে’

আবদুর রহমান ও জয়নাল গাজী। আবাল্য বন্ধু। বয়স আশির কাছাকাছি। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরকাশেম গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি। আবদুর রহমান বলেন, ‘লেখাপড়ার বালাই ছিল না। আর চাইলেও স্কুলে যেতে পারতাম না। আশপাশের দশ গাঁয়ে ছিল না স্কুল। যেতে হতো নদী পাড়ি দিয়ে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরে। বাবা-মায়ের কাছে যা ছিল আতঙ্কের। তাই কোনদিন স্কুলের বই-খাতা হাতে নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ হয়নি। অবশ্য এনিয়ে দুঃখবোধ থাকলেও কিছু করার নেই। জীবনটাতো এভাবে কেটেই গেল।’ তিনি বলেন, ‘খুব ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস সেই শিশুকাল থেকে। বাড়ির গরু-মোষের পাল নিয়ে যেতাম মাঠে। জয়নাল গাজী বলেন, সেই দিনগুলো যে কতটা আনন্দের ছিল, তা বলে বোঝানো যায় না। পেটভরা পান্তা খেয়েই দল বেঁধে ছুটে যেতাম ছোট ছোট খালে। দু’জনে গামছা বেঁধে ধরতাম পুটি-মলেন্দা-খলসে মাছ। বাড়ি ফিরতাম দুপুরের আগে। বাড়িতে মাছ রেখে ছুট দিতাম গরু- মোষের কাছে। এক নজর দেখে গাঁয়ের সমবয়সীদের নিয়ে ন্যাংটো হয়ে ডুব সাঁতারে মেতে উঠতাম নদী, খাল কিংবা পুকুরে। খেলতাম চোর-পুলিশ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত পানিতে। কিন্তু একদিনের জন্য জ্বর কিংবা সর্দি-কাশি হয়নি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতে সমান ডুব সাঁতার দিতাম। বাড়ি ফিরতাম ভর দুপুরে। মাছ মাংসের অভাব ছিল না। ছিল মোষের দুধ, খেজুর রসের গুড়। পেট ভরে খেয়েই আবার খোলা মাঠে। আজকের মতো সে সময়ে ফুটবল-ক্রিকেট ছিল না। আমাদের খেলা বলতে ছিল হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট। মেয়েরা আসত না। আমরা ছেলেরাই খেলতাম।’ তিনি বলেন, ‘টিভি-রেডিও ছিল না। বিনোদন বলতে ছিল দূর গাঁয়ে, বাবা-নানার হাত ধরে হাটে গিয়ে জিলাপি-আমৃতি আর মুড়ির মোয়া খাওয়া। সঙ্গে দু’-একটা বেলুন কেনা ছিল বাড়তি পাওনা। আর ছিল এগাঁয়ে-ওগাঁয়ে রাতে যাত্রা আর পুঁথিপাঠের আসর। সে সময়ে ছেলেরাই মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছে। তিনি আরও বলেন, ‘আসলে হেই দিনগুলাই ভালো আছিল। এ্যাহনের মতো চুরি-চামারি, মাইরধোর, নেশা কিছুই আছেলো না। বিয়া করছি ছোড বেলায়। এ্যাহোনো হ্যারে লইয়া আছি। তয় একটা দুঃখ আছে। লেহাপড়া হিখতে পারি নাই। কেউ দস্তখত চাইলে বুইড়া আঙ্গুল বাইর কইরা দেই, হেই দুঃখ লইয়া কবরে যাইতে হইবে।’ আবদুর রহমান আর জয়নাল গাজীর মতো সাত-আট দশক পেরিয়ে এখনও অসংখ্য মানুষ রয়েছেন। Ñশংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×