ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ॥ ওয়াসার অস্বীকার

গুলশান-বারিধারা লেক দূষণ রোধের নামে ৫০ কোটি টাকা গচ্চা

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৫

গুলশান-বারিধারা লেক দূষণ রোধের নামে ৫০ কোটি টাকা গচ্চা

নাজনীন আখতার ॥ গুলশান-বারিধারা লেক দূষণ রোধে ওয়াসার প্রকল্পের নামে সরকারের ৫০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে উল্লেখ করে সংসদীয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। লেকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ড্রেনেজ পয়েন্ট প্রকল্পের আওতাভুক্ত না করায় খামাখা শুধু অর্থই অপচয় হয়েছে। দুর্গন্ধ ও দূষণ রোধে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে ওয়াসার পক্ষ থেকে ওই প্রতিবেদনের জবাবে টাকা অপচয় হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সফল বলে দাবি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, গুলশান-বারিধারা লেকের ছোট-বড় বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে প্রতিদিন সরাসরি পয়ঃবর্জ্য মিশছে গুলশান লেকে। বারিধারা ডিওএইচএস, কালাচাঁদপুর, বনানী ১১৮ নং রোড, ন্যাম ভিলার দক্ষিণে বনানী ২ নং রোড, মহাখালী-গুলশান লিঙ্ক রোড, গুলশান-বাড্ডা লিঙ্ক রোড, বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের নিচ এবং কড়াইল লেকসংলগ্ন বস্তি এলাকায় অনেক নালার মাধ্যমে মানুষের মলমূত্রসহ বিভিন্ন আবর্জনা মিশছে লেকের পানিতে। কড়াইল বস্তি এলাকায় অনেক টয়লেটেরও সরাসরি সংযোগ রয়েছে লেকের সঙ্গে। জানা গেছে, ‘পলিউশন কন্ট্রোল মেজারস অব গুলশান-বারিধারা লেক বাই ডাইভার্টিং দ্য ড্রেনেজ আউটলেটস’ শীর্ষক প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৪৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের ৪৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব তহবিল ৫ কোটি টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদকাল ছিল ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত। তবে প্রকল্পের কাজটি শেষ করা হয় ২০১৪ সালের জুন মাসে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মহাপরিচালক ও প্রকল্প দফতরের প্রকৌশলীরা লেকটি ২০১৪ সালের ১৭ নবেম্বর পরিদর্শন করেন। ওই সময় প্রকল্প সমাপ্ত প্রতিবেদন আইএমইডিকে দেয়া হয়। তবে যেসব সংযোগ পয়েন্ট থেকে মানুষের মলমূত্রসহ বিভিন্ন আবর্জনা লেকের পানিতে এসে পড়ে সেসব সংযোগ বন্ধ করতে না পারায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরও লেকের দূষণ ও দুর্গন্ধ বহাল রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে ওয়াসার আইডব্লিউএস প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আখতারুজ্জামান একাধিকবার সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ওয়াসা যতগুলো সংযোগ পেয়েছে সব বন্ধ করেছে। এখন নতুন করে সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। এত বড় লেক, এত কম টাকায় পয়ঃবর্জ্য সংযোগ বন্ধ সন্তোষজনক নয়। তাছাড়া আশপাশের বাসিন্দারা নতুন নতুন পয়ঃবর্জ্য নালা সৃষ্টি করলে সেসব দায়ভার ওয়াসার ওপর আসবে কেন? বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অশোক মাধব রায়কে তা তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। সংসদীয় কমিটির কাছে দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গুলশান-বারিধারা লেকে পতিত যতগুলো ড্রেনেজ আউটলেট পয়েন্ট ডাইভার্ট করার প্রয়োজন ছিল সবটিতেই প্রকল্পভুক্ত করা হয়নি। বনানী লেকে পতিত বারিধারা ডিওএইচএস, বনানী ১১৮ নং রোড, ন্যাম ভিলার দক্ষিণে বনানী ২ নং রোড, মহাখালী-গুলশান লিংক রোড, বনানী ১১ নং ব্রিজের নিচ এবং কড়াইল লেক সংলগ্ন বস্তি এলাকা থেকে আগত ড্রেনেজ লাইনগুলোর ডাইভার্টকরণ কাজ এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সবটিতে প্রকল্পভুক্ত না করে বাস্তবায়ন করা ঠিক হয়নি। ফলে যে উদ্দেশ্যে ৫০ কোটি টাকা দিয়ে লেকটি দূষণমুক্ত করার কথা ছিল তা অর্জিত হয়নি। এতে প্রমাণিত হয় যাচাই-বাছাই না করে এবং সব দিক বিবেচনা না করে প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত না হওয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অপচয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান সংসদীয় কমিটিকে লিখিতভাবে জানান, গুলশান-বারিধারা লেকে পতিত ড্রেনেজ আউটলেটগুলোকে ডাইভার্ট করার জন্য এ প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল। সব কাজ অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী করা হয়েছে। প্রকল্পের অনুকূলে অর্থ ছাড় হয়েছে ৪৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছে ৪৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা সরকারী খাতে চালানের মাধ্যমে যথাযথভাবে জমা দেয়া হয়েছে। এতে কোন দুর্নীতি অপচয় বা লুটপাট হয়নি। প্রকল্পের আওতায় গুলশান-বারিধারা লেকের পূর্ব পাশে ২৫টি ও পশ্চিম পাশে ৪০টি পয়েন্ট মোট ৬৫টি পয়েন্ট দিয়ে পতিত লাইন ডাইভার্ট করা হয়েছে। সূত্র মতে, সংসদীয় কমিটিকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, কালাচাঁদপুর ও গুলশান বাড্ডা লিঙ্ক রোড এলাকার ড্রেনেজ লাইনগুলো ডাইভার্ট করতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সব ড্রেনেজ লাইন পুনর্বাসন করার প্রয়োজন হওয়ায় কারিগরি বিবেচনায় ওই লাইনগুলোর ডাইভার্টকরণ আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় রাখা হয়নি। জানা গেছে, সংসদীয় কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ্ বিষয়টিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি পরবর্তী বৈঠকে তদন্ত প্রতিবেদন ও ওয়াসার কৈফিয়ত আরও সুনির্দিষ্ট করে কমিটিতে জমা দিতে বলেছেন। এদিকে প্রকল্পের আইটেম ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে পাইপ ড্রেন কনস্ট্রাকশনে। ১২ কিলোমিটারের পাইপ ড্রেন কনস্ট্রাকশনে ব্যয় হয়েছে ২০ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আর ৭৫০ থেকে ১৮৩০ ব্যাসার্ধের ১২ কিলোমিটারব্যাপী পাইপ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ ছাড়াও ১২ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারে ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, বক্সকালভার্টে ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ব্রিক সিউয়ারে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২৫ কিউসেক পাম্পের জন্য ১ কোটি ২৪ লাখ টাকাসহ অন্যান্য ব্যয় রয়েছে।
×